লেখক: আবুল খায়ের (কবি ও কলামিস্ট)
বইয়ের ধরন: কাব্যগ্রন্থ
আলোচনায়: তসলিমা হাসান (কবি ও কথা সাহিত্যিক)
মনের অলিগলিতে যা ঝংকার তুলতে পারে তাই কবিতা। মনের বিষন্নতা দূর করতে যেমন কবিতা পড়া চাই তেমনি নিজেকে সমৃদ্ধ করতেও কবিতা পড়া অপরিহার্য। কবি ও কলামিস্ট ‘আবুল খায়ের’ সাহিত্য অঙ্গনে বেশ পরিচিত মুখ। তার লেখা ‘দীর্ঘশ্বাসের সাথে বসবাস’ কবিতার বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। তাঁর কবিতা যেন বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বইটির প্রতিটি কবিতাই যেন আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তমার সৌন্দর্য বর্ণনায় যেমন কবি কার্পণ্য করেন নাই তেমনি প্রিয়ার ভালোবাসায় হৃদয় ভরাতেও দ্বিধা করেননি। আবার প্রিয়তমার বিরহে সব সৌন্দর্য তাঁর কাছে ফিকে মনে হয়েছে। তাইতো কবির ব্যাকুল অভিব্যক্তি-‘সবুজের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কী লাভ বলো? তুমি যে নেই পাশে।’

দেশকে নিয়ে অসম্ভব বর্ণনা পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যেতে বাধ্য। ঘামে ভেজা কৃষক, ফসলের মাঠ, পুকুর ডোবায় ফোটা শালুক, সাঁঝের বেলার পাখি, বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টি, সবুজ লতা, শীতের কুয়াশা, নতুন ভোর, সোনালি আঁশ কোন কিছুই কবির চোখ এড়ায়নি, বাঁধা পড়েছে তার কবিতায়। প্রকৃতি যেমন কবিকে মুগ্ধ করেছে, তেমনি অনাচার তাকে ক্ষুব্ধ করেছে। পেশী শক্তির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় দাম নিয়ে খোলা হাতে কবিতা লিখেছেন। আড়তদার, ঋণ খেলাপি, ভেজাল পণ্য বিক্রেতা, পুঁজিবাদী সমাজকে কটাক্ষ করেছেন। নির্ভীক চিত্তে বলেছেন- ‘জীবনের ছন্দ বাড়ে না ক্যান পণ্যের দামের মতো, পুঁজিবাদের পেশী শক্তি দেখবো আর কত।’ মানবতাকেই কবি ধর্ম বলেছেন প্রিয় কবি। ধর্মের কথা বলে অধর্মের কাজ করাকে তিনি ঘৃণা করেছেন। ধর্ম নিয়ে যারা করে বাড়াবাড়ি আসলে তারাই ধর্মহীন অসুর মানবতাই ধর্ম মানবতাই হোক কর্ম হিংসা হানাহানি করো দূর।


নীমতলির আগুন, অসহায় মানুষের আর্তচিৎকার, ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে অসাড় জীবন, বেঁচে থাকার আকুল প্রার্থনা পাঠকের বিবেককে নাড়া দেবে। আগুনের লেলিহান শিখা পেটের নিষ্পাপ সন্তানকে পুড়িয়ে ছাই করার দৃশ্য চোখ দুটোকে পোড়াবে নিরন্তর। অসহায় পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা সন্তানদের কটাক্ষ করেছেন কবি। বৃদ্ধ মানুষগুলোর ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, নিদ্রাহীন রাত, ভারাক্লান্ত মন কবিকে উদাস করেছে, কষ্ট দিয়েছে। ধনী-গরিবের বৈষম্য চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ‘তোমরা ও আমরা’ কবিতায়।
একদিকে ধনীরা যেখানে খাদ্য অপচয় করে অন্যদিকে গরিব মানুষ সেই খাদ্যের জন্য কেঁদে মরে। কবি বলেন-তোমার কাছে অখাদ্য যা আমরা সেটা খাই তুমিও যেমন বাঁচতে চাও আমরাও বাঁচতে চাই। বর্তমান সময়ে ক্যাসিনো একটি আলোচিত বিষয়। ক্যাসিনো নিয়ে লেখকের ক্ষুরধার লেখা ‘ভাগ্য বদলের যন্ত্র।’ স্বাধীনতা আমাদের অস্তিত্ব। কবি এই বিষয়টি নিয়ে নিখুঁতভাবে কবিতায় মালা গেঁথেছেন। মার্চের কালো রাত, পাক সেনাদের উম্মাদ অত্যাচার, ঘুমন্ত মানুষের আহাজারি, স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিজয়ের পতাকা বিস্তারভাবে কবিতায় উঠে এসেছে। ভালোবাসার মানুষের উপর চাপা অভিমানের কবিতা ‘কখনো বলা হবে না’ ‘আমার ভালোবাসার নিক্তি জগত যে ভারী তা বুঝার ক্ষমতা সবার থাকে না। হয়তো তুমি, বুঝবে না। ক্যামন করে বুঝবে? তুমি তো অনেক দূরে, অনেক দূরে।’ স¤প্রতি সময়ে ‘রিফাত’ হত্যা মামলার রায় দিয়েছে। ‘রিফাত’ হত্যার প্রতিবাদে কবি কলম তুলে নিয়েছেন হাতে। এছাড়াও তার কবিতায় উঠে এসেছে বিশ্বজিত, আবরার ও নুসরাত হত্যার করুণ বাস্তবতা। ‘সময়ের বচন’ নামে দারুণ একটি কবিতা পাঠকের মনে দাগ কাটবে। কবির ভাষায়-‘সময় এখন নয় ঘুমাবার জড়ো হও জাগ্রত জনতার। মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলবার।’ ‘বিবর্ণ স্বদেশ, স্বদেশ প্রেম, মজলুমের তর্জনী’ ইত্যাদি কবিতাগুলোতে কবি বিপন্ন জনপদ, শকুনের কবলে দেশ এসব বিষয় ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘পতিতা’ শিরোনামের কবিতায় কবি নেতাদের পতিতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। সমাজের অনাচার দূর করতে আমজনতাকে রুখে দাঁড়াতে বলেছেন। প্রতিবাদের হাত দাও গুঁড়িয়ে, পায়ের নিচে পিষিয়ে থেতলিয়ে স্তব্ধ করো সব কণ্ঠ, আছে যত অর্বাচীন ভণ্ড মাথা হোক সব নত অবনত, সততা, বদান্যতা আজ মৃত। ‘আমার কীর্তি যাবে না বিফলে’ কবিতায় কবি আশাবাদী হয়েছেন তার সুকীর্তি চিরকাল রইবে। কবিদের পান্ডুলিপি একসময় কথা কইবে। কবিতার শব্দ বুননে নির্ঘুম রাত বিফলে যাবে না। যায় না কখনো। জাতির কালিমা, ডেঙ্গু, মায়ের জন্য শপথ, ড্রেনের আবর্জনা, মানবতার শ্বেত আরকসহ আরও চমৎকার বিষয়গুলো নিয়ে কবিতা লিখেছেন।

বইটি পড়তে গিয়ে আমি বারবার আবেগ আপ্লূত হয়েছি, কখনো আপন মনে হেসেছি আবার কখনো মনের কোণে মেঘ জমেছে। তবুও সব মিলে চমৎকার একটি সমসাময়িক কবিতার বই ‘দীর্ঘশ্বাসের সাথে বসবাস’। বইটি পাঠক নন্দিত হবে আশা রাখছি। সেই সাথে লেখককে ধন্যবাদ জানাই চমৎকার এই বইটি পাঠকদের পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

বই: দীর্ঘশ্বাসের সাথে বসবাস
লেখক: আবুল খায়ের
প্রকাশনী: অন্বয় প্রকাশ
প্রচ্ছদ: গুলশান কবীর
মূল্য: ২০০ টাকা, পৃষ্ঠা – ৮০