ফারহানা আজিম শিউলী : ২৩শে এপ্রিল ১৯৯২। কবীর সুমনের ‘তোমাকে চাই’ এ্যালবামের আত্মপ্রকাশের দিন। আধুনিক বাংলা গানে নতুন দ্বার উন্মোচনের দিন।

‘তোমাকে চাই’ এর ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখ সন্ধ্যায় কলকাতার কলা মন্দিরে হয়ে গেল ‘কবীর সুমন একক।’ কবীর সুমন শুরু করেছিলেন সেরা হয়ে। তারপর তিরিশ বছর ধরে তিনি প্রত্যেক অনুষ্ঠানে নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন, যাচ্ছেন। ৭৩ বছর বয়সে কলা মন্দিরে আবার গাইলেন কবীর সুমন। শুনলেন পুরোনো অনুরাগীদের সাথে নবীন প্রজন্মের অনেকে। প্রেক্ষাগৃহপূর্ণ কলামন্দির সাক্ষী হয়ে রইলো আরেকটা ইতিহাসের।

কবীর সুমনের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৬ই মার্চ, ঊড়িষ্যার কটক শহরে। সঙ্গীত অন্তপ্রাণ ও পেশাদার সঙ্গীতশিল্পী বাবা সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও মা উমা চট্টোপাধ্যায়ের কল্যাণে সাঙ্গীতিক আবহে বেড়ে ওঠা সুমন একদিকে হিন্দুস্তানি খেয়াল যেমন শিখেছেন, তেমনি আধুনিক গানের সঙ্গেও খুব অল্প বয়স থেকেই বিস্তর পরিচয় ছিল তাঁর। গত শতকের ছয়ের দশক অর্থাৎ আকাশবাণীর পর্ব থেকে ধরলে কবীর সুমনের সঙ্গীত জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমাকে বড়ো দুটি পর্বে ভাগ করা যায়। একভাগে আধুনিক বাংলা গান, আরেকভাগে বাংলা ভাষায় খেয়াল।

কবীর সুমন একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, একসময় সাংবাদিকতা করেছেন, লিখেছেন গদ্য ছোটোগল্প উপন্যাস, অভিনয়ও করেছেন। ভয়েস অফ আমেরিকায় থাকতে বাংলা ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘দূরের জানালা’ কলামে বছর চারেক নিয়মিত লিখেছেন। আমেরিকা থেকে লিখতেন ফ্রন্টিয়ার কাগজে। সঙ্গীতসহ সামাজিক-রাজনৈতিক নানান বিষয় নিয়ে লিখেছেন বেশ কয়েকটি বই।

আচার্য কালিপদ দাসের কাছে কবীর সুমন খেয়াল শিখেছেন ১৪ বছর। সংস্পর্শে এসেছেন আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, বাবা সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধু আমির খান সাহেবের। ১৯৬৬ সাল থেকে আকাশবাণী কোলকাতার শিল্পী কবীর সুমন।

গত শতকের সপ্তম দশকে একদিকে চলছে নকশালবাড়ি আন্দোলন, নদীতে ভেসে যাচ্ছে ছোরা-বেঁধা লাশ; ওদিকে হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ, কোলকাতায় শরণার্থীর প্লাবন- এই সময়টা একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল সুমনের জন্য। যার প্রতিফলন আমরা তাঁর সৃষ্ট বাংলা আধুনিক গানে পেয়েছি। বাংলা আধুনিক গানকে তিনি মানুষের মুখের ভাষায় রচনা করে, সুরে নতুন আঙ্গিক এনে সমসাময়িক করে তুলেছিলেন।

১৯৯২ সালে ‘তোমাকে চাই’ এ্যালবাম দিয়ে আধুনিক বাংলা গানের জগতের খোল নলচে পালটে দেন কবীর সুমন, তৈরি করেন বাংলা আধুনিক গানে নতুন স্বর-নতুন অধ্যায়, নতুন ভাষা দেন আধুনিক বাংলা গানে, মুক্তি আনেন আধুনিক বাংলা গানে। কবীর সুমন এখনও ধারাবাহিকভাবে বাংলা গানের সেবা করে যাচ্ছেন।

কবীর সুমন ব্লটিং পেপারের মতো পৃথিবীর ইত্যাকার সাহিত্য-সঙ্গীত শুষে নিয়ে, তাঁর ভাষায় অনেক মায়ের স্তন্য আকণ্ঠ পান করে নিজ ক্যানভাস রাঙিয়েছেন, পুষ্ট করেছেন বাংলা সঙ্গীতের দুনিয়া। তিনি বাংলা গানকে পুষ্ট করার পাশাপাশি সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে ভাবিয়েছেন আমাদের, ভাবাচ্ছেন। Bob Dylan brought intellect into our pop music – জ্যাক নিকলসনের এই কথাটি ছাপা হয় New York Times এ। আর Kabir Suman brought intellect into our modern Bengali music.

কলা মন্দিরে ৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ‘কবীর সুমন একক’-এ সুমন তাঁর তৈরি হাজার দুয়েকের বেশি বাংলা আধুনিক গান থেকে বিশটির মতো গান পরিবেশন করেন, বলেন বেশ কয়েকটি গানের নেপথ্যের গল্প ও গানের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা তথ্য। তাঁর প্রথম পরিবেশনা ছিল একটি আগমনী গান: ‘উমা এলে আর যেতে দেবো না/ বাপের বাড়ি ছেড়ে যেতে দেবো না/ নাইয়োরে আসে উমা মায়ের খালি কোলে/ শরৎ দুলে ওঠে গানের কলরোলে/ বাংলার উমা কোনও মর্দিনী নয়/ অসূর তার চেনা প্রতিবেশী হয়।’ এই আগমনী গানটা ক’দিন আগেই সুমনের তৈরি করা। এটি আগমনী গান কিন্তু খেয়াল আঙ্গিকে। অর্থাৎ বাংলা খেয়াল আঙ্গিকে আগমনী গান। রাগ কেদার, তাল রূপক। উল্লেখ্য, একই কথায় দেশকার রাগে তিনতালে তিনি আরেকটি আগমনী গান বেঁধেছেন। সুমন বলেন, “আজ অন্তত ৫০/৬০ বছর হয়ে গেল আগমনী গান কিন্তু আর তৈরি হয়নি। পুরোনো আগমনী গানগুলো নিয়েই আমরা থাকি। অথচ এই আগমনী গান বাংলার খুব নিজস্ব।” তিনি এখন পর্যন্ত ৫টি আগমনী গান লিখেছেন, আর কালী গান লিখেছেন ১১টির মতো।

আগমনী গানের পর কবীর সুমন একে একে গেয়ে যান – ‘তোমাকে চাই’ এ্যালবামের (১৯৯২) কখনো সময় আসে, ‘ইচ্ছে হল’ এ্যালবামের (১৯৯৩) প্রতিদিন সূর্য ওঠে, ‘গানওলা’ এ্যালবামের (১৯৯৪) তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা। অনুষ্ঠানে ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ গানটি সম্পর্কে কবীর সুমন বলেন, “এই গানটি বাংলাদেশের এক আশ্চর্য কবি শহীদ কাদরীর ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কবিতা থেকে লেখা। শহীদ আমার বন্ধু। বন্ধু ছিলেন বলতে আমি রাজি না। শহীদ আছেন। শহীদের শরীরটা চলে গেছে কিন্তু শহীদ এখনো আছেন। শহীদ সম্পর্কে দু’একটা কথা বললে আপনাদের ভালো লাগবে। আপনারা জানেন, অনেকেই দেশভাগের পর এখানে চলে এসেছিলেন, কষ্ট পেয়েছিলেন, দেশ হারিয়েছিলেন, তেমনি এখান থেকেও কিন্তু অনেকেই চলে গিয়েছিলেন। ওপার থেকে যেমন চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন কেউ কেউ, তেমনি এখান থেকেও চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন কেউ কেউ। তার মধ্যে একজন শহীদ কাদরী, ওঁর মা ও বড়ো ভাই। ওঁরা যেতে চাননি। তাঁদের প্রতিবেশিদের সবাই ছিলেন হিন্দু। হিন্দু প্রতিবেশিরা ওঁদের বলেন যে, আর রক্ষা করা যাবে না। ফলে কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছিলেন শহীদ কাদরী। কিন্তু শহীদ কোলকাতা থেকে একটুও আর বের হতে পারেননি আমৃত্যু। আমি শহীদের খুবই ঘনিষ্ট ছিলাম একসময় জার্মানিতে, সেই সূত্রেই জেনেছি। শহীদ ছিলেন প্রেমিক লোক। ওঁর স্ত্রী নাজমুননেসা আমার বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন ভয়েস অফ জার্মানিতে। আর শহীদ উৎসর্গ করেছিলেন নাজমুনকে। নাজমুনের ডাক নাম পিয়ারি। উৎসর্গে লিখেছিলেন, ‘গানগুলি যেন পোষা হরিণের পাল তোমার চরণচিহ্নের অভিসারে।’ ক’জন লিখতে পারেন এরকম! আমি ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কবিতাটি প’ড়ে বেশ এদিক ওদিক করেছি, অনেকটা বন্ধুত্বের দাবিতেও। ফলে গানটি আমাদের দুজনার রচনা হয়ে গেছে প্রায়।” একক সন্ধ্যায় গানটি দুবার গেয়ে শোনান কবীর সুমন।

এরপর সুমন গেয়ে শোনান ‘তোমাকে চাই’ এ্যালবামের মন খারাপ করা বিকেল। ‘সুমনের গান সুমনের ভাষ্য’ নামে একটি বই প্রকাশ হয়েছিল ১৯৯৪ সালে ধ্রæবপদ প্রকাশনী থেকে। পরে আবার সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে বইটি বের হয়। সুধীর চক্রবর্তী এর সংকলক। এতে সুমনের ২২টি গান তিনি কোন ভাবনা থেকে রচনা করেছেন সেই নেপথ্য কাহিনির বর্ণনা আছে। সেখানে ‘মন খারাপ করা বিকেল’ গানটি লেখার নেপথ্য-কথা লিখেছেন সুমন। ১৯৯০ সালের মার্চ মাস। দক্ষিণ ভারতে বেড়াতে গিয়েছেন তিনি সপরিবারে। তাঁর সঙ্গী অসুস্থ। মন ভালো নেই তাঁর সবকিছু মিলিয়ে। লেখার প্যাড বের করে আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতেই বেরিয়ে এলো: মন খারাপ করা বিকেল মানেই মেঘ করেছে। সুমন লিখছেন, “কোথায় মেঘ! বাইরে তো উজ্জ্বল রোদ্দুরে কোচিন ভেসে যাচ্ছে! অথচ খুব স্বাভাবিকভাবেই যেন এসে পড়ল ‘দূরে কোথাও দু-এক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে।’… হতচ্ছাড়া কলকাতা তো ফেউ-এর মতো লেগেই থাকে সারাক্ষণ। বাইরে গেলে অনেক সময় টের পাই নাÑ এতো নিঃসাড়ে লেগে থাকে হতভাগা। হঠাৎ হঠাৎ জানান দেয়। জানান দিয়ে বসল। কেন কে জানে ঢাকুরিয়ার মোড়, যাদবপুর মোড়- ঐ অঞ্চলের মোড়গুলো ছবি হয়ে ঝুলতে লাগল চোখের সামনে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম একটা পানের দোকান। তার রেডিয়োটা বাজছে? সামনে সন্ধে ছোঁয়া রাস্তা। ভেজা ভেজা। লোকজন, ব্যস্ততা, সাইকেল রিক্সার প্যাঁকপ্যাঁক হুঁশিয়ারি, মিনি বাসের ভীড়! ছবিটাকে ধ’রে ফেললাম।”

‘ইচ্ছে হল’ এ্যালবামের ‘বয়স আমার’ ছিল কবীর সুমনের তারপরের পরিবেশনা। গানটির শেষের জায়গাটুকু সুমন আজানের সুরে গান। কবীর সুমন বলেন, “এই শেষে যে আজান- এর আইডিয়াটা আমি পেয়েছিলাম খুব ছোটবেলায়। সঙ্গীতাচার্য পঙ্কজ কুমার মল্লিকের মহিষাসুরমর্দিনী, তার সুরে রূপংদেহী ধনংদেহী একটা কোরাস। সেখানে আছে এরকম সুর। আর এই জায়গাটা পঙ্কজবাবু একা গাইছেন, ভাবুন! অসামান্য একটা কাজ। এটা আমি জানতে পেরেছি। কারণ আমার পিতৃদেব সুধীন্দ্রনাথ রেডিওতে চাকরি করতেন। পঙ্কজ কুমার মল্লিক আমাদের পারিবারিক সূত্রেও চেনা ছিলেন। এবং ওঁর কাছ থেকেই পিতৃদেব জানতে পেরেছিলেন। পঙ্কজবাবুর ডিরেকশনে আমিও একটি কাজে সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে। আকাশবাণী কোলকাতার যেমন মহিষাসুরমর্দিনী তেমনি স্বরস্বতী পুজোর ওপরও একটা কম্পোজিট অনুষ্ঠান রেকর্ডিং হয়েছিল। তাতে আমি সুযোগ পেয়েছিলাম। সেখানে খুব ভালো গেয়েছিলেন সুভাষ মিত্র, বিরাট গায়ক সুকুমার মিত্রের ছোটো ভাই। তেমনি আরো কেউ কেউ গেয়েছিলেন। অনেকেরই নাম আর মনে নেই। কিন্তু সুভাষ মিত্রর কথা মনে আছে। চার লাইনের একটা গান আমার ভাগ্যে পড়েছিল। কোনোরকমে উৎরেছিলাম সেদিন। এখন আর রেডিওতে গানটা বাজে না। ’৭১ সালের কথা। তখন আমার নাম সুমন চট্টোপাধ্যায়। গানটা বাণী কুমারের লেখা। যিনি মহিষাসুরমর্দিনীর গানগুলো লিখেছিলেন তাঁরই লেখা, পঙ্কজবাবুর সুর। এ গানগুলোর আবেদন ফুরোবার নয়।” এ পর্যায়ে সুমন ৪ লাইনের সেই ছোট্ট গানটি শ্রোতাদের শোনান: ‘যে বাঙ্ময় অর্ধমূর্তি ধরি, মিশে করে নিবর্তন/ তুমি সেই বাঙ্ময়রূপী হে জননী, লহো মম প্রাণের বন্দন।’

এরপরের গানটি কবীর সুমন অন্য যন্ত্রানুসঙ্গ ছাড়া শুধু নিজে কিবোর্ড বাজিয়ে পরিবেশন করেন। তিনি বলেন, “এই গান আমার দুর্বল জায়গা। আমার নামে অনেক মিথ্যে মামলা হয়েছে। একটা মিথ্যে মামলা হয়েছিল একবার। তখন আমাকে হাইডআউটে থাকতে হয়েছিল। আমি ছিলাম প্রথম ৪৯৮-এ একিউজড যাকে আদালত জামিন দিতে বাধ্য হন। ৪৯৮-এ অভিযুক্ত কেউ গ্রেফতার এড়াতে পারে না, কেউ না। আমার এক বান্ধবী আমাকে আশ্রয় দিলেন। আমি গা ঢাকা দিয়েছিলাম। তার মধ্যে আমাদের আইনি লড়াই চলছে। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার আমি ভারতের প্রথম ৪৯৮-এ একিউজড যে জামিন পেলাম। মামলাটা এতটাই মিথ্যে ছিল। সেসময় ছিল আগের সরকারের আমল। আমি লুকিয়ে ছিলাম যাঁর ঘরে- উনি অফিস করতেন, অফিস থেকে ফিরে আমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতেন, এমনকি সিগারেটেরও। আমাদের একটা অদ্ভুত জীবন ছিল তখন। বাইরে যাতে কেউ বুঝতে না-পারে যে ঘরে কেউ আছে সেজন্য চারদিকে থাকতো অন্ধকার। যুদ্ধের সময়কার কারফিউর মতো। সব কালো। এইসময় একদিন একটা চামচিকে ঢুকে পড়ল। আমি স্বাভাবিক যে কোনো লোকের মতোই ভীতু। তবে আমি ভীষণ ভয় পাই চামচিকে আর আরশোলা। ঠিক এই সময়তে হয়ে গেল লোডশেডিং, আর আমার বান্ধবী ঢুকলেন। উনি প্রাণপনে মোমবাতি খুঁজছেন, টর্চ খুঁজছেন। কিচ্ছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যেই রোম্যান্টিক একটা ব্যাপারও ছিল। ঠিক এই সময়টাকে এ্যাড্রেস করে গানটা।” ‘যাবো অচেনায়’ (২০০০) এ্যালবামে ‘হঠাৎ ছুটি’ নামে সেই গানটি: ‘মোমবাতিটা কোথায় গেল, টর্চটা জ্বলছে না, ঘরে হঠাৎ অন্ধকার দৃষ্টি চলছে না, রান্না ঘরে পড়ল বাটি অথচ নেই ঝগড়াঝাঁটি, বাইরে এসো চলে- জানালা দিয়ে একটু আলো আসছে, তা লাগছে ভালো, সন্ধ্যে হলো বলে/ লাইটারের আলোয় খুঁজি, তোমার মুখ ক্লান্ত বুঝি, বয়েস রাখে হাত। ও হাত তুমি ধরেই ফেলো, আজ যখন আলোই গেল একটু পরে রাত/ রান্না থাক ঢাকা, চায়ের লোভে ব্যস্ত থাকা, আমার অবসর… চায়ের পাট তোলাই থাক, কাজের কাজ নিপাত যাক অনেকদিন পর/ অন্ধকারে দুজন একা, কিছুই আর যায় না দেখা, দুজন বসে থাকি… ক্যাবল-ফল্ট ঘটলো কিনা, দুজন আজ তাও জানি না, আসবে কাছে নাকি?/ একটু কাছে আসতে পারো, হঠাৎ ছুটি আজ তোমারও, আর যা কিছু ভুলো। কথার আর কী দরকার, অনেকদিন পরে আবার লোডশেডিং হলো।’ সুমন বলেন, “সুন্দর এই গানটা। যিনি ছিলেন বলে এই গানটা, তিনি আরো সুন্দর। আমার সেই বান্ধবী আগে নিশ্চয়ই প্রেসিডেন্সি কলেজ কাঁপাতেন। আজ তিনি তারচেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। আজ উনি আছেন এই হলে।” উল্লেখ্য, কবীর সুমনই রবীন্দ্রনাথের পর একমাত্রজন যিনি বয়ষ্কদের প্রেম নিয়ে বেশ কয়েকটি গান লিখেছেন।

এরপরের পরিবেশনা ছিল রবীন্দ্রনাথের গান: ‘ব্যাকুল হয়ে বনে বনে, ভ্রমি একেলা শূন্যমনে/ কে পুরাবে মোর কাতর প্রাণ, জুড়াবে হিয়া সুধাবরিষণে।’ তবে শুধু গানটি নয়, এই গানের সুরের সঙ্গে, রাগের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বাংলা সঙ্গীতের সূত্রের ব্যাখ্যাও করেন সুমন। যেখানটায় আছেন বাবা আলাউদ্দিন খান, সঙ্গীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, রবিশঙ্কর, আলি আকবর খান, লক্ষ্ণী শঙ্কর। কবীর সুমন বলেন, “রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবন প্রেম ইত্যাদি নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা, আগ্রহ, কৌতুহলের শেষ নেই। অথচ কী ভাবে রবীন্দ্রনাথ সুর করতেন কোনও লেখায় আছে কি? কাউকে কিছু বলে গিয়েছেন কি? তা লিপিবদ্ধ হয়েছে কি কোথাও? কোনও সুর মাথায় এলে তিনি স্বরলিপি করে রাখার জন্য কাউকে ডেকে নিতেন বলে শুনেছি। কী ভাবে সুর করতেন তা কি কেউ জানেন? কীভাবে তিনি পাশ্চাত্যের সুর, লোকায়ত সুর, হিন্দুস্তানি রাগসঙ্গীতের সুর মেশাতেন তা কি কেউ জানেন?

“রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে গানবাজনার চল ছিল রীতিমতো। রাগসংগীত, কালোয়াতি গান যেমন হতো, তেমনই বাজত পিয়ানো। বাড়িতে বসেই তিনি পিয়ানোয় রাগভাঙা সুরের নমুনা শুনতেন। দেশি সংগীতের পাশাপাশি পাশ্চাত্যের গানবাজনাও ছেলেবেলাতেই যথেষ্ট শুনেছিলেন। শ্রুতিধর ছিলেন তিনি। শ্রুতিধর না হলে ভাল সংগীতশিল্পীও হওয়া যায় না, ভাল সুরকারও হওয়া যায় না। বেশ অল্প বয়সে তিনি ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’য় ‘এনেছি মোরা, এনেছি মোরা’র প্রথম লাইনটির সুর ‘হি ইজ আ জলি গুড ফেলো’ গানের সুরে বানিয়ে নিয়েছিলেন। এ জন্য তাঁকে বিলিতি গানের শাস্ত্র বা হ্যান্ডবুক পড়তে হয়েছিল, মনে হয় না। এ সুর শুনে বানানো। রবীন্দ্রনাথের অল্পবয়সের (১৯ বছর) কাজ ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’তেই বাল্মীকির কণ্ঠে একটি গান আছে: ‘ব্যাকুল হয়ে বনে বনে।’ শ্রোতাদের কাছে আমার অনুরোধ: এই গানটি শুনুন, তার পর আচার্য আলি আকবর খান ও আচার্য রবিশঙ্করের ‘মাঁজ খামাজ (খাম্বাজ)’ রাগে যুগলবন্দিটি শুনুন। এই ‘ইপি’ (এক্সটেন্ডেড প্লে) রেকর্ডটি এইচএমভি বের করেছিলেন বিশ শতকের ষাট দশকের একেবারে গোড়ায়, ৪৫ আরপিএম-এর গ্রামোফোন রেকর্ড তখন সবে বেরোচ্ছে ভারতে। ইউটিউবে খুঁজলে হয়তো আজও পাওয়া যাবে। শ্রোতারা লক্ষ করতে বাধ্য ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’র গানটির স্থায়ীর সঙ্গে সেতার-সরোদে বাজানো গৎ-এ সুরে কতটা মিল। মনে হবে স্বরগুলি যেন রবীন্দ্রনাথের সুরের ছাঁদেই বসানো। গৎ-এর এক মোক্ষম জায়গায় তীব্র মধ্যম স্বরটি ধারালো ছুরির মতো বুকে এসে লাগে যদি শোনার কান থাকে। রবীন্দ্রনাথের সুরেও প্রথমে শুদ্ধ মধ্যম থাকলেও ‘কে পুরাবে মোর কাতর প্রাণ’-এর ‘বে’-তে কী অমোঘ ভাবে রয়েছে তীব্র মধ্যম। সব মিলিয়ে বিবেচনা করলে মনে হতে পারে আলাউদ্দিন খান যে ‘মাঁজ খামাজ’ রাগটি সৃষ্টি করেছিলেন, তার সূত্র ছিল রবীন্দ্রনাথের এই গানে। আবার এমনও হয়ে থাকতে পারে যে, তাঁরা দুজনেই স্বাধীনভাবে ওই বিশেষ স্বরবিন্যাসটি ভেবে ভেবে তৈরি করে নিয়েছিলেন। সংগীতাচার্য হয়তো জানলেনই না, যে-রাগটি তিনি গড়ে নিলেন বলে ভাবলেন তার পূর্বাভাস, এমন কী মোটামুটি গোটা রূপটাই ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’র একটি গানে ধরা আছে। লিখিত প্রমাণ যখন নেই, জোর দিয়ে কিছু বলারও জো নেই।

“দক্ষিণ ভারতীয় এক বøগে পড়েছি, অনেক সময় অনেক রাগ কোনো গানের সুর থেকে আসে। এবং এটা বোধহয় তার একটা। রবীন্দ্রনাথের ‘ব্যাকুল হয়ে’ গানটা না হলে হয়তো ‘মাঁজ খামাজ’ রাগটাই আমরা পেতাম না। আমার তো সেই কম্পিটেন্স নেই। আজ যদি আচার্য রবিশঙ্কর থাকতেন বা আলি আকবর থাকতেন বা জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ থাকতেন, ওঁরা হয়তো বলতে পারতেন। তবে এই পুজোর মধ্যেই কিন্তু আপনারা ঐ ‘মাঁজ খামাজ’ রাগে ১৯৬৮ সালে রেকর্ডকৃত আচার্য বড়ে গোলাম আলি খান সাহেবের গাওয়া ‘প্রেম আগন জিয়ারা’ ঠুমরিটি শুনে ফেলবেন। সে যে কী সুন্দর!” এ পর্যায়ে সুমন ‘মাঁজ খামাজ’ এর সুরে সঙ্গীতাচার্য রবিশঙ্করের কম্পোজিশনে, শ্যামল গুপ্তর লেখায় ১৯৬০ সালে রেকর্ডকৃত লক্ষ্ণী শঙ্করের গাওয়া ‘মায়াভরা রাতি সাথীহারা চলে যায়’ গেয়ে শোনান।

এরপর একে একে ‘বসে আঁকো’ (১৯৯৩) এ্যালবামের হঠাৎ রাস্তায়, ‘গানওলা’ এ্যালবামের গানওলা ও ‘জাতিস্মর’ এ্যালবামের (১৯৯৭) বিদায় পরিচিতা গেয়ে শোনান সুমন। ‘বিদায় পরিচিতা’ বব ডিলানের ‘ফেয়ারওয়েল এ্যাঞ্জেলিনা’ গানটি অবলম্বনে। সেই গানেরও খানিকটা গেয়ে শোনান তিনি।

‘বসে আঁকো’ এ্যালবামের ‘রেখাবের রূপ’ ছিল তারপরের পরিবেশনা। এ গানটি নিয়ে ‘সুমনের গান, সুমনের ভাষ্য’-তে সুমন লিখেছেন, “যোগিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অদ্ভুত। রাগটি আমি কখনোই খুব বেশি গাইনি। কিন্তু যখনই রেয়াজের ছকে গেয়েছি, এক অদ্ভুত অবর্ণনীয় নির্জনতা ও গভীরতার স্বাদ পেয়েছি। ভীমসেন যোশীকে একাধিকবার গাইতে শুনেছি যোগিয়া। তাঁর গায়কি শুনে আমার মনে হয়েছে- তারসপ্তকে কণ্ঠটাকে বিস্তৃত ক’রে তিনি যেই কোমল রেখাবে এসে ভিড়ছেন, অমনি যেন তিনি খুঁজে পাচ্ছেন অনেককালের চেনা বন্দর। বন্দর ব’সে ছিল নাবিকের অপেক্ষায়। নাবিক তাঁর নিঃসঙ্গতা নিবেদন করছেন, একাকিত্ব দিয়ে স্পর্শ করছেন বন্দরটিকে। এই কোমল রেখাবের ঘাটে শ্যাওলার মতো লেগে রয়েছে তাঁর কতকালের স্মৃতি। বয়স হয়েছে শিল্পীর। এই বয়সেও তাঁর রসিক, প্রেমিক মনটি কিন্তু যোগিয়ায় রেখাবের রূপে মজতে রাজি। এইসব ভাবনা থেকে একদিন সকালে রেয়াজ করতে করতে লিখে ফেলেছিলাম গানের প্রথম দুটি লাইন। সুর দিতে গিয়ে যোগিয়ার সঙ্গে বসন্ত মুখারী রাগটিও এসে পড়ল।”

এরপর ‘ইচ্ছে হল’ এ্যালবামের ললিত রাগে ‘জাগে জাগে রাত’ পরিবেশন করেন সুমন। এ গানটি নিয়ে ‘সুমনের গান, সুমনের ভাষ্য’-তে কবীর সুমন লিখেছেন, “ছেলেবেলা থেকে লক্ষ্য করে আসছি, রাগভিত্তিক ও বড় তালভিত্তিক বাংলা গানের কথা। বড় বেশি আলঙ্কারিক, সাবেক-সাবেক। রবীন্দ্রনাথ যেটাকে ‘ক্লাসিকিয়ানার মোহ’ বলেছেন সেই বস্তুটি এই ধরনের বাংলা গানের কথায় খুব বেশি পাওয়া যায়। এক সময়ে, দীর্ঘকাল খেয়াল শেখার পর যখন কী গাইছি-কেন গাইছির চোটে নাজেহাল হয়ে উঠেছিলাম, খেয়ালের ‘বন্দিশ’গুলোকে যখন একেবারেই মেনে নিতে পারছিলাম না, তখন আধুনিক বাংলা ভাষায় খেয়ালগানের উপযুক্ত লিরিক লেখার চেষ্টা করছিলাম তেড়েফুঁড়ে। আমার কাছে চ্যালেঞ্জটা ছিল এইরকম: ছোট খেয়াল বা ছোট রাগপ্রধান গানের আঙ্গিক যেমন হয় সেই আঙ্গিকেই কিছু আধুনিক গান লিখতে বাঁধতে হবে। কাঠামো আর চলন এমন হবে যে অল্প কিছু স্বরবিস্তার, সরগম এমনকি ছোট তানও সে-গানে যোগ করা যাবে। কিন্তু লিরিকের ভাষা, আঙ্গিক হবে আধুনিক, সমকালীন।এই চ্যালেঞ্জের সামনে আমি নিজেই নিজেকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম ১৯৭২/৭৩ সালে। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত আমীর খানের খেয়ালই আমাকে ঘিরে রেখেছিল। তাঁর গায়কি, আঙ্গিকই আমায় ভাবিয়ে তুলেছিল, প্রশ্ন করতে উত্তর খুঁজতে শিখিয়েছিল। ১৯৯৩ সালে একদিন আলাপ হলো কবি, চলচ্চিত্রকার, সঙ্গীতবোদ্ধা আয়ান রশিদ খানের সঙ্গে। রশিদ একদিন বললেন, ‘ভীমসেন যোশীর কথা বললে তোমার গানে, কই আমাদের গুরুর কথা তো বললে না।’ আড্ডার ছলে বলা কথাটা কোথায় যেন গিয়ে লাগল। আমীর খানের নাম উল্লেখ করাটা তেমন কোনো ব্যাপার নয়। ১৯৮৬ সালে বাঁধা একটি গানে তাঁর নাম আছে? সেটাও বড়ো কথা নয়। আসল কথাটা হ’ল কোনো রাগের আবহে তাঁর প্রসঙ্গ আনা। চিন্তাটা আগেই ছিল ভাসাভাসা, রশিদের কথা শুনে চিন্তাটা নিল পরিকল্পনার রূপ।” কবীর সুমন বলেন, ‘রেখাবের রূপ’ ও ‘জাগে জাগে রাত’ তাঁর খুব প্রিয় গান। ললিত রাগে আধুনিক বাংলা গান ‘জাগে জাগে রাত’ একটা পূর্ণাঙ্গ খেয়ালও। সুমন বলেন, খেয়াল গান বা বন্দিশ যদি স্ট্যান্ড-এলৌন গান হিসেবে না-দাঁড়াতে পারে, সেটা খেয়াল হিসেবেও দাঁড়াবে না। এজন্যই মানুষ খেয়াল শোনে না। তাঁর বাংলা খেয়াল তৈরির তত্ত¡ই হচ্ছে – বাংলা খেয়ালকে নিজের জোরে একটা স্বাধীন গান হয়ে উঠতে হবে।
উল্লেখ্য, কবীর সুমন ২০১৫ সাল থেকে নিয়মিত বাংলা খেয়াল রচনা করছেন, গাইছেন, শেখাচ্ছেন, বই লিখছেন। তিনি প্রাণপনে চেষ্টা করে চলেছেন বাংলা খেয়ালকে ‘সাবেকিয়ানা’ ও ‘ক্লাসিকিয়ানা’র মোহের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করতে। বাংলা ভাষায় খেয়ালের প্রবল বিরোধিতা সত্তে¡ও তিনি বাংলা খেয়াল নিয়ে তাঁর লড়াই জারি রেখেছেন। তিনি এ পর্যন্ত ছয়শো’রও বেশি বাংলা খেয়াল গান রচনা করেছেন, এখনো রচনা করে চলেছেন। নিজে নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন। সংগ্রহ করেছেন প্রায়-বিস্মৃত কয়েকশো বাংলা খেয়াল। যেসব রাগে বাংলা খেয়াল তো দূরের কথা, কোনো খেয়ালই রচিত হয়নি, তেমন বেশ কয়েকটি রাগে (বাঁশির যাদুকর সঙ্গীতাচার্য পান্নালাল ঘোষ সৃষ্ট নূপুরধ্বনি ও দীপাবলী রাগ) তিনি বাংলা খেয়াল গান লিখেছেন।

মিনিট বিশেকের বিরতির পর কবীর সুমন ‘গানওলা’ এ্যালবামের নদীর গল্প ও ‘চাইছি তোমার বন্ধুতা’ (১৯৯৬) এ্যালবামের ‘একলা হতে চাইছে আকাশ’ গেয়ে শোনান। এরপর কোনোরকম যন্ত্রানুসঙ্গ ছাড়া, একদম খালি গলায় সুমন গান ‘তোমায় ছাড়াই বাঁচবো আমি, যেমন বাঁচে মাতৃহারা/ গিরগিটিটা কিলবিলিয়ে, যেমন বাঁচে গাছের চারা।’ সুমন বলেন, “এই যে ভাষাটা, বাংলার পল্লীগীতি ছাড়া আর কোনো গানে এরকম কথা দিয়ে আর কেউ লিখতে পারেনি। আমি আগে গান লিখি, পরে সুর করি। এই সুর বাংলার পল্লীগানের সুর। পল্লীগীতি ধরনের সুর ছাড়া এরকম কথাকে ধরতে পারবে না কেউ।” সুমন বলে থাকেন, তাঁর আধুনিক গানে পশ্চিমা সুর বা পশ্চিমা শিল্পীর চেয়ে কীর্তন রামপ্রসাদীসহ বাংলার লোকায়ত সঙ্গীতের প্রভাব অনেক বেশি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যে বাঙালি বাংলার লোকগান ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারবে, সেই বাংলা আধুনিক গান গাইতে পারবে। কবীর সুমনও এই কথা আপ্তবাক্যের মতো বিশ্বাস করেন, ধারণ করেন। সুমন এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, পল্লীগান ‘তোমার মতো দয়াল বন্ধু’র টিউনের ছোঁয়া আছে ‘তোমায় ছাড়া বাঁচব আমি’ গানটিতে।

‘তোমাকে চাই’ এ্যালবামের ‘তোমাকে চাই’ ছিল তারপরের পরিবেশনা। ‘সুমনের গান, সুমনের ভাষ্য’-তে সুমন লিখেছেন, “ভীষণ আত্মিক সংকটের মধ্যে কাটছিল কিছুদিন। কোথাও কোনো অবলম্বন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আশ্রয় খুঁজছিলাম। ছেলেমানুষের মতো ভালবাসা চাইছিলাম। ১৯৮৬ সালের গোড়ার দিকের কথা। নানান কারণে আমাদের গানবাজনার দল ‘নাগরিক’-এ তখন ভাঙন ধরেছে। পাঁচটা বছর আমেরিকায় বহু পরিশ্রম করে, নিজের ভবিষ্যতের কথা একটুও না ভেবে, টাকাপয়সা একটুও না জমিয়ে, শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি যন্ত্র কিবোর্ড সিন্থেসাইজার এইসব নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছি। নতুন বাংলা গান বাঁধব, ‘নাগরিক’ এর ছেলেমেয়েদের শেখাব- এই ভেবে। দলে ফাটল দেখা দিল। নিকারাগুয়ায় যা দেখে শুনে চেখে জেনে এসেছি তার ঠ্যালায় আমার অনেকদিনের ভাবনাচিন্তার খোল নলচে পালটে গিয়েছিল। সেখান থেকে এসে পড়লাম আবার মধ্যবিত্ত গ্লানিতে, সংকীর্ণতায়, তুচ্ছতায়। এমনই এক মুহূর্তে একদিন কাগজে হিজিবিজি লিখতে লিখতে বেরিয়ে এল চারটি লাইন। মনে হলো যেন প্রেমের গান লিখছি। আরও চার লাইন। এত ভয়ঙ্করভাবে যাকে চাইছিলাম, সে এবার আমায় আর আমার গানটাকে দখল ক’রে বসল। ‘কবেকার কলকাতা শহরের পথে’ লেখার মুহূর্ত থেকে আমার স্পষ্ট মনে হলো, গানটা আর ঠিক আমার হাতে নেই। সকালের কৈশোরে তোমাকে চাই- এই লাইনের সুর রবীন্দ্রনাথের সুরের বৈশিষ্ট্য ঘেঁষা।” উল্লেখ্য, পরবর্তীতে সুমন কোনো এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘তোমাকে চাই তোমাকে চাই’ এই সুর ‘হরি বোল হরি বোল’ এর সুরের আদলে। কলা মন্দিরের সন্ধ্যায় সুমন বলেন, “কী প্রেম! কী প্রেমে যে পড়েছিলাম একটা সময়! আমি যখন প্রেমে পড়ি তখন সজোরে পড়ি। তখনো চিঠির যুগ। রোজ চিঠি লিখতাম একটি মেয়েকে। আমার বাড়ির পাশের রাস্তাতেই থাকতেন সেই কন্যে। এই গানটা ওকে লিখছি। ‘ও’ কথাটা ভারী সুন্দর। ওকে লিখছি- প্রথমত আমি তোমাকে চাই/ দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই/ তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই/ শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই। তবে ‘কবেকার কোলকাতা শহরের পথে’- ঐখানে যখন এলাম, মেয়েটি হারিয়ে গেলেন। মেয়েটির নাম ছিল সুপ্রিয়া। মেয়েটি আর নেই। পুরো জিনিসটা হয়ে গেল কোলকাতা।” এই গানটিতে সুমনের সঙ্গে গলা মেলান কলা মন্দির প্রেক্ষাগৃহের সমস্ত শ্রোতা-দর্শক। ‘তোমাকে চাই’ অন্য যন্ত্রানুসঙ্গ ছাড়া শুধু কিবোর্ড বাজিয়ে গান সুমন। গানে সলিল চৌধুরীর নাম এলে, সলিল চৌধুরীর ‘আজ তবে এইটুকু থাক’ গানটির খানিকটা গেয়ে ওঠেন তিনি? উল্লেখ্য, কবীর সুমন বাংলা আধুনিক গানে, বিস্মৃতপ্রায় অসামান্য শিল্পী অখিলবন্ধু ঘোষ, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, পান্নালাল ঘোষ সহ আরো অনেককেই আবার প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন। তাঁর লেখা অসংখ্য আধুনিক বাংলা গানে এসেছে সঙ্গীতের পূর্বসূরিদের কথা। হিন্দি বন্দিশেও পূর্বসূরীদের নাম নেই। কিন্তু সুমনের লেখা খেয়াল গানে আমাদের সঙ্গীতের অনেক পূর্বসূরীদের কথা এসেছে।
এরপর কবীর সুমন ‘তোমাকে চাই’ এ্যালবামের ‘পেটকাটি চাঁদিয়াল’ গানটি গেয়ে শোনান। সুমন বলেন, এই গান লেখার আইডিয়া তিনি পেয়েছেন শ্রী শুভেন্দু মাইতির কাছ থেকে। ‘তোমাকে চাই’-এর ২৫ বছর পূর্তিতে কলকাতার এক টিভির অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধেয় শুভেন্দু মাইতি সুমনের উপস্থিতিতেই সুমনের এই গান লেখার গল্পটা বলেন- “বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আমি স্টুডিও থেকে বেরিয়ে রিক্সায় উঠেছিলাম? হঠাৎ খেয়াল করলাম, যে ছেলেটা রিক্সা চালাচ্ছে সে প্যাডেলে পা পাচ্ছে না, বাচ্চা একদম। আমার এত কষ্ট হয়েছে যে আমি সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়েছি। নেমে পাঁচটা টাকা ওকে দিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছি। ওটা দেখে ভেতরে যে কষ্ট হয়েছে, তাই নিয়ে একটা গান লেখার চেষ্টা করেছিলাম, পারলাম না। দুপুরে না খেয়েই আমি সুমনের কেদার বোস লেনের বাসায় গিয়ে তাঁকে বললাম, এরকম একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছি, খুব কষ্ট হয়েছে। আমি তো পারলাম না লিখতে। তুমি লিখো। সুমন ১০ মিনিট সময় নিয়েছিল গিটারটা নিয়ে গানটা তৈরি করতে।” সুমনও কলা মন্দিরের সন্ধ্যায় এই গল্প ব’লে শুভেন্দু মাইতি সম্পর্কে বলেন, “শুভেন্দু মাইতির মতো ওরকম গানপাগল, গানরসিক, প্রাণবন্ত মজার লোক আমি খুব কম দেখেছি। উনি একটি বামপন্থী দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে ছিলেন। সেই দলের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাতে শুভেন্দু মাইতির কিছু যায় আসেনি। উনি ‘পেটকাটি চাঁদিয়াল’ ছাড়াও আরো কত গান তৈরির যে চমৎকার আইডিয়া দিতেন! শুভেন্দু দা আজ অসুস্থ। আজ এই অনুষ্ঠান দেখতে পেলে কত যে খুশি হতেন তিনি!” উল্লেখ্য, সুমনের ‘তোমাকে চাই’ প্রকাশে শুভেন্দু মাইতির ইতিবাচক ভূমিকা ছিল এবং তিনি ‘তোমাকে চাই’ এর গানগুলো রেকর্ডিং এর পুরোটা সময় নিজে উপস্থিত ছিলেন।
‘ইচ্ছে হল’ এ্যালবামের ‘বাঁশুরিয়া’ ছিল তারপরের পরিবেশনা। সুমন বলেন, “সেদিনটা ছিল আষাঢ়স্য প্রথম দিবস। আষাঢ়র প্রথম দিন। ৯২ সাল। আমরা থাকতাম ভবানীপুরের একটা ভাড়া বাড়িতে। সেই বাড়ির সামনে কিছু হিন্দুস্তানি থাকতেন। তাঁরা ছিলেন মোটর মেকানিক, কেউ কেউ ট্যাক্সি ড্রাইভার। খুব কজমপলিটন একটা পাড়া। ওঁরা হিন্দিতেই কথা বলতেন। হঠাৎ বৃষ্টি পড়া শুরু হলো সকালবেলা। যেই না বৃষ্টি পড়া শুরু হলো, পরিষ্কার শুনতে পেলাম এক বিহারি ভাই বাংলায় বলছেন, ‘এখন সকাল নটা। বৃষ্টি পড়ছে। আমি আজ কিছুতেই কাজে যাব না?’- এই ঘোষণাটি শুনতে পেলাম। এবং তার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাঁশির সুর। ওদের মধ্যে একজন বাঁশি বাজাতেন। আমার মনে হলো এই কথা যিনি আজ বলতে পারেন ঐ বাঁশিটি আজ তিনিই বাজাচ্ছেন। আমি এটা শুনলাম আর গানটা তৈরি করলাম। যদি ওনার সেই বাঁশি শুনতে না পেতাম, আর বিশেষ করে ঐ কথাগুলো, তাহলে বাঁশুরিয়া তৈরি হ’তো না।”

এরপর সুমন গান ‘তোমাকে চাই’ এ্যালবামের ‘আমাদের জন্য।’ এবং শ্রোতা-দর্শকের বিশেষ অনুরোধে দ্বিতীয়বারের মতো সুমন সহ সবাই মিলে ‘তোমাকে চাই’ গেয়ে শেষ হয় সেদিনের মতো পরিবেশনা।

কলা মন্দিরে ‘কবীর সুমন একক’ অনুষ্ঠানে গিটার বাদনে ছিলেন ‘নাগরিক’ দলটির সময় থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে কবীর সুমনের গানবাজনার সহশিল্পী ধ্রুব বসু রায়। তবলায়-পারকাশনে ছিলেন ইন্দ্রজিৎ প্রধান। স্বরমণ্ডলে শিল্পী রাকা ভট্টাচার্য। কিবোর্ড বাজিয়েছেন কবীর সুমন নিজেই। অনুষ্ঠানে আলোর দায়িত্বে ছিলেন কবীর সুমনের অনুষ্ঠানে আলোর শিল্পী, ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানগুলোর সাক্ষী, প্রথিতযশা নাট্যকর্মী পিনাকী গুহ।
আধুনিক বাংলা গানে নিজ অবস্থান নিয়ে খুব স¤প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় কবীর সুমন বলেছেন, “আমি নাম করে গিয়েছিলাম আধুনিক বাংলা গানের জন্য। এই আধুনিক কথাটার মধ্যে একটা সমকালীনতার গন্ধও আছে? কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় যে, সমকালীনের চেয়ে যেটা সমকালীন নয়, তার আধুনিকতা বেশি। যেমন ধরুন রবীন্দ্রনাথের গানে কিংবা অতুল প্রসাদ সেনের কিছু গানের আধুনিকতা কিন্তু আজকের চেয়ে বেশি। ইটালির খুবই নামকরা সঙ্গীতকার জোসেফ ভেরদি বলেছিলেন, ‘আসো, আমরা পেছনের দিকে ফিরি। সেটাই হবে অগ্রগতি।’ ইদানিংকালে বাংলা গান যেদিকে যাচ্ছে, যেদিকে গেছে, কেউ কেউ এটা নিয়ে খেদ করেন। আমার মনে হয় সেটা উচিত না। তার কারণ হচ্ছে, প্রত্যেক যুগ তার মতন ক’রে ভাষাকে ধরে নেবে, সুরকে ধরে নেবে, আঙ্গিককে ধরে নেবে। তাহলে আমি কোন জায়গায় আছি? আমি আজকের গানই গাইব। কিন্তু আজকের গান মানে এই নয় সবসময় যে আজকের কথা দিয়ে। আজকের এই যে আমিটা তার মাথার মধ্যে তো অনেক কাল রয়েছে। তাহলে আমার আধুনিকতাটা কোথায়? আমি বলব, আমার মতো লোকের আধুনিকতা হচ্ছে আঙ্গিকে। অর্থাৎ যে ধরনের আধুনিক বাংলা গানের আবহে আমার জন্ম, আমার হয়ে ওঠা, আমার বড়ো হওয়া এবং বুড়ো হওয়া- এই আধুনিকতাটা। তার মধ্যে সমকালীনতাও আছে।”
কলা মন্দিরের অনুষ্ঠানের আগের দিন সুমন লিখেছেন, “এই মাপের অনুষ্ঠান এটাই সম্ভবত শেষ। বাংলা খেয়ালের জন্য বেঁচে আছি। আধুনিক গান আমি এখনও বাঁধি। কিন্তু এত বড় মাপের আধুনিক গানের একক আর বোধহয় পেরে উঠব না। মিশ্র হতে পারে। বাংলা খেয়ালের সঙ্গে, যেমন। বা, আমার স্মৃতি থেকে গানের পর গান। এখনও খাতা না দেখে। অন্য সুরকারদের রচনা।”

কলা মন্দিরে কবীর সুমন বেশ কয়েকটি একক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। সেই কলা মন্দির নিয়ে স¤প্রতি সুমন বলেছেন, “কলা মন্দিরের সমস্ত ইটে, তার সবকিছুতে রয়েছে এই পৃথিবীর সেরা কিছু শিল্পীর কাজ। এই কলা মন্দিরে আমার অনুষ্ঠান, একসময় ভাবতে পারতাম না! এখনও অস্বস্তি হয়। কেন? মনে আছে এই প্রথম শুনলাম সুহাগ ভাঁয়রো। বাজালেন আচার্য আমজাদ আলি খান সাহেব সরোদে। তারপরে আর শুনিইনি। কলা মন্দিরে। রামকেলিতে শুদ্ধ ধৈবত। কী সুন্দর! প্রথম শুনছিলাম। কলা মন্দিরে রামকেলিতে শুদ্ধ ধৈবত এখনো বেজে চলেছে। সুহাগ ভাঁয়রো। ঐখানে আশাবরী রাগে কোমল ঋষভ করছেন আমির খান। ঐখানে রাগেশ্রীতে ৩/৪টি পর্দার মধ্যে দেড় ঘণ্টা ধরে আশ্চর্যভাবে বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন বিলায়েত খান সাহেব। ঐখানে আমার হয়ে ওঠার একটা আস্ত কাহিনি রাখা আছে। এখনও সেই স্মৃতি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেইখানে। এইতো আর কিছুকালের মধ্যেই আমি থাকব না। অন্যরা আসবে। কিন্তু কলা মন্দির থাকবে। আমার ভয় হয়, কলা মন্দিরের অঙ্গহানি হবে না তো? যেভাবে আমাদের হয়ে চলেছে, যেভাবে পৃথিবীর হয়ে চলেছে, যেভাবে আমাদের সঙ্গীতের হয়ে চলেছে।”

‘কবীর সুমন একক’ মানেই একটা অসামান্য কিছু। সেদিনও তার ব্যত্যয় হয়নি। কলামন্দিরের প্রেক্ষাগৃহ ৩০শে সেপ্টেম্বর ছিল কাণায় কাণায় পূর্ণ। কবীর সুমন প্রতিটি গান ধরতেই করতালিতে ফেটে পড়েন শ্রোতা-দর্শক। আবার কখনো সুমনের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান তাঁরা। বাংলাদেশ থেকেও সুমন-অনুরাগীরা এসেছেন গান শুনতে। কখনো গানে, কখনো কথায়, কখনো হাস্যরসে ৭৩ বছরের কবীর সুমনের আশ্চর্য পরিবেশনা প্রত্যক্ষ করেন হলভর্তি মুগ্ধ শ্রোতা-দর্শক। প্রত্যক্ষ করে কলা মন্দিরও, আর সাক্ষী হয়ে থাকে কলা মন্দির আরেক নতুন ইতিহাসের। সুহাগ ভাঁয়রো, আশাবরী, রাগেশ্রীর সঙ্গে কবীর সুমনের গাওয়া গানও ঘুরে ঘুরে বেড়ায়-বেড়াবে কলা মন্দিরে
কবীর সুমনের জন্য ভালোবাসা।
সঙ্গীত বেঁচে থাক কবীর সুমন হয়ে।