অনলাইন ডেস্ক : আগের হাজার খানেক দিনের মতো গেল শনিবারও মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মনুষ্যবিহীন মহাকাশ যান ইনসাইট মঙ্গলের মাটিতে চুপচাপ বসে নিজের কাজ করছিল। হঠাৎ সেখানে ভূমিকম্প হয়, যেমন হয় পৃথিবীতে কারো কিছু বুঝে ওঠার আগেই।

তারপর প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলে এই ভূমিকম্প। পৃথিবীতে এমন ভূমিকম্প কয়েক মিনিট স্থায়ী হলে প্রাণহানি হতে পারে লাখো মানুষের।

ইনসাইটে থাকা সিসমোমিটারে ধরা পড়া ভূমিকম্পের এ তথ্য চলে আসে পৃথিবীতে। বহুদিন ধরেই নাসার বিজ্ঞানীরা এরকম বড় একটা ভূমিকম্পের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। ইনসাইটের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪.২। ২০১৮ সালের নভেম্বরে ইনসাইট মঙ্গলে পৌঁছানোর পর থেকেই মূলত এমন একটি ভূমিকম্প দেখার অপেক্ষায় ছিলেন নাসার বিজ্ঞানীরা।

এরআগে অবশ্য ২৫ আগস্টও মঙ্গল গ্রহে দুটি বড় ভূকিম্পের তথ্য পৃথিবীতে পাঠিয়েছিল ইনসাইট। ওই ভূমিকম্প দুটির একটির মাত্রা ছিল ৪.২ ও আরেকটি ছিল ৪.১ মাত্রার।

তার আগে ইনসাইট সবচেয়ে বড় যে ভূমিকম্প পেয়েছিল সেটা ছিল ২০১৯ সালে ৩.৭ মাত্রার।

এপ্রিলে ইনসাইটের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ব্রুস ব্যানার্ডট বিজনেস ইনসাইডারকে বলেছিলেন, মনে হচ্ছে মঙ্গলে ছোট ভূমিকম্পের তুলনায় বড় ভূমিকম্প কমই আঘাত হানে। বিষয়টা অনেকটা গোলমেলে।

কিন্তু শনিবারের ভূমিকম্পের ক্ষমতা ২০১৯ সালের ৩.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ছিল।

মঙ্গলের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করতে পারবেন জন্মের সময় মঙ্গলগ্রহ কেমন ছিল। এসব বিষয় সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা লাভ করতে পারলে মহাবিশ্বের অন্য কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না, তা জানার পথে কয়েক ধাপ এগোতে পারবেন বিজ্ঞানীরা।

ব্রুস ব্যানার্ডট এপ্রিলে আরও বলেছিলেন, মঙ্গল গ্রহের কেন্দ্র ও পৃষ্ঠের তথ্য থেকে এটা বোঝা যায় যে, গত ৪৫০ কোটি বছরে এর খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এ থেকে আমরা একটা ধারণা পেতে পারি একেবারে শুরুর দিকে পৃথিবীর অবস্থা কেমন ছিল। মঙ্গল থেকে পাওয়া তথ্য আমাদের বুঝতে সাহায্য করছে যে, পাথুরে গ্রহগুলো আসলে কিভাবে জন্ম নেয় আর তারপর কিভাবে সেগুলো বিবর্তিত হয়।

ইনসাইট মঙ্গলে নামার পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ৭০০ ভূমিকম্পের খবর দিয়েছে। আর এ থেকেই এরইমধ্যে গ্রহটি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। যেমন: বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন তারা যেমন ধারণা করেছিলেন মঙ্গলের পৃষ্ঠ আসলে তার চেয়ে বেশি পাতলা। আর এর সাথে পৃথিবীর ভূ-ত্বকের যতটা মিল আছে তার চেয়ে বেশি চাঁদের উপরিভাগের সাথে মিল রয়েছে।

মঙ্গলপৃষ্ঠ শুষ্ক এবং অতীতে গ্রহাণু ও ধূমকেতু দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে সেখানে ভূমিকম্প শুরু হলে তা পৃথিবীর ভূমিকম্পের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়। মঙ্গলপৃষ্ঠে থাকা বিভিন্ন ফাটলের কারণে ভূমিকম্প শুরুর পর সেটা বারবার ফিরে আসতে থাকে। এছাড়া মঙ্গলপৃষ্ঠে আর্দ্রতাও কম। তাই ইনসাইট মঙ্গলে যে ভূমিকম্পগুলো পেয়েছে সেগুলোর সবগুলোই সাধারণত ১০ থেকে ৪০ মিনিট করে স্থায়ী হয়েছে।

এছাড়া সম্প্রতি এসব ভূমিকম্পের তথ্য থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, মঙ্গলের কেন্দ্রে গলিত কিছু রয়েছে। তবে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, পৃথিবীর কেন্দ্রে যেমন রয়েছে অর্থাৎ গলিত একটা বহির্ভাগের আড়ালে শক্ত কেন্দ্রস্থল, মঙ্গলেও তেমনটা আছে কি না।

বছরের শুরুর দিকে অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছিল যে আরেকটু হলে ইনসাইটকে তার সিসমোমিটার বন্ধ করতে হতো। ইনসাইটের সোলার প্যানেলে ধূলার আবরণ পড়ে যাওয়ায় রোবটটিকে জ্বালানি ঘাটতিতে পড়তে হয়। এই সোলার প্যানেল থেকেই সূর্যের আলোর মাধ্যমে শক্তি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ইনসাইট।

মঙ্গলে গ্রহে নাসার অন্য যে রোবটগুলো আছে সেগুলোর সোলার প্যানেলেও নিয়মিত ধূলা পড়ে। কিন্তু নিয়মিতভাবে বাতাসে সেই ধূলা উড়েও যায়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো ইনসাইট যেখানে বর্তমানে আছে সেখানে দমকা হাওয়া অস্বাভাবিকভাবে কম।

এরমধ্যে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, পৃথিবীতে যখন বসন্ত ও গ্রীষ্ম চলছে, মঙ্গল তখন তার বছরের সবচেয়ে শীতল সময়টাতে প্রবেশ করছে। এ সময়টাতে নিজের কক্ষপথে সূর্যের সাথে সবচেয়ে বেশি দূরত্বে অবস্থান করে মঙ্গল। এর অর্থ দাঁড়ায়, এই সময়ে টিকে থাকতে ইনসাইটকে আরও বেশি শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়োজন ছিল।

তাই নাসার বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নেন ইনসাইটকে আপাতত হাইবারনেশনে থাকতে হবে। হাইবারনেশন বা শীতনিদ্রা বা শীতযাপনতা হলো প্রাণীজগতের এমন একটি শারীরিক অবস্থা যে অবস্থায় শারীরিক ক্রিয়াকলাপ থাকে ন্যূনতম পর্যায়ে। অতিরিক্ত শীতের সময়ে কিছু প্রাণী শরীরের তাপমাত্রা ধরে রাখতে এটা করে থাকে।

একই পদ্ধতি অনুসরণ করে ইনসাইট নিজেকে উষ্ণ রাখতে ও শক্তির বাড়তি খরচ রোধ করতে ফেব্রুয়ারিতে এর বিভিন্ন সায়েন্টিফিক ইন্সুট্রুমেন্টগুলো বন্ধ করতে শুরু করে। সে মোতাবেক জুনে সিসমোমিটারটিও বন্ধ করার কথা চিন্তা করা হয়েছিল নাসার দিক থেকে। আবার ২০২২ এর এপ্রিলের পর ইনসাইট বিকল হয়ে যাবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন অনেকে।

তবে শেষ পর্যন্ত বিশেষ চেষ্টায় ইনসাইটকে দিয়ে তার সোলার প্যানেলে জমা ধূলার কিছুটা সরানো সম্ভব হয়। এর ফলে ঘণ্টায় ৩০ ওয়াট করে খরচ করে ৩০ ঘণ্টা চলার মতো শক্তির পাওয়ার ব্যবস্থা হয়।

একইপদ্ধতি কয়েকবার অনুসরণ করা হয় যাতে গোটা জুন ও জুলাই মাসে ইনসাইটের সিসমোমিটার সক্রিয় রাখা যায়। তারপর থেকে মঙ্গল আবার সূর্যের দিকে ফিরতে শুরু করে।

ব্যানার্ডট এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, তখন যদি আমরা তাড়াহুড়া করে ওই কাজটা না করতাম, তাহলে আজ অনেক বড় তথ্য থেকে বঞ্চিত হতাম। সূত্র : বিজনেস ইনসাইডার।