সুব্রত নন্দী : খড়্গপুরের জমিদার বাড়িতে সুটিংয়ের স্পট ঠিক করে পরিচালক সুমন চৌধুরী ফোন করে জানালেন আপনার ‘দুর্গা বাড়ি’ ছবিটির জন্য ভাল আর কোন স্পট বাংলাদেশের অন্য কোথাও পাওয়া মুশকিল। পুরাতন স্থাপত্যের সঙ্গে বন জঙ্গল দিঘী নালা মিশে বাড়িটি এখনও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ঘন গাছ গাছালি ও পাখ পাখালির অপূর্ব এই নিসর্গ কোন ডেভলপারের বা ভূমি দস্যুদের বদ নজরে এখন পর্যন্ত পরেনি বলেই আমরা নাটক সিনেমার কাজ এখানে সারতে পারছি। তাছাড়া শত বছর আগে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর এই বাড়িতে প্রতি বছর ঘটা করে মহিশ বলি দিয়ে সাত দিন ধরে শারদীয় দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন, এজন্য এলাকার মানুষ এখনো এই জমিদার বাড়িকে দুর্গা বাড়ি বলেই চেনেন, আপনার লেখা চলচ্চিত্রের কাহিনীর সঙ্গে এই বাড়ির ইতিহাস একদম মিলে গেছে। এখন আপনি অনুমতি দিলে ছয় মাসের জন্য বাড়িটি ভাড়ার কন্ট্রাক্ট ফাইনাল করে ফেলতে পারি…।

চিত্র পরিচালক সুমন চৌধুরীর বেশ কিছু নাটকের সুটিংয়ের জন্য খড়্গপুরের এই জমিদার বাড়িতেই সেট ফেলা হয়েছিল। ইদানীং বেশ কয়েকটি সফল পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি বানিয়ে ফেলেছেন তিনি। ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন তাই কাহিনীতে ইতিহাসের ছোঁয়া না থাকলে ছবির কাহিনী তার মনের মত হয় না। আমি ইতিহাসের ছাত্র নই তবুও আমার প্রেমের গল্পের পটভূমিটা কেন যেন তার পছন্দ হয়েছিল জানি না। ছোট বেলার সেই ঘটনা প্রবাহ কাকতালীয় না অতিপ্রাকৃত ভৌতিক কিছুই বিশ্বাস করতে পারি না তবুও লিখতে হলো। ছবি নির্মাণের চর্চা যথেচ্ছা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র আন্দোলন করতে গিয়ে। স্বল্প দৈর্ঘ্যের কিছু ছবিও বানিয়েছিলাম।

মাঝে মাঝেই রাত গভীর হয়ে যেত টিএসসির পিছনে গোর্খা পল্লীর হাড়ি থেকে দোচোয়ানির নেশায় চুর হয়ে খিস্তি খেঁউর আর গালাগাল করে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেবার মধ্য দিয়ে। তখন নিজেকে মনে হতো যেন ঋত্বিক ঘটক হয়ে গেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে ঢাকাগামী শেষ রাতের ট্রেনের তীব্র হুইসেলে নেশা কেটে গেলে নেপালী গার্ড বাহাদুর কানের কাছে তার মুখ এনে ফিসফিস করে বলত…. আপ হুঁশ আ গিয়া বাবুসাব, তো চলেন আপনার হলের দিকে চলেন।
কতদিন বাহাদুরের কাঁধে ভর করে নেশায় চুর হয়ে হলে ফিরেছি আর বাহাদুরকে বলেছি… বাহাদুর তুমি ভুত প্রেত বিশ্বাস করো?, আমি কিন্তু করি না?
বাহাদুর খিক খিক করে হেসে বলত ….. বাবু ভুত জরুর আছে হা, আলবাত আছে, তারা হামার বাড়িতে রোজ আপনার মতো দারু খাইতে আসে তো। মহুয়ার নেশায় পাগল হয়ে নাচানাচি করে, গান বাজনা করে।
তাহলে তোর কথায় আমিও তো একটা ভুত কি বলিস?
বাহাদুর হা হা করে ওঠে..

… না না না… এসব কি বলছেন বাবু আপনি ইনসান, মানুষ, ভুতের পা জমিনের এক হাত উপরে থাকে। আপনি তো হামার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছেন এখন। আমি বাহাদুরকে বলি….
আসলে আমি নিজেই একটা ভৌতিক মানুষ, ভুতও বলতে পার। সেদিন গভীর রাতের নির্জনতার মধ্যে আমার এই কথায় বাহাদুর লাফ দিয়ে সরে গিয়ে বলেছিল-
…সত্যিই বলছেন বাবু? হ্যাঁ, সত্যিই বলছি আমি আসলে শালা কোন মানুষই না, আমি একটা লম্পট, বদমাইশ ভুতের বাচ্চা ভুত। আমি অনেক মানুষ খুন করেছি, অনেক মেয়েদের ধর্ষণ পর্যন্ত করেছি, কিন্তু ভুত বলে আজ পর্যন্ত কোন পুলিশ গোয়েন্দারা আমার টিকির দেখা তো দূরের কথা আমার ছায়ার দেখা পায়নি। সেদিন বাহাদুর আমার কথায় প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আমি তার ভয় দুর করার জন্য হো হো হো করে গগণ বিদারী হাসি দিয়ে বলছিলাম… আরে না আমি মানুষ বাহাদুর, আমি একটা অত্যন্ত ভাল মানুষ, আমি সমাজটা বদলে দিতে চাই, আমি গরীবের পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য সর্বহারা শোষিতের বিপ্লব চাই। সাম্রাজ্যবাদের অবসান চাই।

বাহাদুর আমার কথার আগামাথা কিছুই না বুঝে আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আমি রহস্য করে বলি বাহাদুর এই অন্ধকারের রাতে তোমার টর্চ লাইনটা একটু জ্বালিয়ে আমার পায়ের দিকে ধরে দেখ সেখানে মোট ক’টি আঙুল!
বাহাদুর তার টর্চ লাইটটা আমার পায়ের দিকে ধরে চিৎকার করে ‘ভুত’ বলে মাটিতে পরে যায়। তখন পূর্ব দিগন্ত ফর্সা হতে শুরু করেছে, পাশের গ্রামে মোরগের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। রেল লাইনের পাশের খাল থেকে জল এনে তার মুখে ছিটিয়ে দিলে সে নড়ে চড়ে উঠে আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ….না বাবু এ হামার চোখের ভুল হইছিলো বাবু, আপনি ইনসান আদমী আছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বোহেমিয়ান জীবনটা হঠাৎই কেমন যেন বদলে গেল আমার, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, সত্যজিতের কথাও ভুলে গেলাম, মদ তাড়ি গাঁজার মধ্যে শিল্প সাধনার ফ্যান্টাসিটাও কেটে গেল অত্যন্ত বেমানান ভাবে। সাগরের বিশাল এক ঢেউ এসে যেমন করে তীরের সব কিছুই ধুয়ে দিয়ে যায় তেমন করেই আমার সব কিছুই এক দিন ধুয়ে মুছে গেল। সাপের মতো খোলশ বদলে আমি সম্পূর্ণ অন্যরকম এক মানুষ হয়ে গেলাম। ভারতের দিল্লীতে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যুক্তরাষ্ট্রের মেয়ে সুজানার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। হাভার্ডের ছাত্রী, নিউ জার্সিতে বাবার বিশাল গৃহ নির্মাণের ব্যবসা অথচ সুজানার এই সব অর্থ বিত্তে চরম অনীহা, পৃথিবী ঘুরে ঘুরে ডকুমেন্টারি নির্মাণ করার জন্যই যেন সুজানার জন্ম হয়েছিল। গ্রাণ্ড হোটেলে আমার তৈরি ছবিটির প্রিমিয়ার দেখে সুজানা আমার প্রেমে পড়ে যায়। তারপর একদিন সুজানার সঙ্গে আমি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে উড়াল দেই। গত চল্লিশ বছরে আমি শুধু অর্থ বিত্তে তাল গাছের মতো আকাশের দিকে ধাবিত হয়েছি। না এরপর আর কোন ছবি আমি তৈরি করিনি, কোন বই পড়ে দেখেনি,রাজ কন্যা সুজানার রাজমহল আমার হয়েছে, শশুরের রিয়েল এস্টেট, হোটেল, নাইট ক্লাব ব্যবসা আমার হস্তগত হয়েছে অথচ যে সুজানার জন্য আমি এই বিশাল রাজত্বের অধীশ্বর সেই সুজানা আরেকজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতার সঙ্গে হলিউডে ঘর বেঁধেছে। সুজানা আমার পিছু ছাড়লেও খরগপুরের বাসন্তী আমার পিছু ছাড়েনি, সে মাঝে মাঝেই স্বপ্নের ঘোরে আমার কাছে হাজির হয়ে আমার হাত ধরে খরগপুরে জমিদার বাড়ির বিশাল আঙ্গিনায় আমাকে নিয়ে যায়। অথচ এই বাসন্তি আমার বালক বেলার বাসন্তির মতো নয়। আমার বাসন্তি ছিলেন ধবধবে ফর্সা, দুর্গা দেবীর মতো আয়ত চোখ ও ক্ষীন কটি ও স্থুল নিতম্বের বাসন্তি। আমাদের খরগপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নিবারণ সাহার মেয়ে। খুবই ছোট বেলায় কাক ভোরে ঘুম থেকে উঠেই পুজার ফুলের সাজি নিয়ে দৌড়ে যেতাম স্কুলের সেই বিশাল শিউলি তলায়। এতবড় শিউলি গাছ আমি জীবনে আর কখনও দেখিনি। আশ্বিন কার্তিক মাসে ফুলের ভারে তার ডাল নুয়ে পরত মাটির কাছাকাছি। তার পাশেই দুটি বিশাল গাব গাছের নিবিড় ঘন পাতায় ওখানে একটা ভুতরে পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। সেখানে খুব ভোরের বাতাসের হাওয়ার মধ্যে একটা চমৎকার পবিত্রতার গন্ধ ছিল। ঝরে পড়া শিউলি ফুলের সাদা চাদরে তখন ঢেকে থাকত স্কুলের শিউলি তলা। হাফ প্যান্ট ও ফ্রক পরে টুক টুক করে ফুল কুড়িয়ে ফুলের সাজি নিমিষেই ভরে ফেলত বাসন্তি। আমি ওর পাশে হাটু গেড়ে বসে ফুল কুড়িয়ে তার চুলের গন্ধ নেই। খোলা উরুর সৌন্দর্য্য দেখি। তারপর শিউলি তলা থেকে ছাত্রাবাসের টগর গন্ধরাজের বাগানে প্রাচীর টপকিয়ে ঢুকতে গিয়ে দুজনের ছোঁয়াছুঁয?ির একটা অনুভব, ভাললাগা ভালবাসা তারপর প্রতিবছর পুরানো জমিদার বাড়ির শারদীয় দুর্গাপুজোর মণ্ডপে বাসন্তি ও আমার মধ্যে একটু একটু করে কি জানি কি হয়ে গেল। নিবারণ স্যার আমাদের পদার্থ বিজ্ঞান ও কেমিস্ট্রি পড়াতেন। তখন বাসন্তী আমার মত বেশ বড় হয়েছে কিন্তু ছোট বেলার সেই দেব কন্যার মত চেহারার কোন পরিবর্তন হয়নি। অনেকেই তার রূপের পাগল। কিন্ত দুর্গাপুজোর সেই আরতি অনুষ্ঠানে সে শুধু আমার দিকেই তাকিয়ে থাকে। বাসন্তির বাবা নিবারণ স্যার জানতেন বাসন্তি ও আমার ভেতরের সম্পর্কের রসায়ন। এসএসসিতে মেধা তালিকায় নাম রেখে স্কুলের গণ্ডি পাড় হবার পর স্বভাবতই আমাকে ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে হল। বাসন্তি ভর্তি হল হলি ক্রসে। ঢাকায় তখন আমার খুব নাম ডাক। কলেজে লেখা পড়ার জন্য নয়, টেলিভিশনে বিতর্ক টিমের প্রধান হিসেবে, নাটক মঞ্চস্থ করা, কবি সাহিত্যিকদের সাথে ওঠাবসা, নিউ মার্কেটের মল্লিক ব্রাদার্স বইয়ের দোকানের চত্বরে আড্ডার মধ্যেমনি আর বাসন্তির সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করা এক যুবকের নাম শোভন মজুমদার।

আমার জীবনে বাসন্তি আছে তবু শত বাসন্তি আমার পিছু লেগে থাকে। খ্যাতিমান হিসেবে আমার মধ্যে তখন অহংকার ঢুকে পরেছে, আস্তে আস্তে আমার আঁতেল প্রতিকৃতি প্রতিষ্ঠিত করতে আমি গাঁজা মদ সবই ধরলাম। মেয়েবাজিতেও হাত পাকালাম। বাসন্তিকে তখন আমার কাছে সেকেলে গেঁয়ো মনে হতে লাগল। সকাল বিকেলে ক্লাশ ফেলে টিভি রেডিওতে সময় দেই আড্ডা আড্ডায় সময় চলে যায়।

একদিন দুপুরে বাসন্তির কাছে আমার লাম্পট্যের মুখোশটা খুলে গেল। সেদিন বাসন্তি আমার হলে এসে দরজায় টোকা দিতে দিচ্ছিল, তখন টেলিভিশনের এক জনপ্রিয় সিরিয়ালের অভিনেত্রী আমার মত আঠারো বছরের যুবকের সঙ্গে গোপন সম্পর্কে মেতে উঠেছেন। ভেবেছিলাম হলের দারোয়ান এসেছে, কিছু না বুঝেই দরজা খুলে দিতেই বাসন্তিকে দেখে আমি যেন তড়িতাহত হলাম। সেদিন বিস্ফোরিত কন্ঠে বাসন্তি শুধু বলেছিল ….ছিঃ শোভন। সেটাই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।

বাসন্তি আত্মহত্যা করেছিল। হলিক্রসের মেয়েদের ছাত্রী নিবাসে সিলিং ফ্যানে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে পরেছিল। না, কোন সুইসাইড নোট সে রেখে যায়নি। কিছুদিন পর পরই পুলিশ এসে প্রেমিক হিসেবে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করত, কিন্তু সেই সুন্দরী অভিনেত্রী টাকা খরচ করে উকিল নিয়োগ দিয়ে আমাকে সন্দেহের তালিকা থেকে মুক্ত করেছিলেন। আমার এইচএসসি’র রেজাল্ট এস এস সি’র মতো ভাল হয়নি। সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে ময়মনসিংহে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেলাম। গ্রাজুয়েশন শেষ হবার আগেই সুজানার সঙ্গে পরিচয়, তারপর যুক্তরাষ্ট্রে।

বাসন্তিকে নিয়ে যে অতি প্রাকৃত ঘটনাটি আমার জীবনে ঘটেছিল সেই ঘটনাকালটিও বাসন্তির মৃত্যুর ত্রিশ বছর পর। এই ত্রিশ বছর আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কখনও বাংলাদেশে ফিরিনি। আমার বাবার বাকি চার সন্তানের সবাই এর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক হিসেবে নাম করেছেন। আমার মতো নষ্ট হয়ে যাওয়া ছেলের জন্য তার কোন আক্ষেপ ছিল না। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কখনোই আমার খোঁজ নেননি। আমার মা পুত্র বিচ্ছেদের শোক সামলাতে না পেরে অনেক আগেই মৃত্যু বরণ করেন। বাবাও মারা গেছেন তার পাঁচ বছর পর। বাবার মৃত্যুর পর বাংলাদেশে ফিরেছিলাম একবার। ঢাকা থেকে খড়্গপুরের বাড়িতে যাওয়ার জন্য একটি পাজেরো ভাড়া করেছি। সেদিন বৃষ্টিস্নাত বিকেলে রওনা দিলাম নগরবাড়ি ঘাটের দিকে, গাড়ি ফেরিতে ওঠার পর শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়। ওপারে পৌঁছলাম রাত দুটোর দিকে। আর কুড়ি মাইল গেলেই খরগপুর। চট্টগ্রামের ড্রাইভার উত্তর জনপদের কিছুই চেনে না। গত বিশ বছরে রাস্তা ঘাট অনেকটাই বদলে গেছে, আমিও কিছুই চিনতে পারছিলাম না। ঝড়ের পর বৃষ্টির জলে কাদা প্যাক প্যাক গ্রামের রাস্তায় গাড়ির চাকা বসে যাচ্ছিল কিছুক্ষণ পর পর। বিদ্যুতবিহীন ঘুরঘুটে অন্ধকার রাস্তায় কিছুই দেখা যায় না খরগপুর না কোথায় এসে পৌঁছলাম। হঠাৎই গাড়ির চাকা কাদার মধ্যে স্থায়ীভাবে বসে গেল। ড্রাইভার হেড লাইটের আলোতে সামনেই একটি পুরানো বাড়ি দেখে সেখানে গেল। ফিরে এসে বলল স্যার ভেতরে লোকজনের শব্দ পাইলাম আসেন এখানে গিয়া আশ্রয় নেই। লোকজন পাইলে ঠ্যালা দিয়া গাড়ি উঠাইয়া নিমু। তাছাড়া আপনার বাথরুমের দরকার আছে বলেছিলেন।

ড্রাইভারকে গাড়িতে রেখে ছাতা ধরে বাড়ির দিকে এগোতে দেখি এটা খরগপুরের সেই জমিদারের পোড়ো বাড়ি। পাশেই দুর্গাপুজোর ভাঙ্গা ধ্বসে যাওয়া মণ্ডপের চিহ্ন আছে, বৃষ্টির সঙ্গে বিদ্যুত চমকানোর আলোতে সব পরিস্কার হয়ে উঠেছে। বৃষ্টির জল পেয়ে ব্যঙ ডাকছে, ঝিঁ ঝিঁ পোকারা সরব হয়েছে রাতের নিস্তব্ধতায় একটা সুরের ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। জমিদারের মৃত্যুর পরেও এলাকার হিন্দুরা বারোয়ারী মণ্ডপ হিসেবে এই মন্দিরের মধ্যে শারদীয় দুর্গাপুজোর আয়োজন করত। এই মণ্ডপের পুজোর ফুলের সংগ্রহের দায়িত্ব ছিল আমার আর বাসন্তির।

বাড়ির ভেতরে অস্পষ্ট আলোর আভাস পেলাম। পরিচিত কারো কন্ঠ অথচ জড়ানো, কিছুই বোঝা যায় না। দরজায় টোকা দিতেই কে একজন তরুণী স্পষ্ট করে বলল…. “কে, শোভন দা”। এতদিন পর?

আমি এই রহস্যময়তায় ভয় পেয়ে গেলাম। এরপর ক্ষণিকের নিস্তব্ধতা। আমি আবার দরজায় টোকা দিলাম। কর্কশ করকর শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। দেখলাম বাসন্তি একটি হারিকেন হাতে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে খিল খিল করে হাসছে!!!, কি অদ্ভুত বাসন্তি তো অনেক আগেই মরে গেছে। আর বেঁচে থাকলেও এতদিনে আমার মতো তারও ষাট বছরের বৃদ্ধ হবার কথা। এই অষ্টাদশী বাসন্তি তবে কোথা থেকে এলো! আমি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পরে গেলাম।

অনেকক্ষণ আমি ফিরে না আসায় ড্রাইভার আমাকে নিতে এসে দরজার সামনে আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় আবিষ্কার করে। এই ঘটনার কথা আমি আমার ভাই বোন কাউকেই বলিনি। যুক্তরাষ্ট্র ফিরে যাবার পর আমি আবারও বদলে গেলাম। এরপর বাসন্তি কোন স্বপ্নের ঘোরে আমার সামনে আর উপস্থিত হয়নি। আমি আমার ব্যক্তিগত ব্যবসা বানিজ্য সব সুজানার দুই ছেলেদের নামে উইল করে দিয়ে বৃদ্ধ নিবাসে গিয?ি আশ্রয় নিলাম। লেখালেখির মধ্যেই আমাকে ফিরে পেলাম। আমার অটো বায়োগ্রাফি লিখতে গিয়েই পরিচালক সুমণ চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয়। আমার চলচ্চিত্রের কাহিনী দুর্গাবাড়ির বাসন্তি। সুমন চৌধুরীকে বলেছিলাম টাকা পয়সা নিয়ে ভাববেন না। আমি বিয়াল্লিশ বছর আগের একটি আবহতে সম্পূর্ণ একটি জমিদার বাড়িতেই ছবিটির সেট নির্মাণ করতে চাই। সুমন যখন আমাকে ফোন করেছিল যেখানে সে সেট ফেলেছেন এমন একটি জমিদার বাড়িতে যে এলাকার নামটিও খড়গপুর, ঢাকার সন্নিকটে শ্রীপুরে। আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টে আসবার পর ভিআইপি লাউঞ্জে সুমন তার কলাকুশলীদের নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষারত ছিলেন। আমাকে ফুলের তোড়ায় সম্ভাষণ জানিয়ে সে ছবির প্রধান চরিত্র শোভন ও বাসন্তির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। এদের একজনের সঙ্গে পূর্বেই আমার জানাশোনা ছিল। সেই রাতটা শেরাটনে কাটিয়ে আমি পরের দিনই গাজীপুরের শ্রীপুরের জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। তর সইছিলনা আমার। পড়ন্ত বিকেলের আলোতে জমিদার বাড়ির সামনে আমাদের ল্যাণ্ড রোভারটি দাঁড়ানোর পর আমাদের সম্ভাষণ জানাতে এগিয়ে এলেন বাড়ির একমাত্র মালিক কাম কেয়ার টেকার টমি চৌধুরী। এরা স্থানীয় জোতদার হিসেবে একাত্তরের পর এনিমি প্রোপার্টি হিসেবে সস্তায় বাড়িটি কিনে নেন। টমি নিজেও দীর্ঘদিন ধরে কানাডাতে বসবাস করে শেষ বয়সে দেশে ফিরে এই বাড়িতেই থাকেন। ভেতরে একটি মিউজিয়াম করেছেন জমিদার রাজ নারায়নের নামে, সেখানে জমিদারের অনেক পুরানো নিদর্শন রেখেছেন, কানাডার আদিবাসীদের কিছু বাদ্যযন্ত্র শিকার ধরার অস্ত্র, পশু পাখির কঙ্কাল রেখেছেন।

এলাকার ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি তার টান আছে। তাই রাজ নারায়ণের বাড়ির মালিক হলেও তাকে তিনি অনেকের মত মুছে ফেলেননি। চমৎকার ইংরেজি বাংলায় কথা বলেন ভদ্রলোক। অল্প সময়ের মধ্যেই দুই বৃদ্ধের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। জানালেন আজকের রাতের খাবার নিজের হাতে রেঁধেছেন। আমি কি খেতে পছন্দ করি সেটা সুমন চৌধুরীর কাছে জেনে নিয়ে লোক পাঠিয়ে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন গুলশান থেকে। লক্ষ্য করলাম টমি চৌধুরী পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও রীতিনীতি এই ঘোর পল্লীতেও চালু রেখেছেন। টমি কথায় কথায় জানালেন জমিদার রাজ নারায়ণের বাড়িতে দুর্গা পুজোর রীতি ছিল। আমি আজও সেটা বদলাইনি। একজন মুসলমান নাস্তিক হলেও আমি এই পুজোর আয়োজনটা উৎসব হিসেবে নিজ খরচায় এখানে প্রতি বছরই করি। শারদীয় দুর্গাপুজোর মেলা বসে সেখানে যাত্রাপালার আয়োজন করি, বিদেশী দূতাবাসের লোকজন আসেন, রাত্রি যাপন করেন, বাউল গান শোনেন। অবশ্য এতে আমার আর্থিক একটা লাভ হয়, সিনেমার স্পটের জন্য পশ্চিমবঙ্গের পরিচালকরা পর্যন্ত ছুঁটে আসেন, ভাল পয়সা দিয়ে ছবির সুটিংয়ের কাজ করেন। ব্যাবসা হিসেবে এই বাড়িটি আমাকে প্রতিদিন সোনার ডিম দিয়ে যাচ্ছে। এসব বলে টমি চৌধুরী হো হো করে হেসে ওঠেন। আমি অদ্ভুত সুন্দর এই মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকি।

সুমন বললেন চলেন শোভন দা ছাদে যাই। আপনার ভাল লাগবে। পূর্ণ জোৎস্নার রাত, যেন আকাশ থেকে দুগ্ধ ধবল রাশি রাশি আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে প্রকৃতি। জমিদার বাড়ির দুই বিশাল পুকুরের মধ্যে চাঁদের প্রতিবিম্ব যেন বাসন্তির শরীরের মতোই আমার কাছে পবিত্র মনে হচ্ছিল। দেখলাম টমি চৌধুরী ডিনারের আগে আমাদের জন্য পানাহারের ব্যবস্থা করেছেন। সেখানে বøæ লেভেল স্কচ আছে, গ্রে গুসের মতো দামি ভদকা আছে। বললেন আমি ভাল ব্লাডি মেরীর রেসিপি জানি, একবার খেলে এই টমিকে সারাজীবন আপনি মনে রাখবেন।

পানাহারের পর টমি চৌধুরীর রান্নায় ডিনারটা বেশ জমে উঠেছিল। খাবারের পর সবাই চলে গেলে টমিকে আমি একটা প্রশ্ন করলাম… আপনার যাদুঘরের পার্শ্বে একটি গোপন কুটরী আছে দেখলাম। সেখানে এক রুগ্ন বৃদ্ধাকে এক পলক আমার চোখে পড়েছিল। উনি কে?
টমি চৌধুরী আমার কথায় প্রথমে অস্বস্তিকর অবস্থায় পরে গেলেন। কিছুটা সময় নিরবতার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন.. ওর নাম বাসন্তি ,জমিদার রাজ নারায়ণের প্রোপুত্রী। জমিদারী প্রথা উঠে গেলেও রাজ নারায়ণের একমাত্র নাতি রুপ নারায়ণ এই বাড়িতেই থাকতেন। বাসন্তি তার একমাত্র মেয়ে। এলাকার এক লম্পট ডাক্তারের সঙ্গে তার হৃদয় ঘটিত ব্যাপার ছিল। ডাক্তার প্রতারণা করে অন্য এক মেয়েকে নিয়ে কানাডা চলে যায় এরপর থেকে বাসন্তি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পরেন। অনেকদিন পর আমি খোঁজ নিয়ে বাসন্তিকে কাশী থেকে উদ্ধার করে এখানে এনে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করি। এতে আমার পূর্ব পুরুষদের পাপের কিছু লাঘব তো হল কি বলেন? আমি তখন ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছি। রাত গভীর, জানি বাসন্তি এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। তবুও বললাম বাসন্তিকে ভাল করে একটু দেখা যাবে?

টমি চৌধুরী বললেন ইনসোমিয়ার রোগী। সারারাত জেগেই থাকে। তবে লোকজন দেখলেই উত্তেজিত হয়ে ভুল বকেন। এতে ভয় পাবেন না, চলেন আপনাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি। লোকজন পছন্দ করেন না তাই তার এই গোপন নিবাসের ব্যবস্থা।
টমি বাসন্তির দরজায় এসে টোকা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। আমি টমি চৌধুরীর পিছনে অথচ বৃদ্ধা এক অষ্টাদশীর কণ্ঠে মিষ্টি করে ডাকলেন….আসেন শোভন দা, বসেন, আমি আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম।
টমি চাপা কন্ঠে বলেন… আপনি কি ডাক্তার শোভন?
সুব্রত নন্দী ঃ লেখক, টরন্টো, কানাডা