অনলাইন ডেস্ক : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। করোনা রোগীর সংখ্যা, রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা, হাসপাতালের তথ্যে ভুল ও অস্পষ্টতা দেখা যাচ্ছে। তথ্যের সীমাবদ্ধতার কারণে করোনা নিয়ন্ত্রণ উদ্যোগ বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে।

মহামারি পরিস্থিতি মূল্যায়ন, প্রক্ষেপণ, নীতিনির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সঠিক তথ্য দরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আট সদস্যবিশিষ্ট পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘আপনি ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) কিনতে চান। কেনার আগে জানতে হবে কতজন চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর পিপিই দরকার। এর জন্য একধরনের তথ্য দরকার। আবার মহামারি বিষয়ে প্রক্ষেপণের জন্যও তথ্য দরকার। কিন্তু সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ভবিষ্যতের কোনো মহামারি মোকাবিলার জন্য বর্তমান মহামারির তথ্য সংরক্ষণ করা জরুরি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, করোনাযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হচ্ছে রোগতাত্ত্বিক তথ্য। বাংলাদেশের এই অস্ত্রটি দুর্বল।

তথ্যের দুর্বলতার কথা স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ‘করোনার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। শুরুতে অনেক ভুলত্রুটি ছিল। করোনা মোকাবিলায় নতুনভাবে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তথ্যের সমস্যা দূর করা তার একটি।’

রোগীর সংখ্যায় বিভ্রান্তি

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘সারা দেশের মোট রোগীর সংখ্যার সঙ্গে জেলাভিত্তিক তথ্য মেলালে ব্যাপক ফারাক চোখে পড়ছে। ৬৪ জেলার মোট রোগীর সংখ্যা যোগ করলে দেখা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যা বলছে, তার চেয়ে প্রায় ৩০ হাজার রোগী কম।’

পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি সমস্যাটি প্রায় দেড় মাস আগে ধরতে পারে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানায়। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। এখন এই তথ্যের ভিত্তিতে জেলাভিত্তিক কোনো পরামর্শ দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে করোনাবিষয়ক সরকারি তথ্যের প্রধান উৎস তিনটি। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) শুরু থেকে করোনাবিষয়ক তথ্য জানাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সমন্বিত নিয়ন্ত্রণকক্ষ প্রতিষ্ঠার পর এই কক্ষ থেকে গণমাধ্যমে তথ্য দেওয়া শুরু হয়। এখন যে নিয়মিত সংবাদ বুলেটিন প্রচারিত হয়, তার তথ্য এই কক্ষ থেকে সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া সরকার করোনাবিষয়ক corona.gov.bd ওয়েবসাইট চালু করেছে। তাতেও করোনাবিষয়ক তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। এই তিন উৎস থেকে পাওয়া তথ্যে অসংগতি দেখা যায়।

আইইডিসিআর ঢাকা বিভাগসহ আটটি বিভাগের সব জেলার এবং ঢাকা শহরের তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে আসছে। ১৩ জুন তারা বলেছিল, ঢাকা শহরে মোট রোগী ২৩ হাজার ৩৯৯ জন। অন্যদিকে ২২২টি এলাকার মোট রোগী ছিল ১৩ হাজার ১৫৬ জন। এ নিয়ে প্রথম আলো সংবাদ ছেপেছিল। তখন আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তথ্য সংগ্রহের সময় বিস্তারিত ঠিকানা না লিখে শুধু ঢাকা লেখার কারণে এটা হয়ে থাকতে পারে।

তথ্যের এই সীমাবদ্ধতা প্রভাব ফেলেছে করোনা প্রতিরোধ কর্মকাণ্ডে। সরকার ঢাকা শহরে রোগী ও জনসংখ্যার অনুপাতের ভিত্তিতে লাল, হলুদ ও সবুজ এলাকা চিহ্নিত করেছে। শোনা যাচ্ছে, ছোট ছোট এলাকা ধরে লকডাউন করা হবে। এই লকডাউন পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এলাকার সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না। সিদ্ধান্ত নিতেও তাই বিলম্ব হচ্ছে।

মৃত্যু অবহেলিত

এ পর্যন্ত দেশে ১ লাখ ১২ হাজার ৩০৬ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ৪৬৪ জন। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, এই তথ্য যথেষ্ট নয়। প্রথমত, জেলাভিত্তিক কোনো মৃত্যুর তথ্য নেই। দ্বিতীয়ত, কোন কোন হাসপাতালে মৃত্যু বেশি হচ্ছে, সেই তথ্যও নেই। পরিস্থিতি জানার জন্য মৃত্যুর আগে কতজন আইসিইউতে ছিলেন, করোনার সঙ্গে আর কোনো রোগ ছিল কি না—এসব তথ্য দরকার। এ রকম তথ্য কোনো দপ্তরে নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, মহামারি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার জন্য করোনা উপসর্গ নিয়ে কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, সেই তথ্য সংগ্রহ করা দরকার। কিন্তু সরকারের কোনো দপ্তরে সেই উদ্যোগ নেই। করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর তথ্য একাধিক দৈনিক সংবাদপত্র নিয়মিত প্রকাশ করে আসছে। কিছু তরুণ শিক্ষার্থীদের ১১ জনের একটি দলও এ নিয়ে কাজ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও একটি উদ্যোগ আছে। নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে।

পরীক্ষায় গোলমাল

রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা নিয়ে মানুষের অসন্তুষ্টি প্রায় শুরু থেকে। এখন সন্দেহ দেখা দিয়েছে এর তথ্য নিয়ে। যেসব রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন বা যেসব রোগী বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হচ্ছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা করতে হয়। একই পরীক্ষা ২৪ ঘণ্টায় দুবার করতে হয়। প্রথম পরীক্ষায় ঋণাত্মক হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দ্বিতীয় পরীক্ষার দরকার হয় না। পরীক্ষা চিকিৎসকের পরামর্শে পরে করা হয়। পরীক্ষা করানোতে সমস্যা হওয়ায় ৩ মে বলা হলো, রোগ নিরাময়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য এই পরীক্ষা না করালেও চলবে। কিন্তু অনেকেই পরীক্ষা করাচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, গতকাল রোববার পর্যন্ত ৪৫ হাজার ৭৭ জন সুস্থ হয়েছেন। এঁদের মধ্যে কতজনের দুবার পরীক্ষা হয়েছে, তার তথ্য নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। যাঁদের পরীক্ষা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে কতজনের পজিটিভ হয়েছে, সেই তথ্যও নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, দৈনিক শনাক্ত হওয়া নতুন রোগীর সঙ্গে এসব পজিটিভ রোগীর সংখ্যা মিলিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে।

হাসপাতালের হাল

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণকক্ষ জানিয়েছে, রাজধানীতে করোনা রোগীর জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে ৭ হাজার ২৫০টি শয্যা প্রস্তুত। দেখেছে, বাস্তবে প্রস্তুত নয়। যেমন উত্তর সিটি করপোরেশনের মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের কাছে ডিএনসিসি মার্কেটে দেড় হাজার শয্যার আইসোলেশন সেন্টার ও চিকিৎসক-নার্সদের জন্য ২৫০ শয্যার হাসপাতালের তথ্য ওই হিসাবের মধ্যে আছে। বাস্তবে এই আইসোলেশন কেন্দ্র ও হাসপাতাল এখনো তৈরি হয়নি।

একটি বেসরকারি হাসপাতালের ২০০ শয্যাকে প্রস্তুত বলে দেখানো হয়েছে, বাস্তবে সেই হাসপাতাল চিকিৎসা দিচ্ছে না।

ব্যাখ্যা নেই

শনাক্ত হওয়া রোগীদের বড় অংশটি বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেয়। বাড়িতে থেকে অনেক মানুষ সুস্থ হচ্ছেন। কিন্তু বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিয়ে কত মানুষ সুস্থ হচ্ছেন, তা নিয়মিত জানায় না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। হঠাৎ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৫ জুনের সংবাদ বুলেটিনে বলা হয়, ৩৪ হাজার ২৭ জন রোগী সুস্থ হয়েছেন, এর আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ৭৩০। কিন্তু বলা হয়নি বাড়িতে কতজন সুস্থ হয়েছে বা বাড়িতে সুস্থ হওয়ার তথ্য সরকার পেল কীভাবে।

ফলাফল ও করণীয়

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, আস্থাহীন পরিবেশ মহামারি নিয়ন্ত্রণের সহায়ক হতে পারে না। এর ফলে মানুষ সরকারের ভালো উদ্যোগেও সাড়া দিতে দ্বিধা করতে পারে। লকডাউন বা যেকোনো উদ্যোগে মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হলে সঠিক তথ্য দিতে হবে। মহামারি পরিস্থিতি বুঝতে কী কী তথ্যের প্রয়োজন, তার সুনির্দিষ্ট ছক আছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার।

তথ্যের ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘তথ্য লুকানো বা তথ্যে বিচ্যুতি ঘটানো স্বাস্থ্য বিভাগের দীর্ঘদিনের প্রবণতা। তারই ধারাবাহিকতা মহামারির সময়েও অব্যাহত আছে। জবাবদিহি না থাকার কারণে এটা হয়েছে।’ তিনি বলেন, সঠিক তথ্য না থাকলে জনমনে বিভ্রান্তি, সন্দেহ সৃষ্টি হয়। মানুষ সরকার তথা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপর আস্থা হারাচ্ছে।