মণিজিঞ্জির সান্যাল : ঈশ্বর আছে মনের মন্দিরে। তাকে আলাদা করে খুঁজতে যাওয়াটা বোকামো। আসলে কোনো কিছুকে অবিশ্বাস করাটা সহজ, বিশ্বাস করাটাই কঠিন। ‘কিছু মানি না’ বলাটা সহজ, উল্টৌটাই কঠিন। চরম বিপদে প্রবল নাস্তিককেও দেখেছি ঈশ্বরের স্মরণাপন্ন হতে। কতো চিকিৎসকের মুখে শুনেছি ‘আমাদের হাতে আর কিছু নেই, একমাত্র ঈশ্বরই এখন ভরসা।’
আসলে আমরা ঈশ্বরকে খুঁজি নিজেকে সমর্পণ করতে। ঈশ্বর আমার কাছে একটা শক্তি, একটা আশ্রয়।
পুজো করলে মন ভাল থাকে, পুজো আমার কাছে একটা পবিত্র রূপ। বাড়িঘর পরিস্কার করলে মন ভাল থাকে। স্নান করে শুদ্ধ জামাকাপড় পরলে মন ভাল থাকে। এই যে পুজোর শেষে প্রণাম করি, বা পুজোর পর চুপ করে বসে থাকি, এই ধ্যানস্থ রূপকেই তো বলি মেডিটেশন।
চটি ,জুতো খুলে ঠাকুরের সামনে এই যে মাথা নীচু করে বা জোড় হাতে প্রণাম করি, এর ফলে আমরা বিনয়ী হতে শিখি। ঈশ্বরের নাম করে শপথ করি কতো কি।
স্বয়ং যীশু খ্রিস্ট মৃত্যুর আগে ঈশ্বরকে স্মরণ করে বলেছিলেন তার হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দিতে।
এই অস্থির মনকে শান্ত করতেই তো ঈশ্বরের সাধনা। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য মনটাকে অন্য কোথাও ব্যস্ত রাখা।
কবিগুরু বলেছেন-
‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি
বুঝতে নারি কখন্? তুমি দাও-যে ফাঁকি
ফুলের মালা দীপের আলো ধূপের ধোঁয়ার
পিছন হতে পাই নে সুযোগ চরণ-ছোঁয়ার,
স্তবের বাণীর আড়াল টানি তোমায় ঢাকি …’
আসলে আমাদের এই মন বড় চঞ্চল, বড় অস্থির। এই অস্থির মনটাকে স্থির রাখতেই আমরা পুজো করি। পুজো করার সময় মনটা স্থির হয়ে যায়, মনটা শান্ত হয়ে যায়। মন্ত্রের শুদ্ধ উচ্চারণ সত্যিই মনের মধ্যে একটা অনুরণন হয়। এই যে অনুরণন, এই যে ভেতর থেকে একটা সজীবতা, আত্মবিশ্বাস, তা থেকেই মানসিক ও শারীরিক শক্তির জোর পাই, এটাই তো ঈশ্বর। মনের শুদ্ধ আচরণের মধ্য দিয়ে পরিস্কার উপলব্ধি করা যায় ঈশ্বরের উপস্থিতি। মিথ্যে কথা না বলা, অন্যের ক্ষতি না করা এই যে অনুভব এই তো ঈশ্বর তাই না?
পুজোর পর সেই প্রসাদকে কেন্দ্র করে দুমুঠো ডাল ভাত কিছু অভুক্ত মানুষকে খাওয়ালে, তখন মনের মধ্যে যে শান্তি আসে, তার চেয়ে বড় পাওয়া আর কি থাকতে পারে। যে প্রতিদিন খেতে পায় তাকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর চেয়ে অসহায় নিরন্ন মানুষের সেবা মনকে অনেক অনেক শান্তি দেয়। এতে কোনো অহংকার আসে না, মনে হয় না সেবা করছি কাউকে, বরং মনটা আনন্দে ভরে যায়। মনে হয় ঈশ্বর যেন এই মানুষগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে কোথাও।
যে কোনো একটা পুজোকে উপলক্ষ করে কিছু অসহায় মানুষের হাতে একটা করে নতুন জামা, কিম্বা মিষ্টির প্যাকেট তুলে দিলেও তাদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
আসলে দিনের পর দিন ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের মাধ্যমে এই পজিটিভ ভাবনা গড়ে ওঠে, মনটাও পবিত্র হয়ে ওঠে দিনের পর দিন, তেমনি ঘরটাও হয়ে ওঠে পবিত্র আর সুন্দর। আর যা কিছু নেগেটিভ তার থেকে মনটা নিজে থেকেই দূরে সরে যায়।
আমি ঈশ্বরের পুজো দিতে কখনো মন্দিরে যাইনি। আমার ছোট্ট ঘরেই তাকে যতেœ রেখেছি। একই আসনে সবাই রয়েছে আমার ঘর জুড়ে।
আশ্বিনের এই শারদপ্রাতে ঈশ্বরের কাছে আবারও প্রার্থনা করি যা কিছু খারাপ তার থেকে দূরে রেখো, আর ভাল যা কিছু তার সবটুকু আমার মধ্যে আর আমার বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে দাও।
আর কবিগুরুর কথায় আমিও বলি …
“আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার
চরণ-ধূলার তলে…”
এই যে শরৎ কাল, এই যে আকাশে বাতাসে মেঘের খেলা, রোদের ঝিলিক। খুশির শরৎ, একটু হিমেল হাওয়া। পুজোর ভোরে ঢাকের আওয়াজ, মায়ের কাছে যাওয়া। চারপাশে খুশির আলো। বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ, আকাশে মেঘের ভেলা। মনটা কেমন ভাল হয়ে থাকে সবসময়। মা এসেছে ঘরে তাই মনটা আনন্দে ভরে থাকে।
ষষ্ঠীতে নতুন ছোয়া, সপ্তমীতে শিশিরে মাখা চারপাশ, অষ্টমীতে প্রাণভরে অঞ্জলি, আর নবমীতে আড্ডা শুধু আড্ডা। সবশেষে মিষ্টি মুখের পালা, দশমীতে তাই শুধুই মিষ্টিমুখ।
শিউলি ফুলের গন্ধ মাখা শরৎ আকাশখানি, কাশফুল আর ঘাসের দোলায় কার ঐ পদধ্বনি?
আসলে শরৎ এর আকাশ, শিউলি ফুলের গন্ধ, কাশের দোলা সাথে ঢাকের বাদ্যি সবমিলিয়ে পুজো পুজো গন্ধ আকাশে বাতাসে। মায়ের আগমনকে ঘিরে আবারও একটা বছর সবাই মেতে উঠি আনন্দে। নীল আকাশে মেঘের ভেলা, পদ্ম ফুলের পাপড়ি মেলা, ঢাকের তালে কাশের খেলা।
এতদিন যেটা দেখা যেতো না, গত কয়েক বছর ধরে সেটা চোখে পড়ছে? দুর্গাপুজোর মণ্ডপে নারী ঢাকি? ক্রমশই জনপ্রিয় হচ্ছে এই ঢাকিদের দল?
বেশ কিছু পুজোয় দেখা মিলেছে এক নতুন দৃশ্য যা আগে কল্পনাও করা যেত না। মহিলা ঢাকি! সঙ্গে একজন প্রবীণ এবং একজন যুবক থাকলেও, ঢাকের কাঠি যে ওই মেয়েদেরই হাতে, সেটা দেখেই বোঝা গেল? কথা বলতেও কোনো আপত্তি নেই? বরং বেশ সপ্রতিভ এবং হাসিখুশি? নদীয়া জেলার হরিনঘাটার বাসিন্দা আরতি রায়? কলকাতার পুজোয় ঢাক বাজাচ্ছেন গত দু বছর ধরে? আরতীর পরিবারই ঢাকি পরিবার?বাবা ঢাক বাজান, বড়দা ঢাক বাজান? তাঁরাই ওর শিক্ষাগুরু? কিন্তু হঠাৎ ঢাক বাজানোর ইচ্ছে হলো কেন? সন্ধ্যা কোনো রাখঢাক না করেই জানালেন, “নানান আর্থিক সমস্যা আছে, যে জন্যে এই লাইন বেছে নিয়েছি? দেখলাম পুজোর সময় মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাক বাজানো যাচ্ছে, আবার আনন্দও পাওয়া যাচ্ছে? মায়ের দর্শনও পাচ্ছি?”
ঢাক বাজাতে কলকাতায় যখন আসেন, তখন সংসার কে দেখেন? ছেলে-মেয়েরাই বা কোথায় থাকে? জানা গেল তাঁর দুই ছেলে এ সময়টায় তাঁর বাপের বাড়ি, অর্থাৎ ওদের মামারবাড়িতে থাকে? অর্থাৎ এমন একটা ধারণা করে নিলে হয়ত সম্পূর্ণ অমূলক হবে না যে, বাড়ির বউ ঢাক বাজাতে যায়, এতে স্বামী, বা শ্বশুরবাড়ির হয়ত মত নেই? বউ উপার্জন করে নিয়ে আসছে, সেটা হয়ত একটা সহায়ক বিষয়, যে কারণে সরাসরি বাধা দেওয়া হয় না? কিন্তু সমর্থনও থাকে না? যে অসুবিধের মুখে পড়তে হয়েছিল রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ঢাকি গোকুলচন্দ্র দাসকে? দক্ষিণ ২৪ পরগণার মছলন্দপুরের বাসিন্দা, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতিমান গোকুলচন্দ্রই আট বছর আগে প্রথম বাড়ির মেয়েদের পেশাদার ঢাকি হিসেবে তালিম দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন? এবং সেই কাহিনিও যথেষ্ট আগ্রহজনক? ঢাক বাজাতে অ্যামেরিকার লস এঞ্জেলেসে গিয়েছিলেন গোকুল? সেখানে এক বাদ্যযন্ত্রের দোকানে তিনি একটি মেয়েকে দেখেন, যে খদ্দেরদের শোনানোর জন্য একাধিক যন্ত্র বাজাতে পারে? সেই দেখেই গোকুলের মনে হয়েছিল, তা হলে দেশ-ঘরের মেয়েরাও কেন ঢাক বাজাতে পারবে না? দেশে ফেরার পর নিজের ভাইঝি, পূত্রবধূ এবং পড়শি আরো তিন মেয়েকে ঢাক বাজানোর তালিম দিতে শুরু করেন গোকুলচন্দ্র? সেই শুরু?
আর এখন কলকাতা শহরের একাধিক মঞ্চে চোখে পড়ছে এই নারী ঢাকিদের? এমন নয় যে পুরুষ ঢাকিদের পেশা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন ওঁরা? বরং পুরুষদের সঙ্গেই ওঁরা ঢাক বাজাচ্ছেন, যেটা সম্পূর্ণভাবে পুরুষশাসিত এক পেশার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য ঘটনা? তবে বিরোধিতাও যে আছে, সেটা বোঝা যায়? পুরুষ ঢাকিরা এখনো সহজ হতে পারেননি এই মেয়েদের উপস্থিতিতে? বরং ওঁদের একটু দূরত্বেই রাখেন পুরুষ ঢাকিরা? তবে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ঢাকিদের পেশাগত স্বীকৃতি হিসেবে ‘শিল্প কার্ড’ দেওয়া চালু হয়েছে, যেটা সরকারি সুযোগ-সুবিধা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজানোর ডাক পেতে সাহায্য করছে? সেটাও অবশ্য এখনো সুসংহত পদ্ধতিতে হচ্ছে না বলে অনুমান? আরতীর সঙ্গেই ঢাক বাজাতে এসেছেন নিরুপমা বিশ্বাস? তিনি যেমন জানালেন, অন্য জেলায় এই শিল্প কার্ডের বণ্টন নিয়মমাফিক হলেও তাঁদের নদীয়া জেলায় এখনো তাঁদের মতো অনেকেই সেই কার্ড পাননি? আবার উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় সমস্ত ঢাকিই কার্ড পেয়েছেন? যদিও নিরুপমা কেবল ঢাকই বাজান না, তিনি গানও গান? নিজেই জানালেন, ‘‘?আমি হরিনাম করি, পুষ্পমালা করি, মনসাযাত্রা করি? মনসাযাত্রায় বেহুলা লক্ষিন্দরের সিন করি?’’
নিরুপমা এবং আরতীর কথা থেকে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট হয়ে গেল, গ্রাম-মফস্বলের মেয়েরা এখন বিরাট সংখ্যায় উঠে আসছেন, যুক্ত হচ্ছেন দুর্গাপুজোর যে বৃহৎ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র, তার সঙ্গে? দেবী দুর্গার আরাধনার মধ্যে নারীশক্তির যে জাগৃতি-ভাবনা, বাস্তবে তা ক্রমশই সাকার হচ্ছে?
মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথা সাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ