ভজন সরকার : ধর্ম হলো জনপ্রিয়তা অর্জনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার; ধর্ম বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফ্যান্টাসি। আর প্রতিটি ধর্মগ্রন্থে এই ফ্যান্টাসিকে এমন ভাবে উপস্থাপান করা হয়েছে যে, মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে এতে বুদঁ হয়ে থাকে। ফ্যান্টাসি গল্পের মতোই ধর্মে স্রষ্টা এবং ইহকাল-পরকালকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কখনো ভয় দেখিয়ে, কখনো প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে এই ফ্যান্টাসির ভিতর ডুবিয়ে রাখা হয়েছে।
প্রশ্ন করলেই কোনো ধর্মই এই ফ্যান্টাসির কোনো উত্তর দিতে পারবে না। তাই প্রতিটি ধর্মেই বলা হয়েছে প্রশ্ন না করে বিশ্বাস করতে। আর বিশ্বাস এমন এক বস্তু যার কোনো সীমা-পরসীমা নেই; যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই; বিজ্ঞান তো নেই-ই। কারণ বিজ্ঞানে বিশ্বাস করতে হয় না, প্রমানিত তত্তে¡ ও তথ্যে আস্থা রাখতে হয়।
অথচ এই ফ্যান্টাসি বিশ্বাস করেই মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। প্রতিবেশী প্রতিবেশীর বাড়িতে আগুন দিচ্ছে। যে প্রতিবেশী, যে বন্ধু বিপদে-বিসম্বাদে বছরের পর বছর কাঁধে কাঁধ দিয়ে পাশে দাঁড়ায়, এই ধর্মীয় ফ্যান্টাসির বিশ্বাসে সেই প্রতিবেশী, সেই বন্ধুকেই হত্যা করতে, নির্যাতন করতে একটুও হাত কাঁপছে না। কী অদ্ভুত এক আফিম এই ধর্ম নামক না-দেখা-না-জানা অলৌকিক বিশ্বাস!
ধর্মবিশ্বাস নয়, মানবতাই হোক মানুষে মানুষে মিলনের মন্ত্র। অলৌকিক বিশ্বাস নয়, যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞান-ই হোক বিপদ উত্তরণের হাতিয়ার। এমন এক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার চেষ্টা করা উচিত, অসহায় সময়ে যেখানে সমাজ ও রাষ্ট্র যেন পাশে এসে দাঁড়ায়; মানুষ যেন পাশে এসে দাঁড়ায়।
ধর্ম-নির্দেশিত সেই সর্ব শক্তিমান স্রষ্টা কোনোদিন বিপদে পাশে এসে দাঁড়ায় না। যে বন্ধু-যে প্রতিবেশীর বাড়িতে আগুন দিচ্ছে, সেই মানুষই ধর্মের নেশা কেটে যাওয়ার পরে পাশে দাঁড়াবে। তা হ’লে কেন এই উন্মত্ত¡তা?
কবি শক্তি চট্রোপাধ্যায় বলেছিলেন
“মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও,
মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও,
মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।
এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও,
মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।”
মানব-ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী বাংলার মধ্যযুগের এক কবি বড়Ñ চণ্ডীদাস উচ্চারণ করেছিলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।
আমাদের পূর্ববংগেরই আরেক কবি শেখ ফজলুল করিম গত শতাব্দীতেই বলেছিলেন কত যুক্তিবাদী উক্তি তাঁর কবিতায়,
‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে’ তা বহুদূর,
মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেই সুরা সুর।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ সব কবি-সাহিত্যিকেরা এ রকম মানবিক বাণী তাঁদের সৃষ্টি-কর্মের পরতে পরতে বলে গেছেন। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নায়ক জাতির জনক বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে ধর্মীয় ভেদাভেদমুক্ত ধর্ম নিরপেক্ষ এক সংবিধান দিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল মন্ত্রও ছিল ধর্মীয় বাতাবরণহীন একটি রাষ্ট্র যেখানে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী মানুষেরা বাস করবে সমান অধিকারে। এমনকি নাগরিকের ধর্ম বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসেও রাষ্ট্র কোনো হস্তক্ষেপ করবে না, রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি থাকবে না পক্ষপাত।
অথচ স্বাধীন বাংলাদেশ যেন চলছে ঠিক তার উল্টো পথে। স্বাধীনতা পরবর্তী এই ৫০ বছরে বাংলাদেশ যেন ধর্মীয় মৌলবাদের উর্বর ভূমিতে পরিণত হয়েছে। যে নগন্য সংখ্যায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু নাগরিক বাস করছে বাংলাদেশে তাঁদের প্রতি নির্যাতনের মাত্রা যেন বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ধর্মবিশ্বাস মানুষকে যেন অমানবিক অমানুষে পরিণত করছে।
আসলে প্রচলিত কোনো ধর্মই অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু থাকেনি। ধর্মে শান্তির কিংবা সহানুভূতির যে গালভরা বাণী সে শুধু স্ব-স্ব ধর্ম বিশ্বাসীদের জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় ভিন্ন মতের এবং ভিন্ন পথের মানুষকে সহযাত্রী করেই চলতে হবে। কোনো প্রচলিত ধর্মই এ শিক্ষা দেয় না; দিলেও সেটা কেতাবে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই।
তাই এ যুগের ধর্মই হবে মানবিকতার ধর্ম, যুক্তির ধর্ম, বিজ্ঞানের ধর্ম; আর এ কথাগুলোই আমাদের মনীষীরা বলে গিয়েছেন শত শত বছর আগে। দুঃখের কথা এই যে, আমরা সে সব ভুলে প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের ক‚পমন্ডুকতাই ডুবে আছি।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)