ভজন সরকার : যদি ভাবেন বাংলাদেশ জুড়ে যে সা¤প্রদায়িক তান্ডব তা হঠাৎ করেই উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, তা হ’লে ভুল করবেন।এর পেছনে এক নাটকীয় বেদনাদায়ক ইতিহাস আছে। দ্বিজাতিতত্তে¡র উপর ব্রিটিশ ভারত ভাগ হলো। অঙ্কের গণনায় মানুষকে ভাগ করা হলো। মানবিকতাকে দ্বিখন্ডিত করা হলো। অলীক – অবাস্তব অন্ধবিশ্বাসের নাম ধর্ম বিশ্বাস। সেই ধর্ম বিশ্বাসই ভারত ভাগের মূল সূত্র। অথচ কেউ ভাবলেন না, ধর্ম বিশ্বাস একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাস। একেবারেই অন্তর্গত চিন্তাচেতনার স্তর। সেই ব্যক্তিগত ব্যাপারেই রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করলো। মানুষ গৌণ হলো। মূখ্য হলো রাজনীতি। লক্ষ্য হলো ভোট ব্যাঙ্ক। রাষ্ট্রের ইচ্ছেতেই সব হয় না, হয়নি কখনোই। তাই দ্বিজাতিতত্তে¡র ক‚টচালও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলো না। যারা দ্বিজাতিতত্তে¡র শিখন্ডী ,সেই সব বাস্তুচ্যূত হিন্দু-মুসলমান প্রাণে মারা গেল প্রায় ১০ লক্ষ; কয়েক কোটির স্থান হলো অন্যদেশে।

এতো সব সত্তে¡ও হিন্দুর ভারতে মুসলমান রয়ে গেলো; মুসলমানের পাকিস্তানেও রয়ে গেলো হিন্দু। ভারত তার সংবিধানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সংযোজন করলো ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু পাকিস্তান মুখে বললো বটে যে, সবার অধিকার সংরক্ষিত হবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটলো উল্টো। পূর্ব-পাকিস্তানের মুসলমানদের অধিকারই সংরক্ষিত হলো না। ফলে আবার লড়াই। আবার দেশ ভাগ। এবার পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ ১৯৪৭ -এর দ্বিজাতিতত্তে¡র ভুলকে সংশোধন করলো। ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তিতে বিভক্তির বদলে সাম্য ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র ১৯৭১ সালে।

এই লেখা যখন লিখছি তখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেছে। এই ৫০ বছরে অনেক জল গড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ নামক নদী বিধৌত এই ব-দ্বীপের নদ-নদী দিয়ে। স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যা করা হয়েছে স্বাধীনতার মাত্র ৪ বছর পরেই। তারপর সামরিক শাসন-অপশাসন-কুশাসন স্বাধীনতার মূল চেতনাকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। আক্ষরিক অর্থে না হলেও বাংলাদেশ ফিরে গেছে সেই দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানেই। ধর্মীয় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ধর্ম বিশ্বাসকে সংবিধানে সংযোজন করে অন্যান্য ধর্মে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণী’-র নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে; আসলে যা আধুনিক রাষ্ট্র ভাবনার বিপরীত।

একটি রাষ্ট্র কখনোই তার নাগরিকদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস- মতবাদ-বর্ণ-গোত্র-স¤প্রদায়-জাতি এ রকমভাবে বিভক্ত করতে পারে না। এই বিভাজন সভ্যতার যেমন পরিপন্থী, তেমনি রাষ্ট্রগঠনের মূল কাঠামোরও বিপরীত। দুঃখজনক ভাবে সত্যি যে, বাংলাদেশ সাংবিধানিক উপায়েই এই অসভ্য আচরণ করছে তার নিজ ভূ-খন্ডের ধর্মীয় সংখ্যালঘু নাগরিকের উপর।
রাষ্ট্রের কেন ধর্ম থাকবে? রাষ্ট্র তো সব নাগরিকের সর্বজনীন মৌলিক অধিকারকে সংরক্ষণ করবে। নাগরিকদের ধর্ম বিশ্বাস থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। ধর্ম পালনের অধিকার যেমন থাকবে , তেমনি ধর্ম পালন না করার অধিকারও থাকতে হবে। রাষ্ট্র কিছু মৌলিক কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত হবে, যার মূল চেতনাই হবে সব নাগরিকের কল্যাণ।
নাগরিক অধিকারের মধ্যে ধর্ম পালনের অধিকারও থাকবে। কিন্তু সে ধর্ম পালন যেনো অন্যের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ না করে, এমনকি নিজের অধিকার পালন করতে গিয়ে রাষ্ট্রকেও যেনো পশ্চাদমুখী করে না তোলে। রাষ্ট্র বা সরকার তাই এক সর্বজনীন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে তার নাগরিকদের, যেনো তারা নিজেরাই নিজনিজ বিশ্বাস বা ধর্ম বিশ্বাসকে পরিমার্জন করে তুলতে পারে।

ধর্ম বিশ্বাসী মানুষেরা এভাবেই সংস্করণ-পরিমার্জন করেছে তাদের ধর্মকে। এভাবেই সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী হিন্দুদের অতীতের অনেক কিছু পরিবর্ধন-পরিমার্জন, এমনকি পরিতাজ্যও হয়েছে।

তবুও এখনো যে নেই, সেটাই বা কে বলেছে, হয়ত আছেও। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। হাজার বছর ধরে পরিবর্তনও হয়েছে। এখনো হচ্ছে। এটা অগ্রগতি। যদিও এখনো অনেকেই সে অগ্রগতিকে মেনে নিতে পারেনি।
খৃস্টান ধর্মেও ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। গ্যালিলিওকে তাঁর মতবাদ থেকে গির্জার ভয়ে সরে আসতে হয়েছে। সংশোধন হয়েছে, পরিবর্তন হয়েছে। তবেই না আজ যতটুকু সহনশীলতা দেখি সেটা এসেছে।

বৌদ্ধ ধর্মেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। অহিংসা শুধু কেতাবে থাকলে তো হবে না; বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখাতে হবে। অহিংস বুদ্ধ ভাবনাও কখনো কখনো সহিংস হয়েছে এবং হচ্ছে। পরিবর্তন,পরিবর্ধন, পরিমার্জন এখানেও প্রয়োজন।
তেমনি অন্য ধর্ম সেখানেও পরিবর্ধন-পরিবর্তন-পরিমার্জন প্রয়োজন। কিন্তু সাহসের সাথে কে সেটা বলবে? বলতে হবে ওই ধর্ম বিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে থেকেই। কিন্তু সেখানেই আসল প্রতিবন্ধকতা। বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধতে হবে। কিন্তু বাঁধবে কে? ছেলের নাম “শান্তি” রাখলেই তো আর ছেলে শান্তির দূত হয়ে বসে থাকবে না। শান্তির সর্বজনীন শিক্ষাটাও তাকে শেখাতে হবে এবং চর্চা করাতে হবে।

কোনো গ্রন্থ সেটা হোক না ধর্মীয় গ্রন্থ, তা সর্বকালের হতে পারে না; যদি সে গ্রন্থ মানুষের ন্যূনতম উপকারের জন্য লেখা হয়ে থাকে। কারণ, সময়ের সাথে সাথে মানুষকেও অনেকখানি বদলে যেতে হয়। পরিবার থেকে সমাজে, সমাজ থেকে অঞ্চলে, অঞ্চল থেকে বিশ্বে বসবাসের উপযোগী হয়ে প্রত্যেক মানুষকেই গড়ে উঠতে হয়। সাইবেরিয়াতে বাস করে মরু অঞ্চলের পোষাক পরে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই প্রয়োজন নিজেকে অন্যের সাথে মেলাবার সামর্থ এবং অন্যকে নিজের মধ্যে মিলিয়ে নেবার উপযোগীতা।

শিক্ষাই পারে এই উপযোগীতা তৈরী করে দিতে। হয়ত সে শিক্ষার অংশবিশেষে কোন ন্যায়শাস্ত্র বা ধর্মশাস্ত্রও থাকতে পারে। কিন্তু ওই ন্যায় বা ধর্মশাস্ত্র হতে হবে যুগোপযোগী। কারণ, হাজার বছরের পুরানো গ্রন্থে তো আর এখনকার উপযোগী শিক্ষার সব কিছু থাকবে না। আর এর জন্য প্রয়োজন সংশোধন-সংস্করণ-পরিমার্জন।
সবাই সংস্করণ করবে কিন্তু আমি করবো না। এটা কোনো কাজের কথা নয়; এর মানে এই যে সবাই এগিয়ে যাবে কিন্তু আমি পিছিয়ে থাকব। পিছিয়ে পড়া মানুষ এক সময় আর মানুষ থাকে না। কুয়োর ব্যাঙের মতো সে একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়। সীমিত চলাচলে রক্ত জমাট বেঁধে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়ে ওই সীমাবদ্ধ গন্ডিতেই।

শুধু কথায় কথায় নিজেকে প্রগতিশীল বললে হবে না। প্রগতিশীলতা মানে কিন্তু প্রগতির সহযাত্রী বা সমর্থক হওয়াও। বসবাস করি একবিংশ শতকে কিন্তু লালন করি হাজার বছরের পুরানো ধ্যান ধারণা; এটা কোন্ ধরনের প্রগতিশীলতা? নিজেকে স্ব-স্ব ধর্মীয় বেড়াজালের ঘেরাটোপে আবদ্ধ করে প্রমান করতে চাই আমি আর সবার থেকে আলাদা অথচ কেউ যখন আমাকে আলাদা করতে চায়, তখন আবার চিৎকার করে বলি, এটা “রেসিয়াল প্রোফাইলিং”। সব ধর্ম-বিশ্বাসী মানুষদেরকেই এই হিপোক্রেসি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না, এ শ্লোগান আমি যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সেখানে শুধু নয়, বিশ্বের সবখানেই উচ্চারিত হোক উচ্চকন্ঠে। সংখ্যাগুরুদের ধর্ম বিশ্বাস যদি রাষ্ট্রের ধর্ম বিশ্বাস হয়, তবে পৃথিবীর ধর্ম তো হবে সংখ্যাগুরু খ্রিস্টানের ধর্ম। সবাই কি তা মেনে নেব? নাকি, মেনে নেওয়া উচিত? ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। রাষ্ট্র সবার অধিকারকেই সমান ভাবে লালন-পালন ও সংরক্ষণ করবে- এটাই সভ্যসমাজের, আধুনিক সমাজের পূর্বশর্ত।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)