Home জাতীয় দামে পিষ্ট মধ্য ও নিম্নবিত্ত

দামে পিষ্ট মধ্য ও নিম্নবিত্ত

অনলাইন ডেস্ক : পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্য যেন সোনার হরিণ! দামে সস্তা হওয়ায় টিসিবির ট্রাকে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ক্রেতারা।
পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, চিনি ও মসুর ডালের বাজার এই মুহূর্তে একরকম অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। এগুলোর দাম বেঁধে দেওয়ার পরও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এমনকি মনিটরিং ব্যবস্থাসহ নানা উদ্যোগেও আসছে না তেমন কোনো ইতিবাচক ফল। অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা কারসাজির মাধ্যমে নিজেদের মতো করে বাড়াচ্ছে পণ্যের মূল্য। হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। এতে রীতিমতো পিষ্ট মধ্য ও নিম্নবিত্তের মানুষ। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে এসব নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামের বিষয়টি উঠে এসেছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সোমবার মিলার, আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সেখানে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়। সরকরের মনিটরিং কার্যক্রম আরও জোরদার করতে সব জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ভোজ্যতেল, চিনি ও পেঁয়াজের ওপর শুল্ক স্থগিত করার চিঠি দেওয়া হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)।

বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা চারদিক থেকে চেষ্টা করছি যতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এক মাস ধরে পেঁয়াজের বাড়তি দাম থাকার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে ৫ লাখ টন পেঁয়াজ মজুত আছে, যা দিয়ে আগামী আড়াই থেকে তিন মাস চলতে পারে। তারপরও আমরা বিভিন্ন রকম শুল্ক প্রত্যাহার করার জন্য এনবিআরকে চিঠি দিয়েছি। আশা করছি বাজার পরিস্থিতি শিগগিরই স্বাভাবিক হয়ে আসবে। একই দিন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেছেন, উৎপাদনের সঠিক তথ্য না থাকলে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা সম্ভব নয়। সঠিক তথ্যের ওপর নির্ভর করে চাহিদা ও সরবরাহ ঠিক রাখা যাবে।

এছাড়া পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, দেশে ধানসহ খাদ্যপণ্যের সঠিক চাহিদা কত, সেই হিসাব যেমন নেই, তেমনই উৎপাদনের সঠিক পরিসংখ্যান নেই-যা পরিকল্পনা গ্রহণে বড় সমস্যা। তথ্যবিভ্রান্তি হলে পরিকল্পনা ঠিক হয় না। পরিকল্পনা প্রক্ষাপণ ঠিক হবে না। কোনো মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নেওয়া, আমদানি সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হবে। কাজেই তথ্যের সঠিকতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি নিশ্চিত হতে বিবিএসকে তার দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈঠকে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি দাম ঠিক করে দেয়। ওই মূল্য বাজারে কার্যকর হয় খুব ধীরগতিতে। অপরদিকে মূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে দ্রুত কার্যকর করা হয়। এ প্রবণতা থেকে ব্যবসায়ীদের বের হয়ে আসতে হবে।

জানা যায়, পেঁয়াজের ওপর বর্তমান ৫ শতাংশ হারে এসডি আরোপ আছে। আগামী চার মাসের জন্য এই আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করতে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া চিনির ওপর আমদানি শুল্ক আছে ৩ হাজার টাকা। এনবিআরের কাছে চিনি ও ভোজ্যতেলের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারেরও চিঠি দেওয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে।

দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়তে বাড়তে গত এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতি কেজি ৭৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। সরকার দাম বেঁধে দিলেও বেসরকারি জোগান থেকে আসা ভোজ্যতেল ও চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ সাংবাদিকদের বলেন, পেঁয়াজের আংশিক দাম বেড়েছে ভারতের বেঙ্গালুরুতে অতিবৃষ্টির কারণে। আংশিক বেড়েছে আতঙ্কে। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছি। এনবিআরকে শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য বলা হয়েছে। মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আনার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে আরও দুটি দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে। নতুন পেঁয়াজ উঠতে আরও এক মাসের প্রয়োজন হবে। আশা করছি, এসব উদ্যোগের ফলে দাম যৌক্তিক পর্যায়ে থাকবে। তিনি আরও বলেন, আমি ব্যবসায়ীদের বলেছি, বিশ্ববাজারের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে দেশের বাজারে যাতে বেশি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে। কারণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিটি পণ্যের মনিটরিং করা হচ্ছে।

বাণিজ্য সচিব আরও বলেন, দেশের পেঁয়াজের চাহিদার ৮০ শতাংশ এখন দেশেই উৎপাদিত হয়, বাকি ২০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। এর বেশির ভাগ আসে ভারত থেকে, মিয়ানমার থেকেও কিছু আসে। ইতোমধ্যে তুরস্ক থেকে ১৫ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আনা হয়েছে।

নভেম্বরের শেষে বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসতে শুরু করবে। বর্তমান ৫ লাখ টন পেঁয়াজের মজুত আছে। এই পেঁয়াজ দিয়ে আগামী তিন মাস চলে যাওয়ার কথা। এর বাইরে নভেম্বরের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে নতুন পেঁয়াজ আসবে। এর আগের একটি মাস হয়তো পেঁয়াজের দাম বেশি থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যে আমাদের চেষ্টা থাকবে যৌক্তিক মূল্য যতটুকু বাড়া দরকার ততটুকুই যেন বাড়ে, এর মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ থাকে। আমরা আশা করছি, পরিস্থিতি এখন যেমন আছে এর চেয়ে আর খারাপ হবে না।

চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম বেঁধে দেওয়ার বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে সচিব বলেন, তেলের বাজার স্বাভাবিক আছে। তবে চিনির দাম যেহেতু ৪/৫ টাকা কমিয়ে আনা হয়েছিল, তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। প্রশাসনের কর্মকর্তারা মাঠে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। ডাল আমদানিতে বর্তমানে কোনো শুল্ক নেই বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়।

দাম বেঁধে দেওয়ার পরও সেটি কার্যকর হয় না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাজারে মনিটরিং আছে। প্রতিটি জেলা প্রশাসককে বাজার মনিটরিং করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা মনিটরিং করছে। এছাড়া ব্যবসায়ীদের কঠোর সতর্ক করা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয়েছে ২৯ লাখ ৫৫ হাজার টন। পাশাপাশি আমদানি করতে হয় ৬ থেকে ৭ লাখ টন। ইতোমধ্যে জুলাই-সেপ্টেম্বরে ১.৮৪ হাজার টন আমদানি করা হয়েছে। এছাড়া বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ লাখ টন। এরমধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ২ লাখ টন। পাশাপাশি আমদানি করতে হয় ১৮ লাখ টন। তবে জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১.৪৮ লাখ টন। এছাড়া দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮ লাখ টন। উৎপাদন হয় ৩০ হাজার টন। চাহিদা মেটাতে ১৮ লাখ টন চিনি আমদানি করতে হয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১৪ হাজার ২১৩ টন। দেশে মসুর ডালের চাহিদা ৫ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় ২.৫৮ লাখ টন। আমদানি করতে হয় ৩.৭ লাখ টন। তিন মসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানি হয়েছে ৬২ হাজার ১১৫ টন।

খুচরা বাজার পরিস্থিতি : সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্ধিত দামেই ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল ও পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাতে অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোজ্যতেলের দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। দুইদিনের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম প্রতি লিটারে ২ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক খুচরা বাজারে পণ্যমূল্য তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুইদিনের ব্যবধানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ, পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ, পাম অয়েল লিটারে শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ ও পাম অয়েল সুপারের লিটারে ২ দশমিক ৭১ শতাংশ বেড়েছে। তিন দিনের ব্যবধানে কেজিতে চিনির মূল্য ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ, দুই দিনের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের মূল্য বেড়েছে ১৬ শতাংশ।

রাজধানীর কাওরান বাজার, নয়াবাজার ও মালিবাগ কাঁচাবাজার ঘুরে এবং বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোমবার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা দুই দিন আগে শনিবার ১৩৫ টাকায় বিক্রি হয়। দুই দিনের ব্যবধানে লিটারে ৫ টাকা বেড়েছে।

এদিন প্রতি লিটার খোলা পাম অয়েল ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা একদিন আগে ১২৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক মাস আগে ১২৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি পাম অয়েল সুপার প্রতি লিটার ১৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা একদিন আগে ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক মাস আগেও একই টাকায় বিক্রি হয়েছে।

কাওরান বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা মো. সালাউদ্দিন বলেন, এমনিতেই বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তি। এর মধ্যে আবারও ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ৫ টাকা বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়ছে। কাওরান বাজারের মুদি বিক্রেতা মো. মকবুল বলেন, আমরা বিক্রেতারা কী করব, সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। ক্রেতারা দাম বাড়ার কারণে আমাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে। যারা আমদানি করেন, তারাই দাম বাড়াচ্ছেন। আমাদেরও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আর বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। তদারকি ওইখানেও করা উচিত।

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সব ধরনের পণ্য বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে সব শ্রেণির ক্রেতাকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষ। তিনি জানান, কখনো মজুত ও সরবরাহ থাকার পরও অসাধুরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট কাটছে। আবার অনেক সময় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে সব জায়গাতেই দাম বাড়বে-এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যেদিন দাম বাড়ে, ঠিক সেদিনই অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। তবে দেখার বিষয়, যেদিন আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ে সেই পণ্য দেশে আসতে কমপক্ষে কয়েকদিন সময় লেগে যায়। কিন্তু দেশের বাজারে দাম বাড়ানো হয় এক থেকে দুই মিনিটের মধ্যে। এক্ষেত্রে তদারকি সংস্থার নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি যেসব পণ্য আমদানি করা দরকার, সেসব পণ্য আমদানি করে পর্যাপ্ত মজুত গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য শুল্ক পরিহার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

Exit mobile version