ফরিদ আহমেদ : ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। একদিন তিনি তাঁর যা কাজ, সেই কাজটাই করছিলেন। স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষার একটি ক্লাসে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াচ্ছিলেন। কিন্তু কয়েকজন ছাত্র বারবার অপ্রাসঙ্গিকভাবে সেখানে ধর্মের প্রসঙ্গ তুলে আনছিলো। তিনি ঠাণ্ডা মাথায় ছাত্রদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে বিজ্ঞান আর ধর্ম, সম্পূর্ণ দু’টো আলাদা বিষয়। একটা গড়ে উঠেছে বিশ্বাসের উপরে, আরেকটার ভিত্তি হচ্ছে যুক্তিতর্ক এবং প্রমাণ।
ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর সেই একাডেমিক ডিবেটকে গোপনে ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ফলে, এ নিয়ে তৈরি হয় উত্তেজনা। তিনি ধর্ম অবমাননা করেছেন এমন একটা অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে মামলাও করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গত ২২শে মার্চ গ্রেপ্তারের পর গত সপ্তাহে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালত দুই দফায় তার জামিনের আবেদন নাকচ করেছে। রবিবার দুপুরে সংক্ষিপ্ত শুনানির পর পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকায় আদালত জামিন মঞ্জুর করেন। বিকালে জামিনের আদেশ কারাগারে পৌঁছানোর পর তাকে মুক্তি দেয়া হয়।। এই জামিনও তিনি হয়তো পেতেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত তৈরি হয়। সেই জনমতের চাপেই সরকার বাধ্য হয় তাঁকে জামিন দিতে। উনিশ দিন কারাভোগের পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন তিনি।
কারাগার থেকে মুক্তির পর হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তিনি নিরাপত্তা চান। তবে শুধু তার বেলায় নয়, বাংলাদেশের আর কোন শিক্ষকের ক্ষেত্রে, কোন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও যেন এমন ঘটনা আর না ঘটে।
বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। বিষয়টা কিছুটা স্বস্তির, তবে পুরোপুরি আশ্বস্ত হবার মতো কিছু না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁকে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। ফলে, জনমতের চাপে সরকার তাঁকে আপাত মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু, এটা সমস্যার স্থায়ী সমাধান না। ক্ষতে প্রলেপমাত্র। আসল সমস্যা রয়ে গিয়েছে অক্ষতভাবে। সেটাকে মেরামত করতে না করতে পারলে বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষা এক অন্ধকার আবর্তের মধ্যে পড়ে যাবে।
বাংলাদেশে এখন অদ্ভুত এক ধরনের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। উঠতি বয়সী ছেলেরা রাত জেগে ওয়াজ শোনে। সেইসব ওয়াজে হুজুররা তীব্র ভাষায় বর্ণনা করেন যে ধর্মগন্থের পাতায় পাতায় বিজ্ঞান ছড়িয়ে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা যা যা আবিষ্কার করছেন, তার সবকিছুই উপস্থিত রয়েছে পবিত্র গ্রন্থের আয়াতের মধ্যে। এগুলো শুনে শুনে এইসব ছেলেপেলেদের ধারণা জন্মে গিয়েছে যে কোরান হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানময় কিতাব। নবী মোহাম্মদ হচ্ছেন সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানী। ফলে, পৃথিবীর অন্য কোনো বিজ্ঞানকে তারা আর পাত্তা দিতে চায় না, বরং পুরোপুরি অস্বীকার করে।
এখন এই নব্য প্রাপ্ত জ্ঞান নিয়ে এইসব নবীনেরা যদি শ্রেণীকক্ষে বিজ্ঞানের শিক্ষককে চ্যালেঞ্জ করে বলে, ‘কোরানের মধ্যে কি সব বিজ্ঞান নেই? নবী মোহাম্মদ কি সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী না?, তাহলে সেই প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষক কী বলবেন? ‘হ্যাঁ’ বললে মিথ্যে বলা হয়, না বললে ধর্ম অবমাননা করা হয়।
ধর্মপ্রাণ মুসলমান যাঁরা আছেন, তাঁরা একবার চিন্তা করেন বিষয়টা। শিক্ষাঙ্গনে কতোখানি বৈরী পরিবেশ তৈরি হতে যাচ্ছে বিজ্ঞানের শিক্ষকদের জন্য।
যাঁরা ধর্ম পালন করেন মনের শান্তির জন্য, তাঁদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র কোনো বিরূপ ধারণা নেই, নেই কোনো আক্রোশ কিংবা অশ্রদ্ধা। একজন ব্যক্তি তাঁর নিজস্ব শান্তির জন্য অন্যের অসুবিধা না করে যা খুশি করার অধিকার রাখেন। ধর্মপালনও তার মধ্যে একটা। এতে সমস্যা নেই কোনো, নেই কোনো আপত্তিও।
সমস্যা তৈরি হয় তখনই, যখন সেই ধর্ম ব্যক্তিজীবন ছেড়ে সমাজ জীবনে এসে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। রাজনীতিকে প্রভাবিত করে, সংস্কৃতিকে গ্রাস করে নিতে চায় কিংবা বিজ্ঞানকে আবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালায়। ধর্মের ক্ষেত্র এগুলো নয়। এগুলোর উপরে আগ্রাসন চালানো মানে ধর্ম তাঁর গণ্ডির বাইরে এসে অনাহুত হস্তক্ষেপ করছে।
কোরান বা বেদে যদি সব বিজ্ঞান ঠেসে দেওয়া থাকতো, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্য বই পড়ানোর প্রয়োজন পড়তো না। কোরান, বাইবেল, বেদ পড়েই মানুষ সব বিজ্ঞান জেনে যেতো। ধর্মীয় শ্লোক বিশ্লেষণ করেই বিজ্ঞানীরা সবকিছু আবিষ্কার করে ফেলতে পারতেন। বাস্তবে তা হয়নি। পৃথিবীর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এইসব ধর্মগ্রন্থকে বিজ্ঞানের বই বলে স্বীকৃতি দেয়নি। দেয়নি ঈর্ষার কারণে নয়, কিংবা সংকীর্ণতার কারণেও নয়। দেয়নি এ কারণে যে, এইসব বই পড়ে কেউ বিজ্ঞানী হয়েছে কিংবা বিজ্ঞানের কোনো আবিষ্কার করেছে এমন ইতিহাস নেই। কোনো বিজ্ঞানী কখনো বলেননি যে আমি ধর্মগ্রন্থের শ্লোক পড়ে এই আবিষ্কারগুলো করেছি। সব আবিষ্কারের কাহিনিই ধর্মীয় বইতে পাওয়া যায়, তবে সেটা আবিষ্কার হবার পরে। কোনো কিছু আবিষ্কার হবার আগ পর্যন্ত ধর্মীয় গ্রন্থগুলো একেবারেই নিশ্চুপ থাকে। সরব হয় আবিষ্কার হয়ে যাবার পরে।
বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে আজ অকারণে যে হয়রানিটা করা হয়েছে, অপরাধী সাজানো হয়েছে, আটক করা হয়েছে, তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিপন্ন করা হয়েছে, এর জের বাংলাদেশ টানবে বহুকাল। এখন কোনো শিক্ষকই বুকে জোর নিয়ে শুধু বিজ্ঞানের কথা বলতে পারবেন না। তাঁদেরকে এর সাথে ধর্মকে মিশিয়ে নিতে হবে। সেটা তখন আর বিজ্ঞান থাকবে না, হয়ে উঠবে অপবিজ্ঞান।
বাংলাদেশের মানুষদের ঘাড়ে এই অপবিজ্ঞানই ভর করবে অচিরে। আর, এর মাধ্যমে তৈরি হবে সব ঊন-মানব।