অনলাইন ডেস্ক : ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। রাজধানীর ধোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের ইস্যুতে একদিকে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ধর্মীয় অঙ্গন, অন্যদিকে এটাকে হার্ডলাইনে বিবেচনা করছে আওয়ামী লীগ।
বিএনপির দাবি, ক্ষমতাসীন সরকার দেশকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ‘টেনেহিঁচড়ে ভাস্কর্য নামিয়ে ফেলা হবে’ হেফাজত ইসলামের আমীর জুনায়েদ বাবুনগরীর এমন বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল মানুষও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইমাম-মুসল্লি ঐক্য পরিষদ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিসসহ ইসলামী দলগুলো বলছে— মসজিদের শহরে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন করতে দেয়া হবে না।
ভাস্কর্য ও মূর্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে কোনো ভাস্কর্য নির্মাণ হতে পারে না। এটি কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী। বঙ্গবন্ধুর ঈমানি চেতনাকে উপলব্ধি করে ভাস্কর্যের পরিবর্তে মুজিব মিনার স্থাপন করুন। ভাস্কর্য বা মূর্তি অকল্যাণের প্রতীক। বঙ্গবন্ধুর নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ বানিয়ে তাকে স্মরণীয় করে রাখা হোক। এতে প্রতিনিয়ত তার আত্মায় সওয়াব পৌঁছতে থাকবে।
শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, সব প্রাণীর ভাস্কর্য বা মূর্তি তৈরির বিপক্ষে মত তাদের। আর আওয়ামী লীগ ও বড় একটি শ্রেণি বলছে, ভাস্কর্য ও মূর্তির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ভাস্কর্য হচ্ছে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও উজ্জ্বল স্মৃতির প্রতীক, মুক্তিযুদ্ধের অংশ। ভাস্কর্য পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই আছে। আর মূর্তি পূজার উপকরণ, সেটা ধমীয় বিষয়। ভাস্কর্য ও মূর্তি এক নয়। ভাস্কর্য ধর্মীয় কোনো ইস্যু হতে পারে না।
ইসলামী বিশেজ্ঞদের দাবি, মানুষের মৌলিক প্রয়োজনে ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবে। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে এবং পূজা বা অন্য কারণে ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবে না। ভাস্কর্য মানেই হারাম-হালাল বিষয়টি সেভাবে বিবেচনা করা ঠিক নয়। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন আছে কি-না সেটিও বিবেচনা করতে হবে।
আ.লীগের ঘোষণা— বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে যারা বিরোধিতা শুরু করেছে, তাদের ভিন্ন মতলব আছে। এটা ধর্মব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটার অপকৌশল। দেশের জনগণকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিটি ইউনিটির নেতাকর্মী এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।
সমপ্রতি রাজধানীর ধোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করতে গেলে আলেম-ওলামাদের বাধার মুখে পড়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের বিরোধিতা দেশের বড় অংশের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেলেও বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
মামুনুল হক চট্টগ্রামে মাহফিল করতে গেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনের বাধার সম্মুখীন হন। পুলিশও চড়াও হয় মামুনুল হকের সমর্থকদের ওপর। আটক হন অনেকে। নড়াইলের মাহফিলেও যেতে পারেননি মামুনুল হক।
হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকসহ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতাকারীদের গ্রেপ্তার দাবিতে শাহবাগে সড়ক অবরোধ করে ভাস্কর্যের পক্ষের গোষ্ঠী। অবরোধের কারণে শনিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত প্রায় এক ঘণ্টা শাহবাগ মোড় দিয়ে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। পরে ১ ডিসেম্বর সারা দেশে একযোগে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দিয়ে শাহবাগ মোড় ছাড়েন তারা।
অবস্থানে সংহতি জানিয়ে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ বিরোধিতাকারী মামুনুল-ফয়জুল গংদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এরা ইসলামের শত্রু, মানবতার শত্রু’ এদিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে আওয়ামী ওলামা লীগ।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান ও বিবৃতি দিয়ে ইতোমধ্যে কঠোর কর্মসূচির হুমকি দিয়েছে। যেকোনো মূল্যে ভাস্কর্য হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী ব্যক্তিরাও এ নিয়ে কথা বলেছেন।
ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেছেন, ‘মামুনুল হক জঙ্গিবাদকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। যারা সামপ্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের এখনই লাগাম টানতে হবে। তাদের যে লেজ হয়েছে সে লেজ কেটে দেয়ার সময় চলে এসেছে।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এমপি বলেছেন, ‘ভাস্কর্য হচ্ছে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও উজ্জ্বল স্মৃতির প্রতীক। কোনো শক্তি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধ রাখতে পারবে না।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্থপতির ভাস্কর্য টেনেহিঁচড়ে নামাবে বলে কোনো কোনো ধর্মীয় নেতা ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য রাখছেন। সরকারের সরলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না, জনগণের শান্তি বিনষ্টের যেকোনো অপচেষ্টা জনগণই রুখে দাঁড়াবে।’
ভাস্কর্য স্থাপনে ইসলামি দলগুলোর বিতর্ক নিয়ে নবনিযুক্ত ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান দুলাল বলেছেন, ‘মূর্তি আর ভাস্কর্য এক নয়। মূর্তি আর ভাস্কর্য নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি আছে। এই জিনিসটা যখন আমরা বোঝাতে সক্ষম হবো তখন সবকিছুর একটা সমাধান পেয়ে যাবো।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আতাউর রহমান মিরাজী আমার সংবাদকে বলেন, ‘মানুষের মৌলিক প্রয়োজনে ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবে।
কিন্তু বিনা প্রয়োজনে এবং পূজা বা অন্য কারণে ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবে না। ভাস্কর্য মানেই হারাম-হালাল বিষয়টি সেভাবে বিবেচনা করা ঠিক নয়। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন আছে কি-না সেটিও বিবেচনা করতে হবে। বিনা প্রয়োজনে ছবি রাখাও ইসলাম নিরুৎসাহিত করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভাস্কর্য বলতে আমরা কী বুঝি, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষ পুষ্ট নয়। এ জন্যই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের সঠিক জ্ঞানার্জন করতে হবে।’
ভাস্কর্য শিল্প-সংস্কৃতির অংশ উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুকুল কুমার বাড়ৈ আমার সংবাদকে বলেন, ‘ভাস্কর্য দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের অংশ। ভাস্কর্য পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই আছে। আর মূর্তিপূজার উপকরণ, সেটা ধর্মীয় বিষয়। ভাস্কর্য ও মূর্তি এক নয়। ভাস্কর্য ধর্মীয় কোনো ইস্যু হতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানবে। স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্পর্কে জানবে। ভাস্কর্য শিল্প-সংস্কৃতির অংশ। এটা ধর্মের সাথে কোনো ধরনের সম্পৃক্ত বিষয় নয়।’
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে যারা বিরোধিতা শুরু করেছে, তাদের ভিন্ন মতলব আছে। এটা ধর্মব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটার অপকৌশল। তাদের উদ্দেশে দেশের জনগণ সহজেই বুঝতে পারবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। দেশের জনগণকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিটি ইউনিটির নেতাকর্মী এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।’
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স আমার সংবাদকে বলেন, ‘দেশে ভাস্কর্য-মূর্তি নিয়ে আওয়ামী লীগ যে অবস্থায় রয়েছে, এতে দেশে একটি সংঘাত সৃষ্টির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিএনপি উদ্বিগ্ন। ভাস্কর্য নিয়ে সরকারের তৎপরতায় দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স আমার সংবাদকে বলেন, ‘ভাস্কর্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তা রাজনৈতিক। ভাস্কর্য নিয়ে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে যার যার মত ব্যবহার করছে। ভাস্কর্য পৃথিবীর সব দেশেই আছে। ভাস্কর্য অনৈতিক বিষয় নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি অসামপ্রদায়িক দেশ। এই দেশে যার যার ইচ্ছেমতো ভাস্কর্য তৈরি করতে পারে, মূর্তি তৈরি করতে পারে, প্রতিমা তৈরি করতে পারে। এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা নৈতিক কাজ হতে পারে না।
বরং দীর্ঘদিন ধরে ধর্মের আশ্রয়ে যারা ক্ষমতায় যাওয়ার অপচেষ্টা করে, তারা এটা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে। তারাই এদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং অপরাজনীতি করছে। সরকার, বিরোধী দল এবং দেশের জনগণকে এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার।’
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেছেন, ‘দেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুসলিম নেতা হিসেবে পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা করি এবং তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি।
কখনো কোনোভাবেই এমন একজন মরহুম জাতীয় নেতার বিরুদ্ধাচারণ করি না, করা সমীচীনও মনে করি না। আবারো স্পষ্ট করে বলছি, আমাদের বক্তব্য ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে, কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে নয়।’
মামুনুল হক বলেন, ‘কিছুদিন ধরে ঢাকার ধোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের ইস্যু নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে শান্তিপ্রিয় তৌহিদি জনতা। স্বাভাবিকভাবেই ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ কিংবা প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ অনৈসলামিক সংস্কৃতি হওয়ায় আলেমসমাজ এর প্রতিবাদ করছে।
সেই সূত্রে আমিও ভাস্কর্য তথা মূর্তি নির্মাণের বিরুদ্ধাচারণ করে আমার বক্তব্য তুলে ধরেছি। কিন্তু সুকৌশলে একটি মহল ভাস্কর্য নির্মাণের এই বিরোধিতাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরোধিতা বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য দ্ব্যর্থহীন।’