সাজ্জাদ আলী : এক:
সদর রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে শিশুটি মনের আনন্দে হেলেদুলে হাঁটছে। সাথে কেউ নেই, অভিভাবকহীন সে। কানাডার পরিভাষায় যাকে বলে আন-অ্যাটেনডেন্ট চাইল্ড। ফুটফুটে ছেলেটি, বয়স বছর দুয়েকের বেশি হবে না। এই হাঁটে তো এই দৌড়ায়, পেছন ফিরে চায়, আবার হাঁটে বা দাঁড়িয়ে পড়ে কখনো। টালমাটাল তার পা ফেলা, মনে হয় পড়েই যাবে, কিন্তু সামলে নেয়। এখনও দৃঢ়পায়ে হাঁটতে শেখেনি সে। কোথাও যাওয়ার জন্য সে হাঁটছে না, কোনো গন্তব্য নেই তার। পরনে হাফ প্যান্ট, খালি পা, গায়ে গাঢ় নীল রংয়ের টি-সার্ট। বেনি বটে বটে মাথার চুল জটা বানানো। ফকির দরবেশদের চুলের মতো। এখানকার কালো রংয়ের মানুষদের পরিবারের বাচ্চাদের এমন চুলের বিন্যাস খুব জনপ্রিয়।

সেদিন খুব ভোরে টরন্টোর আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছিল মাত্র। নতুন একটি দিনকে স্বাগত জানাতেই যেন শিশুটি রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। ৬ লেনের মার্কহাম রোডটি শহরের অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা। তবে অতটা সকালে গাড়িঘোড়া তেমন নেই, আর হাঁটা লোক তো একেবারেই নেই। এ দেশের লোকেরা সাধারণত হেঁটে কোথাও যায় না। যার যার গাড়িতে চলাফেরা করে, নইলে ট্যাক্সি বা গণপরিবহন। তাই হয়তো ফুটপাথ দিয়ে কেউ হাঁটলে তা সহজেই চোখে পড়ে।

ছোট্ট এই ছেলেটি বাড়ির লোকের অজ্ঞাতে কোন এক ফাঁকে ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু কানাডিয়ান সমাজে এতো মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো ঘটনা! যে শহরে মালিকের সাথে ছাড়া রাস্তায় একটা বিড়াল-কুকুরও দেখা যায় না, সেখানে কি না এক মানব শিশু রাস্তায় একাকী হেঁটে বেড়াচ্ছে! এ দেশের বাচ্চারা ২৪ ঘন্টাই মা-বাবা বা বয়স্ক কারো তত্বাবধানে থাকে। আর এতিম বা অভিভাবকহীন শিশুদের দেখভালের দায় তো স্বয়ং সরকারের। এমন কি প্রতিপালনে অমনোযোগি বাবা-মায়ের সন্তানদের শিশুকল্যাণ বিভাগ অধিগ্রহণ করে পেলেপুষে বড় করে দেয়। “শিশু অবহেলা” এই সমাজে ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য। “আন-অ্যাটেনডেন্ট চাইল্ড” কানাডিয়ানরা কল্পনাও করতে পারে না।

ঘটনাটি ঘটেছিলো মাস দেড়েক আগে। অভ্যাস মতো সেদিনও ঘুম থেকে উঠেই শহরের খবর জানতে লোকাল টেলিভিশন চ্যানেল খুললাম। দেখি ওই শিশুটির বাবা-মায়ের খোঁজ চেয়ে প্রতিটা চ্যানেলই পুলিশের আবেদনটি প্রচার করছে। ওটিই সেদিনকার খবরের প্রধান শিরোনাম। বাচ্চাটির হাঁটাহাঁটির খবর কেউ হয়তো পুলিশকে জানিয়ে থাকবে। আর যায় কোথায়! মানব শিশু রাস্তায় একাকী? এতো সরকার এবং রাষ্ট্রের চূড়ান্ত অকর্মণ্যতা! পড়ি কি মরি করে পুলিশ আর শিশুকল্যাণ দপ্তর রাস্তা থেকে ছেলেটিকে হেফাজতে নিয়ে প্রশাসনের মুখ রক্ষা করেছে। অবশ্য হাঁটায় বিঘ্ন ঘটানোর জন্য শিশুটি নিশ্চয়ই কর্তৃপক্ষের উপর নাখোস হয়ে থাকবে!

টেলিভিশনের পর্দায় শিশুটির হাস্যোজ্বল ছবিসহ টরন্টো পুলিশের বিজ্ঞপ্তিটি এ রকম,
“মার্কহাম ও কোগারকোর্ট এলাকার রাস্তায় একাকী হাঁটতে থাকা এই শিশুটি এখন স্থানীয় পুলিশের অফিসে আছে। তার মা-বাবাকে অনুরোধ করছি সন্তানকে নিয়ে যেতে। শিশুটি ভালো আছে, তরল খাবার খেয়েছে। আর পুলিশ অফিসারদের সাথে খেলাধুলা করছে।”
শুধু রেডিও টেলিভিশনে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পুলিশ ক্ষ্যান্ত হয়নি। ঘটনাস্থলের এক কিলোমিটারের মধ্যে তারা প্রতিটি বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে ছেলেটির পরিবারের খোঁজ করেছে। ওই দিন শহরের নাগরিকদের সমস্ত মনোযোগ ছিল ছেলেটির দিকে। কে সে, কী করে রাস্তায় এলো, তার বাবা-মায়ের খোঁজ পাওয়া গেল কি না- ইত্যাদি সব উৎকন্ঠা। পুলিশ অফিসের ফোন বেজেই চলেছে, আর ইমেইলবক্স ভরে উঠছে। বাধ্য হয়ে পুলিশ বিভাগ প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর তাদের ওয়েব সাইটে শিশুটির আপডেট নাগরিকদের জানান দিচ্ছে। প্রশাসনযন্ত্র কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা থেকে যে তৎপর হয়েছে, তা মোটেই নয়। তারা তাদের অন্তর থেকেই শিশুটির জন্য উদ্বিগ্ন হয়েছিল। যেন তাদের নিজেদের সন্তানই সংকটাপন্ন!

দুই:
ক’দিন আগে শবনম শাহজাহান নামের এক নারী তাকে ফেসবুকে যুক্ত করার অনুরোধ পাঠিয়েছিল। তার প্রোফাইল ঘেঁটে দেখি সে ঢাকায় ওকালতি করে। বিলাতে আইন পড়েছে এবং সুন্দরীও বটে। শেষের এই গুণটিতো আর উপেক্ষা করা চলে না! পরস্পর ফেসবুকে জোড়া বাঁধার প্রথম দিনেই শবনম ম্যাসেঞ্জারে লিখে জানালো যে, সে ঢাকা শহরের পথশিশুদের কল্যাণে কাজ করে। আমি ভাবলাম, ঢাকার শিশুরা এখনও তাহলে “পথে” আছে? বয়সের অর্ধেকের বেশি সময় আমি নর্থ আমেরিকায় থাকি। প্রবাসে বসে দেশের এত যে “উন্নয়নের জোয়ার” বইতে শুনি, পথশিশুরা আজও কি তবে ভাটির টানেই ভেসে চলেছে?
শবনমকে লিখলাম, পথের শিশুদের কথা আরেকটু বিস্তারিত বলোতো শুনি। খবরের কাগজের কাটিং, লিংক, ছবি, ভিডিও ক্লিপ, ইত্যাদি রেফারেন্সসহ সে জানালো,
“আজও ঢাকা শহরে শত শত শিশুর মাথা গোঁজার ঠাই নেই, ফুটপাথে ঘুমায়। কাপড়ের সংস্থান নেই, খালি গায়ে ঘুরে বেড়ায়। শিক্ষাসুযোগ তো বহু দূরাগত, দুবেলা মানুষের কাছে হাত পেতে চেয়ে-চিন্তে খায়। এই শিশুদের অনেকেই তাদের বাবা-মায়ের পরিচয়ও জানে না। পুতুল খেলার বয়সেই ওদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে।”

পাদটিকাঃ
শবনমের দেওয়া তথ্যে অন্তরে যে ক্ষত তৈরী হয়েছে, তা আমৃত্যু থাকবে। জগৎসংসারে ভাগ্যবান আর ভাগ্যবিড়ম্বিতদের কী নিষ্ঠুর সহঅবস্থান? কে কোথায় জন্মাবে তার নিয়ন্ত্রক তো কোনো শিশু নয়! তবে প্রকৃতির খেয়াল এমন কেন? দেশ ও সমাজ ভেদে শিশু প্রযতেœর কেন এত তফাৎ হবে? (লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)