বনানী বাবলি : আমার সেই ছোটবেলাতে মনে মনে একটা প্রশ্ন ছিলো নিজের কাছেই এবং সেই কিশোর বয়সের প্রশ্নটা ছিলো কবি নজরুলের মাতাপিতা বা বয়োজোষ্ঠরা কেনো “দুখু” নামে তাঁকে ডাকতেন! দুখু মিঞার জন্ম হয় কঠিন এক জীবন প্রবাহের মাধ্যমে। মাত্র নয় বছর বয়সে পিতৃহারা হয়ে পরিবারের আর্থিক কষ্ট তাঁকে সেই ছোটবেলা থেকেই বাস্তব জীবনের ঘাত প্রতিঘাতের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল। এরপর মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকার প্রয়োজনে ঘরের বাইরের পৃথিবীতে পা রাখতে হয়। কিন্তু বাস্তবের নির্মম আঘাত তাঁকে থামিয়ে রাখতে পারে নাই সৃজনশীলতার থেকে। তিনি সৃষ্টি করেন অসামান্য সব আগুনঝরা বার্তার কবিতা এবং পাশাপাশি মিষ্টি ছড়া শিশুদের জন্য। প্রথম ধরা যাক লিচু চোরের সেই দস্যিপনার কাহিনী

“বাবুদের তাল-পুকুরে হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া?”
জীবনে যাঁর হাসির চেয়েও দুঃখের নদী ছিলো বহমান তবুও তিনি মুখে হাসি ফুটিয়েছেন ছড়াটির মাধ্যমে শিশুদের মাঝে? এই ছড়া শৈশবে অনেকের স্মৃতি হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। গ্রামের বাড়িতে গ্রীষ্মের ফল কিংবা ফুল চুরি করতে গিয়ে কত হেনস্থা হতে হয়েছে কত শিশু কিশোরকে বাগানের মালি বা মালিকের থেকে সেটা মনে হলেই ছড়াটি চোখের সামনে মনের আয়নায় উঁকি দেয় বুঝি গোপনে। কিংবা ধরা যাক মজার ছড়া “খাঁদু দাদু” – যে ছড়াটি কিশোর বয়সে অনায়াসে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অদৃশ্য অস্ত্র-
“অ মা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং? খ্যাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা নাক ডেঙাডেঙ ড্যাং।”

অথবা ভুলি কী করে সেই মিষ্টি ছড়া “খুকি ও কাঠবিড়ালী”? যে ছড়ার তৃতীয় ও চতুর্থ পঙক্তিতে অনায়াসে ব্যবহার করেছেন “রাঙা দিদি” “বৌদি” “ছোড়দি” “ভগবান” “এ রাম!” এই শব্দগুলি। কারণ তিনি জেনেছিলেন ‘দিদি’ আর ‘আপার’ মাঝে কোনো তফাৎ নেই, ‘ভগবান’ আর ‘আল্লাহ’ সমার্থক শব্দ, ‘বৌদি’ আর ‘ভাবি’ ডাকে একই মিষ্টি সুরের প্রতিধ্বনি হয় (প্রসঙ্গত আজ বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে এই ছড়ার অস্তিত্ব আর আছে কীনা আমার জানা নেই। এরপর বিদ্যালয়ের ঠিক কোন শ্রেণীতে মনে নেই আজ কবি নজরুলের সেই মনকাড়া “খোকার সাধ” ছড়ার সাথে আমাদের কবে পরিচয়-

“আমি হবো সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম-বাগে উঠবো আমি ডাকি? সূর্য্যি মামা জাগার আগে উঠবো আমি জেগে, ‘হয়নি সকাল, ঘুমোও এখন’, মা বলবেন রেগে।”
সেই অনুপ্রেরণামূলক ছড়া ও বইটির ছবির সাথে একাত্মতা অনুভব করতাম আর তড়িতে সকালে বিছানা থেকে উঠে যেতাম কী ভেবে কে জানে। ছড়ার সেই খোকার মতো আমরাও হয়তো ভাবতাম “সূর্য্যি মামা জাগার আগে উঠবো আমি জেগে”। ছোটবেলায় গার্লস গাইডে অনেক উদ্দীপনামূলক কবিতার একটি ছিলো চল চল চল সাথে ছিলো বিশাল ড্রামের ড্রিম ড্রিম বিটের ধ্বনি। ছোটদের উদ্দীপ্ত করার জন্য অসাধারণ সেই কথামালা আর তার ছন্দ-

“চল চল চল
….
ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত আমরা আনিব রাঙা প্রভাত, আমরা টুটাব তিমির রাত বাধার বিন্ধ্যাচল”

আমাদের দুখু মিঞা মক্তব থেকে কবরের সেবক কিংবা রুটির দোকানের কাজ তারপর লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লেটো (বাংলার একটি অঞ্চলের গান, কবিতা, নৃত্যের মিশ্রণে ভ্রাম্যমাণ দল) দলে যোগ দেন। এই লেটো দলে এসে তিনি দেখতে পেলেন মানুষের বিচিত্রজীবন কিন্তু গান কবিতায় বেঁচে থাকার লড়াই। দেখতে পেলেন সাম্যবাদ, দেখতে পেলেন মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। নজরুল বিশেষজ্ঞদের মতে এই লেটো দলেই মূলত তাঁর সাহিত্য চর্চার প্রথম যাত্রা শুরু এবং কবিতা লিখতেন এই লেটো দলের জন্য। তিনি বাংলা, সংস্কৃত সাহিত্য, পুরান, হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করেন এই লেটো দলে এসে এবং এই সময় রচনা করেন লোকসংগীত, শ্যামা সংগীত? মক্তবে পড়াশুনা করেও বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে এসে তিনি বড়ো হয়েছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার কান্ডারী হয়ে এবং প্রশ্ন করেন মানুষের দরবারে তাঁর বিখ্যাত “কান্ডারী হুশিয়ার” কবিতায়-

“অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ? হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার দেশের মানুষকে এমন স্পষ্ট ভাষায়, সাহসের সাথে কে আর প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে নজরুল ছাড়া? সেনা বাহিনীতে যোগ দিয়েও পড়াশুনা করে গেছেন নিভৃতে। শিখেছিলেন ফারসি ভাষা, নানারকম বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার এবং করে গেছেন সাহিত্য ও সংগীতের চর্চা? আর সমাজে মানুষে মানুষে ব্যবধানের চিত্র তাঁকে অশ্রæজলে বুঝতে দেওয়া হয়েছিল। আকুলকণ্ঠে সাম্যবাদের কথা বলতে চেয়েছিলেন। তিনি সৃষ্টি করেছিলেন “কুলি মজুর” কবিতা-

“দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে
ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?”
কিংবা ক্ষুধার কষ্ট যে কী সেটা শিশুকাল থেকেই হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন এবং সমাজে দেখেছিলেন অসহায় ক্ষুধান্বিত শিশুর কান্না তাই “আমার কৈফিয়ৎ” কবিতার ১১ নং স্তবকে তিনি প্রকাশ করেছিলেন-

“ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দু’টো ভাত, একটু নুন, বেলা ব’য়ে যায়, খায় নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন। কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছ কি? কালি ও চুন কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?

তিনি জেলেও গিয়েছিলেন তাঁর “আনন্দময়ীর আগমনে” কবিতার জন্য এবং এই কবিতা ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল ১৯২২ সালে (সাথে প্রকাশকও হন গ্রেফতার)। কবিতায় প্রকাশ হয়েছিল তাঁর বজ্রকঠিন স্বরের ঝংকারে ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি এবং যেটা ছিলো বিদ্রোহাত্মক। কারাগারে থেকে সৃষ্টি করেন “রাজবন্দীর জবানবন্দি”। তিনি যখন আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি তখন রবি ঠাকুর তাঁর “বসন্ত” গীতিনাট্য কবি নজরুলকে উৎসর্গ করেন (এই উৎসর্গের কারণে রবিকে তথাকথিত সাহিত্যিক সমাজের কাছে সমালোচিত হতে হয়)। রবির থেকে এই প্রাপ্তিতে উল্লসিত হয়ে নজরুল সৃষ্টি করেন সেই অমর কবিতা “আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগ বগিয়ে খুন হাসে” (পরবর্তীতে নজরুল তাঁর ইসলামের কাব্য সংকলন “সঞ্চিতা” গ্রন্থটি রবিকে উৎসর্গ করেন।)। অতঃপর বহরমপুর জেলে লিখেন “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া।” তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলেন তাঁর “বিদ্রোহী” কবিতায়-

“বল বীর
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি,
নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!”
কবি নজরুল অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁর বিদ্রোহ আর তেজ কবিতায় ছড়িয়ে যায় এবং লিখেছিলেন ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রকে দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে সেই আগুনঝরা অনুপম কাব্যগ্রন্থ “ভাঙার গান” যেখানে ছিলো তাঁর বন্দিশালা ভাঙার আহ্বান বন্দি বিপ্লবীদের কাছে-
“কারার ওই লৌহ-কপাট,
ভেঙে ফেল, কররে লোপাট,
রক্ত জমাট, শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান,
বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ!
ধ্বংস-নিশান, উড়ুক প্রাচীর, প্রাচীর ভেদি”

আজ মনে হয় দুখু মিঞা নামটি ছিলো সার্থক নজরুলের। মানুষের দুঃখে তাঁর অন্তর কেঁপেছিল সেই শিশুবেলা থেকে নিষ্ঠুর বাস্তবতার কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন যেমন বিদ্রোহী কবি নজরুল ঠিক তেমনি মানবতার কবি নজরুল। ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর খড়গহস্ত, ঔপনিবেশিকতার বঞ্চনার প্রতিবাদ, মানুষের সমান অধিকারের জন্য উচ্চস্বরে বেজে উঠতো তাঁর সাহিত্যসম্ভারে, রক্ত জমাট করা কবিতার মাঝে। আজও এই শতাব্দীতে তাঁর রচনা এই দুই বাংলায় প্রেরণা দিয়ে যায়, দোলা দিয়ে যায় পাঠকের হৃদয়ে, আর এই দুঃখী-বিদ্রোহী কবির মায়াবী গভীর কাজলকালো চোখের ভাষা মানুষের প্রতি ভালোবাসার কথা নিঃশব্দে উচ্চারিত হয়।