অনলাইন ডেস্ক : বাসার দেয়ালের ভেতরে লুকানো আস্ত একজন মানুষ! হত্যার পর সিমেন্ট-সুরকির প্রলেপ দিয়ে তাকে ঢেকে রাখা হয়েছিল! ধীরে ধীরে রক্ত-মাংসের এই মানুষটি দেয়ালের ভেতরে পরিণত হয় কঙ্কালে। কারও নিষ্ঠুর হাত জীবন্ত মানুষটিকে হত্যার পর দেয়ালের মধ্যে গায়েব করে দিয়েছিল! এই নরকঙ্কাল নিয়ে এতকাল ধরে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন ফ্ল্যাটের বাসিন্দারাও। দেয়াল খুঁড়ে কঙ্কাল উদ্ধার হলো বটে, তবে ফ্ল্যাটের ছোট্ট প্রিয় আঙিনাটুকু বাসিন্দাদের জন্য এক ভূতুড়ে আবহ তৈরি দিল। বাসার বাসিন্দাদের কেউ কেউ ভাবছেন, দেয়ালের ভেতর থেকে কেউ তাদের ডাকছেন! কখনও কল্পছায়ায় তাদের মনোজগতে কঙ্কাল ধরাও দিচ্ছে। গভীর রাতে কারও ভাবনায় এমনও আসে- হয়তো কঙ্কালটি হেঁটে বেড়াচ্ছে পুরো ঘরময়! হাত নেড়ে ডাকছে আর কঙ্কালটি বলছে, ‘ওরা আমাকে হত্যা করেছে। এত দিনেও ওদের চিনলে না। তোমরা আমার খুনিকে ধরতেও পারোনি। আমি বিচার চাই। খুনিরা আছে আশপাশে। খুনিরা যেন পার না পায়।’
হত্যার পর লাশ গুম করতে বাসার দেয়ালের মধ্যে সিমেন্ট-সুরকিতে ঢেকে দেওয়ার ঘটনা অবিশ্বাস্য। গন্ধ ঠেকাতে মরদেহ পলিথিনে মুড়িয়ে সঙ্গে চায়ের পাতাও রাখা হয়েছিল। ভৌতিক কোনো মুভিতে এমন দৃশ্য দেখা যেতে পারে। তবে বাস্তবে রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়ার একটি বাসার দেয়াল খুঁড়ে মিলল আস্ত এক নরকঙ্কাল।
মিরপুরের পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ৩৮৯ নম্বর বাড়ি। পঞ্চমতলা বাড়ির নিচতলার ফ্ল্যাটে হঠাৎ পানির সমস্যা দেখা দেয়। ভাড়াটিয়ারা বিষয়টি জানান বাড়ির মালিককে। এরপর বাড়ির মালিক পানির সমস্যা সমাধানে একজন মিস্ত্রি পাঠান ওই বাড়িতে। মিস্ত্রি পানির পাইপলাইনের কোথায় ত্রুটি, তা খুঁজে বের করতে দেয়ালের কয়েকটি জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি করেন। একপর্যায়ে স্টোররুমের ওপরে ফলস ছাদের দেয়াল খুঁড়তে থাকেন তিনি। তখনই বেরিয়ে আসে এক মানব কঙ্কাল! দেখে রীতিমতো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন ওই মিস্ত্রি ও বাড়ির বাসিন্দারা। এরপরই খবর দেওয়া হয় মিরপুর থানা পুলিশকে। কঙ্কাল উদ্ধারের পর এখন এর পরিচয় শনাক্ত করা নিয়ে পুলিশ গলদঘর্ম। আসলে কী ঘটেছিল? কোন হতভাগ্যের কঙ্কাল এটি? যাকে হত্যার পর লাশ গুম করে বাসার ভেতরেই সিমেন্ট ও বালুর প্রলেপ দিয়ে দেয়ালের ভেতরে রাখা হয়েছিল। ইট-সিমেন্টের প্রলেপের ওপর পলিথিন মোড়ানো ছিল। কঙ্কালের সঙ্গে চায়ের পাতাও মেশানো ছিল, যা দেখে পুলিশ ধারণা করছে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়েছে। গন্ধ আটকাতেও সর্বোচ্চ তৎপর ছিল জড়িতরা। তবে অপরাধবিজ্ঞানের কথা, অপরাধ কখনও লুকানো যায় না। ঠিকই পানির সমস্যার সূত্র ধরে বেরিয়ে এলো নরকঙ্কাল। হত্যার পর লাশ গুম করে বাসার দেয়ালের মধ্যে সিমেন্ট-বালুর প্রলেপ দিয়ে লুকিয়েও শেষ পর্যন্ত ভয়ংকর এ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব হয়নি খুনিদের পক্ষে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর ওই কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। তবে খবরটি গোপনই ছিল। ওই দিনই মামলা হয়। পরে মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর বিভাগ সিআইডি, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগসহ একাধিক সংস্থায় চিঠি দিয়েছে। পুলিশ চিঠিতে জানতে চেয়েছে- কঙ্কালটি পুরুষ, নাকি নারীর। কত দিন আগের ঘটনা? এখন পর্যন্ত ফরেনসিক বিভাগ তাদের প্রাথমিক মতামতে জানিয়েছে, কঙ্কালটি একজন নারীর। কারণ, কঙ্কালের পাশে পাঁচ-ছয় ইঞ্চি লম্বা চুল পাওয়া গেছে। আর এমন চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের সময়কাল সম্পর্কে ধারণা পেতে ডিএনএ প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার অপেক্ষা করছে তদন্ত সংস্থা। এদিকে, পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে এই কঙ্কালের পেছনের রহস্য কাহিনি।
জানা গেছে, শেওড়াপাড়ায় যে বাড়ির দেয়াল খুঁড়ে মানব কঙ্কাল পাওয়া গেছে, সেই বাড়ির মালিক আবদুল হালিম সরকার। তার বয়স ৬৩। তিনি জানান, ১৯৯১ সালে তিনি বাড়িটি নির্মাণ করেন। গত ২৯ বছরে তার বাড়ির এই নিচতলায় কমপক্ষে তিনটি পরিবার ভাড়াটিয়া হিসেবে ছিল। এখন পর্যন্ত তিনি এই তিন পরিবারের তথ্য পুলিশকে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে আদম আলী নামের এক ব্যক্তি ২০ বছর নিচতলায় ভাড়া নিয়ে থাকতেন। নোমান নামের আরেক ভাড়াটিয়া ছিলেন তিন মাস। বর্তমানে যারা ওই ফ্ল্যাটে রয়েছেন, তারা আছেন ৯ মাস ধরে। এরই মধ্যে পুলিশ বর্তমান ও সাবেক সব ভাড়াটিয়ার মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে ওই ফ্ল্যাটে থাকা দ্বিতীয় ভাড়াটিয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য পুলিশকে জানাতে পারেননি ভবন মালিক। ভবন মালিককেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।
বাড়িটির মালিক ও ফার্নিচার ব্যবসায়ী আবদুল হালিম সরকার বলেন, কীভাবে বাসার ভেতরে কঙ্কাল এলো, সেই হিসাব আমরাও মেলাতে পারছি না। একসময় ওই বাড়ির ভাড়ার বিষয়টি দেখভাল করতেন আমার স্ত্রী। বর্তমানে আমার মেয়ে দেখাশোনা করছেন। ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের পানির সমস্যা দূর করতে গিয়ে মিস্ত্রি ডাকা হয়। তিনি কঙ্কাল পেয়েছেন। আমরা চাই, এর সুষ্ঠু তদন্ত হোক। মূল রহস্য বেরিয়ে আসুক।
বাড়ির মালিক আরও বলেন, জঙ্গিরা যখন বেশি তৎপর হয়েছিল, তখন থেকে ভাড়াটিয়াদের তথ্য রাখার দিকে বেশি মনোযোগী হই। এর আগে তো অনেক সময় সেভাবে ভাড়াটিয়ার তথ্য রাখাও হতো না।
ফ্ল্যাটের বর্তমান বাসিন্দা শ্যামল খান জানান, ৯ মাসের মতো আমরা এই ফ্ল্যাটে উঠেছি। কখনও বাসার ভেতর থেকে লাশ পচার কোনো গন্ধও পাওয়া যায়নি। তবে বাড়িওয়ালাকে পানির সমস্যা সমাধানের কথা বলার চার দিন পর মিস্ত্রি পাঠানো হয়। ওই মিস্ত্রি দেয়াল খুঁড়তে গিয়ে কঙ্কালটি দেখতে পান।
শ্যামল খান আরও বলেন, পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে আমরা ফ্ল্যাটে থাকি। বাসার ভেতর কঙ্কাল পাওয়ার পর আমাদের এখন একটু ভয় হচ্ছে। বাচ্চারা একটু বেশি শঙ্কিত।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর থানার উপপরিদর্শক শফিকুল ইসলাম জানান, কঙ্কালটি ফ্ল্যাটের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে স্টোররুমের ওপর ফলস ছাদের দেয়ালের ভেতরে পাওয়া গেছে। দেয়ালের ভেতরে লাশটি ঢুকিয়ে ওপরে ইট-সিমেন্টের প্রলেপ দেওয়া ছিল, যাতে গন্ধ বের না হয়। এটি নিশ্চিত করতে পলিথিনও মুড়িয়ে দেওয়া হয়।
শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, হাড়গুলো প্রায় শুকিয়ে গেছে। মাংসের কোনো অস্তিত্ব নেই। কঙ্কালের ব্যাপারে মতামত জানতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ ও সিআইডির কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে। বর্তমান ও সাবেক সব ভাড়াটিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আশপাশের এলাকা থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ব্যাপারেও খোঁজ নেওয়া শুরু হয়েছে। ফরেনসিক পরীক্ষায় ঘটনার তারিখ সম্পর্কে জানা গেলে সন্দেহের তালিকা ছোট করে আনা হবে। অপরাধী শনাক্ত করা তখন একটু সহজ হবে।
তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, বাড়ির মালিক ১৯৯০-৯৩ সাল পর্যন্ত ওই ফ্ল্যাটের নিচতলায় ছিলেন। এর পর থেকে ভাড়াটিয়ারা সেখানে বসবাস করতেন। হত্যার রহস্য উন্মোচন করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের ডা. এ কে এম মাইনুদ্দিন বলেন, প্রাথমিক মতামত হলো এটি একজন নারীর কঙ্কাল। জব্দ করা চুল থেকে এমন ধারণা করা যায়। তবে সন্দেহাতীতভাবে কঙ্কালের লিঙ্গীয় পরিচয় ও কবেকার ঘটনা, এটা জানতে ফরেনসিক পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। ফরেনসিক প্রতিবেদন পেলে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে।
ওই চিকিৎসক আরও বলেন, একটি মরদেহ কঙ্কাল হতে নূ্যনতম তিন মাসে লাগে। তবে আবহাওয়া ও পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় কোনো মৃতদেহ কঙ্কাল হতে আরও বেশি সময়ও লাগতে পারে।
মিরপুর থানার ওসি মোস্তাজিরুল রহমান বলেন, কঙ্কালটির পরিচয় ও অপরাধী শনাক্ত করাই বড় চ্যালেঞ্জ। সম্প্রতি এ এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন- এমন কারও ব্যাপারে আমরা তথ্য পাইনি।
এদিকে, ২০ বছর ধরে বসবাসকারী ভাড়াটিয়া সাবেক সরকারি কর্মচারী আদম আলী বলেন, কঙ্কাল উদ্ধারের সূত্র ধরে পুলিশ আমাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। ভাড়াটিয়া হিসেবে এখানে থাকতাম। এর বাইরে কোনো তথ্য আমরা জানি না। এ ঘটনা শুনে আমরাও চমকে উঠেছিলাম।