অনলাইন ডেস্ক : করোনাভাইরাসের কারণে গত মার্চ থেকে সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ। তার ওপর সোনার দাম বাড়তে বাড়তে অনেকেরই নাগালের বাইরে চলে গেছে। ফলে সোনার গয়না বানাতে দোকানমুখী হচ্ছেন না ক্রেতারা। আর কাজ কমে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন গয়না তৈরির অধিকাংশ কারিগর। তাই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে কর্মী ছাঁটাই ও বেতন কমানোর পথে হাঁটছেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা।
জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর দোকানপাট খুললেও সোনার অলংকার বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় ৮০ শতাংশ কম। এ অবস্থা আর দু-তিন মাস চললে ২৫ শতাংশ জুয়েলারি দোকান বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জানা যায়, দেশে বছরে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার কেজি সোনার চাহিদা রয়েছে। তার মধ্যে ১০ শতাংশ পুরোনো সোনার অলংকার গলিয়ে সংগ্রহ করা হয়। এত দিন বৈধভাবে আমদানির সুযোগ না থাকায় চাহিদার বাকি ৯০ শতাংশ সোনা ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে আসত। করোনায় দেশে দেশে অবরুদ্ধ অবস্থা থাকায় বিমান চলাচল বন্ধ ছিল। এতে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বিদেশ থেকে সোনার বার আসা বলতে গেলে শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। আবার বিশ্ববাজারে দাম ঊর্ধ্বমুখী।
ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে সোনা আসা বন্ধ ও বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত শুক্রবার সোনার প্রতি ভরির দাম উঠেছে ৭২ হাজার ৭৮৩ টাকায়। করোনাকালে এক মাসের ব্যবধানে ভরিতে সাড়ে আট হাজার টাকা মূল্যবৃদ্ধির কারণে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে খাতটিতে।
বিশ্ববাজারের সঙ্গে দেশীয় বাজারে সোনার দরের ভরিতে চার-পাঁচ হাজার টাকার ব্যবধান থাকেই। জুয়েলার্স সমিতির নেতারা একাধিকবার আশ্বাস দিয়েছিলেন, বৈধভাবে আমদানি হলে সেই ব্যবধান তিন হাজার টাকা কমবে। স্বর্ণ নীতিমালার আলোকে গত বছর ১৯ প্রতিষ্ঠান সোনা আমদানির ডিলার লাইসেন্স পেয়েছে। গত মাসে আমদানিও শুরু হয়েছে। তাতেও দাম কমার লক্ষণ নেই। আদৌ কমবে কি না, সেটি নিয়েও রয়েছে সন্দেহ।
অবশ্য বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি এনামুল হক বলেন, উচ্চ মূল্যের চেয়ে করোনা জুয়েলারি ব্যবসার বেশি ক্ষতি করেছে। দাম যতই বাড়ুক না কেন, একশ্রেণির ক্রেতা গয়না কিনবেনই। তিনি বলেন, ব্যবসায় টিকে থাকতে অনেক ব্যবসায়ী কর্মী ছাঁটাই ও বেতন কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে দোকানের অলংকার বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন।
সারা দেশে ১০ হাজারের মতো জুয়েলার্স বা সোনার দোকান রয়েছে। তার মধ্যে জুয়েলার্স ব্র্যান্ডসংখ্যা হাতে গোনা ১৫-২০টি। বাকিগুলো ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান। জুয়েলারির জন্য গয়না তৈরি করেন প্রায় ৫০ হাজার কারিগর।
পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে সোনার গয়না তৈরির শত শত কারখানা গড়ে উঠেছে। তাতে কাজ করেন প্রায় ২০ হাজার কারিগর। কারিগরদের ৯৯ শতাংশই মাসিক কোনো মজুরি পান না। ১ ভরি বা ১৬ আনা সোনার গয়না বানালে তাঁরা পান ২ আনা সোনা। সেটাই তাঁদের উপার্জন। বর্তমানে কাজ না থাকায় খরচ বাঁচাতে তাঁতীবাজারের অধিকাংশ কারিগরই গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন।
তাঁতীবাজারের অনেক জুয়েলারির নিজস্ব কারখানা রয়েছে। অনেকে আবার কারখানা প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন জুয়েলারির গয়না তৈরি করেন। তেমনই একজন দীনেশ পাল। গত শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সোনার দামের উচ্চ মূল্যের কারণে কয়েক বছর ধরেই ব্যবসা কিছুটা মন্দা। সে জন্য অনেক কারিগরই পেশা বদল করেছেন।
দীনেশ পাল স্বর্ণশিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, করোনাকালে ভয়াবহ সংকটে পড়েছেন সোনার কারিগরেরা। বর্তমানে পুরো তাঁতীবাজারে খুঁজলেও হাজারখানেক কারিগর পাওয়া যাবে না। কাজ না থাকায় সংসার চালাতে অনেকেই হকারি করছেন বলে দাবি করেন তিনি।
সোনার পুরোনো গয়না ও সোনার বার কেনাবেচার বড় ব্যবসাও তাঁতীবাজারে। গত মাসে কয়েকটি আন্তর্জাতিক পথে বিমান চলাচল শুরু হলেও ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে আমদানি হওয়া সোনার বার আসার পরিমাণ এখনো কম। তবে পুরোনো গয়নার বেচাকেনা বর্তমানে বেশ রমরমা বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।
ঢাকা নিউমার্কেটের জুয়েলারি ব্যবসায়ী দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ। দু-তিন দিন পরপর বউনি হচ্ছে অনেক দোকানে। রোজার ঈদের পর থেকে পারিবারিকভাবে অল্প কিছু বিয়েশাদি হলেও বড় অনুষ্ঠান হচ্ছে না। ফলে একটি আংটি কিংবা একটি গলার চেন দিয়ে কাজ সারছে অধিকাংশ মানুষ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে নানামুখী কৌশল নিচ্ছেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা। স্বনামধন্য একটি ব্র্যান্ড খরচ কমাতে তাদের ২৫টি বিক্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ১০টি বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। নতুন গয়না বেচাবিক্রি কমে যাওয়ায় পুরোনো গয়না কেনায় বিনিয়োগ করছেন অনেক ব্যবসায়ী। কিস্তিতে গয়না বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে একাধিক প্রতিষ্ঠান।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা কোনো ঋণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখতে করোনাকালে দোকানভাড়া ৫০ শতাংশ হ্রাস ও স্বর্ণশিল্পীদের রেশনকার্ডের মাধ্যমে নিত্যপণ্য সরবরাহ করা প্রয়োজন।