সাজ্জাদ আলী : কাঠের বাক্সের মধ্যে চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। মুখের কাছে বাক্সের ডালাটা খোলা। মাথাটা একটু ডান দিকে কাত হয়ে আছে। আগেও বহুবার দেখেছি তাকে। তবে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখিনি কখনো। কী আশ্চর্য! তার ঘুম আর জেগে থাকার মধ্যে মুখশ্রী’র কোন তফাৎ নেই। ঘুমের মধ্যেও যেন হাসছেন। খুব চেনা সেই হাসিটি! পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছি, ডেকে তুলি। কিন্তু না, পরক্ষণেই মনে হলো এমন শান্তির ঘুম ভাঙ্গানোটা ঠিক হবে না।

ঘুমন্ত মানুষটি আমাদের প্রিয়ভাজন সাঈদ যাদিদ। টরন্টো শহরে কাছাকাছি থাকি আমরা। জ্যেষ্ঠ এই বন্ধুটির সাথে প্রায় এক যুগের চেনাজানা। তার সাথে প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটি খুব মনে পড়ছে আজ। তা দশ বারো বছর হবে। রবীন্দ্র গানের আয়োজন করেছি। অনুষ্ঠানের দুজন গায়কই তুখোড়, সত্যিই তারা ঠাকুরের গান ভাল গায়। ৭০/৮০ জনের মতো শ্রোতা, সেই সন্ধ্যায় সুরের মুর্চ্ছনায় ডুবে ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে শ্রোতাদের অনেকেই “চমৎকার একটি আয়োজনের জন্য” আমার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছিলেন।

রাত গভীর হচ্ছে, বাড়ি ফিরতে হবে। ফেরার পথে অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকাকে তার এপার্টমেন্টে নামিয়ে দেবো। গাড়িতে চড়েই সঞ্চালিকা বায়না ধরলেন যে তার কফির তেষ্টা পেয়েছে। তা শুধু কফি কেন? তার যে কোনো পিয়াস মেটাতে তো আমার আগ্রহের কোনো ঘাটতি হয়নি কখনো। সখি বলে কথা! কফি শপের দিকে এগুচ্ছি। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। দুহাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে আছি। হাত দিয়ে ফোন ধরবার জো নেই। অগত্যা ফোনালাপে গাড়ির ব্লু-টুথ স্পিকার ব্যবহার করতেই হলো। অর্থাৎ যা কিছু কথাবার্তা হবে সঞ্চালিকা তা শুনতে পাবেন। অপর প্রান্ত থেকে কেউ একজন বললেন, আমার নাম সাঈদ যাদিদ। মাত্রই আপনার অনুষ্ঠান দেখে বেরুলাম। আপনি কী এখন ব্যস্ত ? একটু কথা বলতে পারি কি?
জ্বী বলুন, আমি গাড়ি চালাচ্ছি, কিন্তু শুনতে বা বলতে অসুবিধা হবে না।

আজকের গায়ক গায়িকা দুজনই খুব ভাল গায়। টরন্টোতে যে এত সমৃদ্ধ গায়ক আছেন তা তো জানতামই না। বেশ পরিচ্ছন্ন আয়োজন আপনার। বিশেষ করে শ্রোতারা সবাই খুবই বোদ্ধা। বলে চলেছেন সাঈদ যাদিদ, ভাবলাম এমন আয়োজককে ধন্যবাদ বলাটা বাসী করা চলে না। সাজো সাজো বলা চাই। তাই এত রাতে ফোন করলাম।

খানিকটা বিরক্ত আমি। প্রশংসা করাটা যেন আমাদের একটা রুটিন ওয়ার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাল মাঝারি নীচু সব কাজকেই আমরা গড় পরতা ভাল বলি। এ যেন শুধু বলার জন্যই বলা। এমনতর প্রশংসা শুনতে এখন আর ভাল লাগে না। মনে হয় যেন গাদা গাদা মিথ্যা কথা কান দিয়ে ঢুকছে। যাদিদ সাহেবের কথাগুলো শুনে মনে মনে ভাবছিলাম যে আরো একজন স্তাবক জুটলো! কিন্তু না, অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, আপনার অনুষ্ঠান নিয়ে আমার একটি অবজারভেশন আছে। সেটা বলতেই আসলে ফোন করেছি। জানিনা আপনি সমালোচনা কতটা সহ্য করতে পারেন? বলবো কিনা তাই ভাবছি।

আমি বললাম, সত্য বলাটা আপনার সামাজিক দায়। সে সত্য আমরা কেউ নিতে না পারলেও তাতে আপনার বা সত্যের কিছু যায় আসে না। আপনি নিঃসংকোচে বলুন জনাব।
সাঈদ যাদিদ আমতা আমতা করছেন। না মানে বলছিলাম, বলবো কিনা ভাবছি, আজ থাক তবে, সাক্ষাতে আরেক দিন না হয় বলবো।
আমি বললাম, এত দ্বিধা কিসের? আপনি বলুন তো ভাই, অনুষ্ঠানের কোন বিষয়টা আপনার ভাল লাগেনি ? আপনার অনুযোগ সঙ্গত হলে পরবর্তী আয়োজনে সেই ত্রæটি আর থাকবে না, আপনাকে কথা দিচ্ছি।

যাদিদ সাহেব বললেন, সাহস যখন দিচ্ছেন বলেই ফেলি তবে। দেখুন, অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মঞ্চে বড্ড বেশি কথা বলে। তার জ্ঞানগর্ভ কথায় মনে হয় যেন শ্রোতারা সবাই তার ক্লাশের স্টুডেন্ট। এই টুকুই শুধু বলার ছিলো। আশাকরি আপনি ক্ষুন্ন হননি।
এক মুহুর্ত দেরি না করে আমি বললাম, জ্বী আমিও আপনার সাথে একমত। আপনি নিশ্চিত থাকুন, আগামী অনুষ্ঠানে সঞ্চালিকা একটি বাড়তি কথাও বলবে না। প্রয়োজনে সঞ্চালক বদল হবে, কিন্তু মঞ্চে অতিকথন থাকবে না।

সেই থেকে যাদিদ সাহেবের সাথে আমার গানের খাতির। “গানের খাতির” কথাটা বলায় পাঠক বন্ধুরা কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে আমরা দুজন একসাথে বসে গানবাজনা করি। জ্বী না, সে সাধ্যি আমাদের নেই। তিনি শ্রোতা, আমি আয়োজক। আসলে সাঈদ যাদিদ আমার আয়না। তার চোখ দিয়ে আমি কাজের ত্রুটিগুলো দেখি, আর মেদটুকু ঝেড়ে ফেলি।
এই তো মাসখানেক আগে রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে ফোন করলাম। যাদিদ সাহেব বললেন, যাবো, শরীরে কুলোলে নিশ্চয়ই যাবো। সে দিন ছিলো শনিবার। তো অনুষ্ঠানস্থলে আমি অপেক্ষায় আছি। অভ্যাগতরা একে একে আসছেন। কিন্তু সাঈদ যাদিদের দেখা নেই। খানিক বাদে ফোন করলাম, সাঈদ ভাই কতক্ষণে পৌঁছাবেন আপনি?
তিনি বললেন, মাত্রই হাসপাতাল থেকে ফিরলাম। শরীরে খুবই যন্ত্রণা হচ্ছে আজ। পেইন কিলারও কাজ করছে না। মনটা তো আপনার অনুষ্ঠানে পৌঁছে গেছে। কিন্তু দেহ যে আর চলে না ভাই। আর বোধ হয় কোনোদিন আপনার অনুষ্ঠানে যাওয়া হবে না।

এ সব আপনি কী বলছেন সাঈদ ভাই? আজ তবে আপনি বিশ্রাম নিন। পরবর্তী অনুষ্ঠানে নিশ্চয়ই আপনাকে পাবো। আমি তো ভেবে রেখেছিলাম সন্ধ্যায় দেখা হবে। তা তো আর হচ্ছে না আজ। দুএকটি বিষয়ে আপনার সাথে পরামর্শ করা দরকার। দেখা করতে কবে আসবো বলুন তো?
সামনে মঙ্গলবার দুপুরে আসুন, বলে ফোন রাখলেন সাঈদ যাদিদ।
আজ সেই মঙ্গলবার। কথা মতো দুপুরেই তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। দেখে এসেছি বটে, তবে কথা হয়নি। কেমনে কথা হবে? তিনি তো ঘুমিয়ে আছেন কফিনে!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)