ভজন সরকার : ‘মধ্যবিত্ত’ শব্দটার মধ্যে বিত্তের প্রাধান্য যতটুকু তার চেয়ে বেশী গুরুত্ব ‘মধ্য’ শব্দটার। ‘মধ্য’ শব্দটি ঠিক যেন মাঝামাঝি নয়। ‘মধ্য’ শব্দটি যেন সিঁড়ির সর্ব নি¤œ ধাপ থেকে সোজা উপরে উঠে যাওয়া। কথাটা বলা যতটা সোজা, পেরিয়ে আসা ধাপগুলো ডিঙানো ঠিক ততটাই কঠিন। আজ যে ল্যান্ডিং স্পেসে দাঁড়িয়ে হয়ত নিচ এবং উপরকে কাছাকাছি দেখাচ্ছে, একদিন এই মাঝের ল্যান্ডিংটুকুই মনে হোতো বিশাল উঁচু। এভারেস্টের মতো উঁচু। বিশেষকরে সমাজের প্রান্তিক মানুষজনের কাছে মধ্যবিত্তের ল্যান্ডিংয়ে ওঠা এভারেস্টে ওঠার চেয়েও দুস্তর।

পৃথিবীর সব চেয়ে উঁচু এ পাহাড় চূড়ায় ওঠার স্বপ্নটুকু দেখতেই অধিকাংশই মানুষ জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে যায়। মাত্র কিছু মানুষ সাহসে ভর করে এগোয়। বাছাই করা কিছু মানুষ চেষ্টাটুকু করে। সেখান থেকে আরও স্বল্প সংখ্যক উদ্যমী মানুষ বেইস ক্যাম্পে যেতে পারে। তারপর আরও কিছু ক্যাম্প। আরও অনেক ব্যর্থতা। মৃত্যুকে ভ্রুকুটি। তারপর মাত্র হাতেগোনা মানুষের সাফল্য। ‘মধ্যবিত্ত’ মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকা যেনো এভারেষ্টের চূড়ায় ওঠার মতোই ঘটে ধাপে ধাপে। পর্বতারোহীদের মতোই নিম্নবিত্ত মানুষের সংগ্রাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই ‘মধ্যবিত্ত’ শব্দটা বড় বেশি খচখচাচ্ছিল। বেশ ক’বার বাথরুমের আয়নায় নিজেকে এপিঠ-ওপিঠ করে দেখছিলাম। আমার মাঝেমধ্যে এমনটি হয়। অনেকেরও হয়ত হয়। কারো কারো এমন ভাবনটা ভাবারই সময় হয় না। জীবনযন্ত্রণার তীব্রতা এবং প্রাত্যহিক ব্যস্ততায় মনে ঠাঁই-ই পায় না বিত্তবিন্যাসের এই সব চিত্তবিলাস। নিম্ন, মধ্য, উচ্চ নামের এই সব প্রকার ভেদের সময় কোথায়?

মানুষ তো আর যন্ত্র নয়। তাই যন্ত্রের মতো একই গতিতে মানুষও চলতে পারে না। ব্যস্ত জীবনও এক সময় জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে চায়। জানালা খুলে, দরজা খুলে মুক্ত বাতাসে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে চায়।

সেরকমটাই আমার মন ভাবছিল আজকের সকালে। ভাবছিল, মধ্যবিত্ত নামের এই যে সামাজিক স্ট্যাটাস, এর সাথে দৈহিক আকার আকৃতির কোন পরিবর্তন হয় কি? বিত্তের কতটুকু স্ফীতি হলে নিম্ন থেকে বিত্ত উন্নীত হয় মধ্যে? একি ‘কোয়ান্টেটি’; নাকি নিতান্তই বিমূর্ত একটি ‘পারসেপশন’ মাত্র?

আসলে আমাদের ভাবনাগুলো অভিজ্ঞতা আর পেছনের স্মৃতির সংমিশ্রণ ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাই আজকে যেখানে আছি এবং পেছনে যা কিছু ঘটে গেছে- এ দুই নিয়েই আমাদের প্রাত্যহিক চিন্তা-ভাবনা। ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত সে অভিজ্ঞতা থেকেই নিয়ে থাকি। তাই আমার মনের কোথাও কি উঁকি দিচ্ছে এই ভাবনা যে, আমি বিত্তের বিন্যাস থেকে ছিঁটকে পড়ছি- সেটা হোক নিচে কিংবা উপরে ওঠা।

প্রতি বছর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ এলেই এ রকমটি হয় আমার। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক অব্যবহিত পরেই আমরা যারা বেড়ে উঠেছি, তাঁদের ভাবনা ও অভিজ্ঞতা মিশে আছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাজ্ঞালির মুক্তিসংগ্রাম, ছয় দফা, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ, ১৯৭৫ সালে জাতির অবিসংবাদী নেতাকে সপরিবারে হত্যাসহ ইতিহাসের বাঁকবদলের অনেক উপকরণে। এক কথায়, একজন মানুষের পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার মতো করেই একটা ভূখন্ড দেশ এবং রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। স্বাধীনতার পরের প্রজন্মের মানুষ হিসেবে বাংলাদেশকে আমরাও দেশ ও রাষ্ট্র হিসেবে এমনভাবে গড়ে উঠতে দেখেছি।

আমরা এটাও দেখেছি, তলাবিহীন ঝুঁড়ির অভিধা পাওয়া দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশকে। দেখেছি ১৯৭৪ সালে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের ফলে লাখ লাখ মানুষের হাড্ডিসার বুভুক্ষ অবস্থা। দেখেছি সামরিক জান্তার গণতন্ত্র কন্ঠরোধ করার দুঃসাহস। ততোধিক সাহস দেখেছি ছাত্র-জনতার। দেখেছি প্রচন্ড প্রতাপশালীদের টেনে হিঁচড়ে নামানো। এসব তো সংগ্রামের চিত্র। দেখেছি হাঁটিহাঁটি পা-পা করে করে বাংলাদেশের উপরে ওঠার চিত্র। দেখেছি খেতে না-পাওয়া মানুষের দুইবেলা আধাপেট খাওয়া থেকে দেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার চিত্রও।
এসব ভেবেই আমি আমার এ নিবন্ধটি শুরু করেছিলাম ‘মধ্যবিত্ত”-এর চিত্ত ও বিত্তের চিত্রকল্প দিয়ে। মধ্যবিত্তের মতোই যেন শুরু থেকে আজকের বাংলাদেশের এ পথচলা। মধ্যবিত্তের মতোই বাংলাদেশ নামক এ ‘ভূখন্ডের’ এ পথচলা কুসুমাকীর্ণ ছিল না । এখনো কি নিরাপদ নির্বিঘœ বাংলাদেশের ভবিষ্যত?

ব্যক্তি মানুষের জীবনে চিত্ত ও বিত্তের সিঁড়ি পেরোনোর জন্য যেমন থাকে অনুপ্রেরণার বাতিঘর, দেশের এবং রাষ্ট্রের সামনে চলার জন্যেও প্রয়োজন আদর্শের বাতিঘর। বাংলাদেশের জন্য তেমনি আদর্শের বাতিঘরের নাম ‘ একুশে ফেব্রুয়ারি’, যেদিন একটি ভাষার অবমাননা রুখতে প্রাণ দিয়েছিলেন কিছু মানুষ। সেই মানুষগুলোর প্রাণ বিসর্জন ওই অঞ্চলের মানুষদের একত্রিত করেছিল। সংগঠিত করেছিল মুক্তিসংগ্রামে। সংগঠিত করেছিল একটি দেশের জন্মের ইতিহাস রচনা করতে।

আজ জাতিসংঘ নামক এক রাষ্ট্রপুঞ্জ বা সঙ্ঘ আমাদের ভাষা আন্দোলনকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বলে বলে আমরা যখন মুখে ফেনা তুলে ফেলি, তখন একবারও ভাবি না যে, ১৯৫২ সালের ‘একুশে ফেব্রæয়ারি তথাকথিত ‘মাতৃভাষা’ দিবস ছিল না। ছিল একটি ভূখন্ডের মানুষের স্বপ্নের সৌধ বিনির্মানের দিন। যার চূড়ান্ত সফলতা ১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম। তাই যখন ‘একুশে ফেব্রæয়ারি’-কে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে অভিধা দিতে বেশী সচেষ্ট হই , তখন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’-র মূলচেতনা থেকেই সরে আসি।

রফিক- সালাম-বরকত-জব্বারসহ সকল শহীদের আত্মদানকে যেন এই সব আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির চোরাবালিতে ঢেকে না ফেলি এবং অবমাননা না করি, সেটিও আমাদের ভেবে দেখা উচিত। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি ‘ একান্তই বাংলা ভাষাভাষী মানুষের নিজস্ব। একজন মানুষের বেড়ে ওঠার সিঁড়ির মতো একুশে ফেব্রুয়ারিও বাংলাদেশের বেড়ে ওঠার সিঁড়ি এবং ভিত্তিমূল। তাই ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’-র চেতনা একান্তই দেশীয়, আন্তর্জাতিক নয় এবং এ ধরণের মেকি আন্তর্জাতিকতার প্রয়োজনও নেই।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, ওণ্টারিও)