মণিজিঞ্জির সান্যাল : দীপাবলি আমাদের বাঙালি হিন্দুদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব।এই দিন সব হিন্দুরা বাড়িতে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বাংলা,আসাম, ওড়িশা ও মিথিলাতে এই দিনটি কালীপুজো হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। ভারতীয় সমাজের দৃঢ় বিশ্বাস ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’ বা ‘ন্যায়ের কাছে অন্যায়ের পরাজয়’ এই নীতিতে। দীপাবলির মাধ্যমে উপনিষদের আজ্ঞায় এই কথাটা খুবই সদৃঢ়ভাবে চরিতার্থ হয়ে ওঠে যথা “অসতো মা সৎ গময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়। মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়। ওঁ শান্তিঃ\ ওঁ শান্তিঃ\ ওঁ শান্তিঃ\” অর্থাৎ “অসৎ হইতে সত্যে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে জ্যোতিতে লইয়া যাও, মৃত্যু হইতে অমরত্বে লইয়া যাও। সর্বত্র যেন ছড়াইয়া পড়ুক শান্তির বার্তা\”
উত্তর ভারতীয় হিন্দুদের মতে দীপাবলির দিনেই শ্রীরামচন্দ্র চৌদ্দ বছরের নির্বাসনের পর অযোধ্যা ফেরেন। নিজের পরমপ্রিয় রাজাকে ফিরে পেয়ে অযোধ্যাবাসীরা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে সাজিয়ে তোলেন তাদের রাজধানীকে। এই দিনটিতে পূর্বভারত বাদে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে লক্ষ্মী-গণেশের পুজোর নিয়ম আছে।
জৈন মতে, ৫২৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মহাবীর দীপাবলির দিনেই মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করেছিলেন। ১৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ ও ৫২ জন রাজপুত্র দীপাবলির দিন মুক্তি পেয়েছিলেন বলে শিখরাও এই উৎসব পালন করেন। আর্য সমাজ এই দিনে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মৃত্যুদিন পালন করে। তারা এই দিনটি “শারদীয়া নব-শস্যেষ্টি” হিসেবেও পালন করেন। এছাড়া, নেপাল-ভারত-বাংলাদেশের সকল স¤প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই এই উৎসব নিয়ে উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়।
দীপাবলি বা দেওয়ালি হল একটি পাঁচ দিন-ব্যাপী হিন্দু ধর্মীয় উৎসব। তবে জৈন-শিখ ধর্মালম্বীরাও এই সময়ে একই ধরনের উৎসব পালন করে থাকেন। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরাস অথবা ধনত্রয়োদশী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দীপাবলি উৎসবের সূচনা হয়। কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই উৎসব শেষ হয়। নবরাত্রি উৎসব অথবা বাঙালিদের দুর্গোৎসব শেষ হওয়ার ১৮ দিন পর দীপাবলি শুরু হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে, মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বরের মধ্যে দীপাবলি অনুষ্ঠিত হয়।
“দীপাবলি” নামটির অর্থ “প্রদীপের সমষ্টি”। এই দিন হিন্দুরা ঘরে ঘরে ছোটো মাটির প্রদীপ জ্বালেন। এই প্রদীপ জ্বালানো অমঙ্গল বিতাড়নের প্রতীক। বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সারা রাত প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলে ঘরে লক্ষ্মী আসেন বলে উত্তর ভারতীয় হিন্দুরা বিশ্বাস করেন। বাংলার দীপান্বিতা কালীপুজো বিশেষ জনপ্রিয়। এই উৎসব সাড়ম্বরে আলোকসজ্জা সহকারে পালিত হয়। তবে এই পুজো প্রাচীন নয়। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে কাশীনাথ রচিত শ্যামাসপর্যাবিধিগ্রন্থে এই পুজোর সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। কথিত আছে, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকে তার সমস্ত প্রজাকে শাস্তির ভীতিপ্রদর্শন করে কালীপূজা করতে বাধ্য করেন। সেই থেকে নদিয়ায় কালীপুজো বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্রও বহু অর্থব্যয় করে কালীপূজার আয়োজন করতেন। অমঙ্গল বিতাড়নের জন্য আতসবাজিও পোড়ানো হয়। বিশেষত উত্তর ভারতে দীপাবলির সময় নতুন পোশাক পরা, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণের প্রথাও আছে।
এর পরেই যে বিষয়টি সামনে এসে দাঁড়ায় ‘ধনতেরাস’। শব্দটি শুনলেই মনের মধ্যে কেমন সোনালি আলোর ঢেউ খেলে যায়। চারপাশটা কেমন যেন ঝলমল করে ওঠে। ছোটবেলায় এই শব্দটির সঙ্গে বিশেষ কোনো পরিচয় ছিল না কিন্তু আজকের দিনে শব্দটি এতটাই প্রচলিত যে দীপাবলির উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে ধনতেরাস শব্দটিও কেমন যেন আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। আমার বাড়ির চারপাশে বেশিরভাগই অবাঙালি, এমনিতেই দীপাবলির আলো ছড়িয়ে থাকে বহুদিন অবধি।
মূলত অবাঙালিদের মধ্যে এর প্রচলন থাকলেও এখন বাঙালিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে এই উৎসব। এই উৎসবে মূলত সোনা কেনা হয়।
দীপাবলী মূলত পাঁচ দিনের উৎসব। এর আর এক নাম আছে- ধনাত্রয়োদশী বা ধনবত্রী ত্রয়োদশী। ‘ধন’ শব্দের মানে সম্পত্তি।
যে কোনো উৎসব বা সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে আমার বড় ভাল লাগে। আসলে প্রতিটি উৎসবের পেছনেই থাকে একটা মিলনের সুর। আকাশ বাতাস প্রকৃতি, সর্বোপরি মনের মধ্যেও এক অদ্ভুত ভাললাগা কাজ করে।
প্রতিটি উৎসবের পেছনেই একটা করে গল্প থাকে, এই উৎসবেরও একটা কাহিনি আছে।
ধনতেরাসের দিন দেবী লক্ষ্মী তার ভক্তদের গৃহে যান ও তাঁদের ইচ্ছাপূরণ করেন। ব্যবসায়ী স¤প্রদায়ের কাছে এই দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা এ দিনটিতে দামি ধাতু কেনেন। সম্পদের দেবতা কুবেরও এ দিন পূজিত হন।
কথিত আছে, রাজা হিমার ১৬ বছরের ছেলের এক অভিশাপ ছিল। তার কুষ্টিতে লেখা ছিল, বিয়ের চার দিনের মাথায় সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হবে। তার স্ত্রীও জানত সেই কথা। তাই সেই অভিশপ্ত দিনে সে তার স্বামীকে সেদিন ঘুমোতে দেয়নি। শোয়ার ঘরের বাইরে সে সমস্ত গয়না ও সোনা-রূপার মুদ্রা জড়ো করে রাখে। সেই সঙ্গে সারা ঘরে বাতি জ্বালিয়ে দেয়। স্বামীকে জাগিয়ে রাখতে সে সারারাত তাকে গল্প শোনায়, গান শোনায়। পরের দিন যখন মৃত্যুর দেবতা যম তাদের ঘরের দরজায় আসে, আলো আর গয়নার জৌলুসে তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে যায়। রাজপুত্রের শোয়ার ঘর পর্যন্ত তিনি পৌঁছন ঠিকই। কিন্তু সোনার উপর বসে গল্প আর গান শুনেই তাঁর সময় কেটে যায়। সকালে কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই চলে যান তিনি। রাজপুত্রের প্রাণ বেঁচে যায়। পরদিন সেই আনন্দে ধনতেরাস পালন শুরু হয়।
ভারতে ধনতেরাস উৎসব উদযাপিত হয় সোনা, রুপো বা বাসন কিনে। একে সৌভাগ্যের লক্ষণ বলা হয়। নতুন জামাকাপড়ও এ সময় কেনেন অনেকে। এরপর করা হয় লক্ষ্মী পুজো। চারিদিকে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবীর আরাধনা করা হয়। পুজো হয় গণেশেরও।
কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে উৎসব শুরু হয় ধনতেরাস দিয়ে। উত্তর ভারতের ধনতেরাসই বাংলার ধনত্রয়োদশী। এই তিথিতে ধন্বন্তরি, লক্ষ্মী, কুবের ও যমের পুজো করা হয়।
এই উৎসবকে কেন্দ্র করে কতো যে গল্প আছে।
আরো একটি কাহিনি শোনাই এই ধনতেরাসকে কেন্দ্র করে।
কথিত আছে, সত্যযুগে দেবাসুর যখন অমৃতের জন্য সমুদ্রমন্থনে রত তখন ক্ষীরসমুদ্র থেকে উঠে এলেন দেব চিকিৎসক ধন্বন্তরী। তাঁকে বিষ্ণুর এক রূপ বলে ধরা হয়। সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবনের জন্য সবাই তাঁর পুজো করে। তাঁর সঙ্গে উঠে এলেন লক্ষ্মীদেবী। তাই এই দিন ধনসম্পদের জন্য মানুষ লক্ষ্মীপুজোও করে থাকে। একই ভাবে কুবেরের কাছে থাকে দেবতাদের সম্পদ। তাই ধনসম্পদের জন্য এইদিন কুবেরের পুজোও প্রচলিত। একইসঙ্গে প্রতিটি বাড়ির মূল প্রবেশ পথে এইদিন মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হয় যমরাজের উদ্দেশে। মানুষের বিশ্বাস, এই দিন কোন ধাতব দ্রব্য কিনলে তা পরিমাণে তেরো গুণ বৃদ্ধি পায়। এই ধারণা থেকেই ধনতেরাসে সোনা কেনার প্রচলন হয়েছে।
মোট কথা লক্ষ্মী থাকুক সবার ঘরে।
ধনতেরাসের দিন অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী স¤প্রদায়ের অর্থবর্ষের সূচনা হয়; লোকজন নতুন বর্তন, বাসন, গয়না প্রভৃতিও কিনে থাকেন এই দিনে। তবে বেশির ভাগ বাঙালি ব্যবসায়ীদের অর্থবর্ষের সূচনা হয় পয়লা বৈশাখে।
ধনতেরাসের পরের দিন অর্থাৎ দ্বিতীয় দিনটিকে বলে নরক চতুর্দশী বা ভূত চতুর্দশী, দীপাবলীর আগের দিন। একে ছোটি দিওয়ালি-ও বলে।
এই দিনে বাঙালিরা বাড়িতে চোদ্দোটা প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করে তোলেন বাড়িটাকে। কথায় আছে যে এমনটা করলে ভূতপ্রেত পরিবার আর স্বজনদের ঘাড়ের কাছে নড়তে পারে না; এমনটাও লোককথায় শোনা যায় যে এই প্রদীপসজ্জার মাধ্যমে পরিবারের পিতৃপুরুষদের অনুষ্ঠানে পদার্পণ করার জন্য নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়, যাতে তারা মায়ের বাৎসরিক আগমনে উপস্থিত হয়ে সবাইকে শুভাশীষ দিয়ে নিজেরা মায়ের আশীর্ব্বাদে মোক্ষ লাভ করবেন।
তৃতীয় দিন কার্তিক অমাবস্যায় যেখানে উত্তর ভারতে লক্ষ্মীর পুজো হয়, পশ্চিমবঙ্গে দারুণ জাঁকজমকে ঘটা করে পালন করা হয় কালীপুজো। অবশ্য সেদিন আদি পশ্চিমবঙ্গ বাসিন্দারা, ঘটিরা, বাড়িতে লক্ষ্মীর পুজোও করে থাকেন। তবে আদি বাংলাদেশি হিন্দুদের, বাঙালদের, এই নিয়ম নেই; তারা অনেকে বাড়িতেও কালী পুজো করেন, যদিও এই পুজোর বারোয়ারি ভাবে পালন হওয়ার প্রচলন বেশি। কদাচিৎ কালীপুজোর দিন আর দেওয়ালির দিন পৃথকও হতে পারে; দেওয়ালির তারিখটা একদিন পরে কিংবা আগেও পড়া সম্ভব। কেননা কালীপুজোর লগ্ন অমাবস্যার মাঝরাত্রিতে ঠিক হয়, আবার দীপাবলির লক্ষ্মী পুজোর লগ্ন নিশ্চিত করা হয় অমাবস্যার সন্ধ্যেতে, তাই পুজোর লগ্ন অনুযায়ী দুই পুজোর তারিখে মাঝে মাঝে অন্তর ঘটে থাকে।
দেওয়ালির দিনে প্রদীপের আলোয় বাড়ি-বাড়ি ঝকমক করে ওঠে। নানান রঙের বাজিতে আকাশটাও রীতিমত জ্বলজ্বল করে। দীপাবলি সারি-সারি প্রদীপের আলোকে স্বর্গের দেবতাকে মর্তের কুটিরে বরণ করে নেবার উৎসব। চতুর্থ দিন কার্তিক শুক্লা প্রতিপদ। এই দিন বৈষ্ণবেরা গোবর্ধন পুজো করেন।
পঞ্চম দিন যমদ্বিতীয়া বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা। এই দিন বোনেরা তাদের ভাইদের জন্যে উপোস করে থাকে, বিভিন্ন উপহার আর ভালোবাসায় ভরে ওঠে সেদিন। ভাই বোনের পারস্পরিক মেলবন্ধনে আরো রঙিন হয়ে ওঠে এই দিনটি।
এভাবেই পাঁচটি দিনের আনন্দে ঝলমল করে ওঠে প্রতিটি মানুষের বাড়ি ঘর। রঙের বন্যায় ভেসে যায় আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী। হৃদয়ের অন্তরালে শুধুই খুশির হাওয়া। আত্মীয়, বন্ধু সবার মধ্যেই ভালোবাসার ছোঁয়া। এ যেন এক খুশির বাতাবরণ। আকাশে বাতাসে দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে এই উৎসবের মেজাজ।
ভাল থাকুক সবাই, ভাল থাকুক পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ, পৃথিবীর সমস্ত জীবকুল, আকাশ, বাতাস, গ্রহ নক্ষত্র, এই শুভ মুহূর্তে ঈশ্বরের কাছে শুধুই এই প্রার্থনা। শুভকামনা
মণিজিঞ্জির সান্যাল: কথা সাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, দাজিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ