সাজ্জাদ আলী : ভাইবোনদের সবাইকে নিয়ে আব্বা-আম্মা ক’দিনের জন্য দাদীর বাড়িতে গিয়েছেন। বাসায় সেদিন আমি একা। তখনকার দিনে আমাদের মফস্বল শহরটিতে বড়দের মান্য করার ব্যাপারটা খুব ছিলো। কলেজ মাঠে পাড়ার বড় ভাইরা খেলাধুলা করে, মোড়ের দোকানে দিনভর মুরুব্বিরা গল্পে মশগুল, স্টেডিয়ামের গেট তালাবন্ধ, চৌরঙ্গীতে দাঁড়ালে বড়রা ধমকায়, গার্লস স্কুলের মোড়ে গেলে মেয়েরা হ্যাংলা ভাবে, পোষ্ট অফিসের বারান্দায় বসে সিগারেট খেলেও বাসায় গাঁজা টানার নালিশ আসে! ছোট্ট সেই শহরটিতে বয়ঃসন্ধিকালে আমাদের দুদ- বসবার কোন জায়গা ছিলো না। এমন বাস্তবতায় ক’দিনের জন্য একটি ‘ফাঁকা বাসা’ পাওয়া তো জীবনে প্রথম প্রেমপত্র হাতে পাওয়ার মতোই তীব্র আনন্দের।
১৯৮০ সালের ১৮ই মে, দিনটির কথা বলছি। সেদিন সকাল সকালই বন্ধুরা ক’জন আমাদের বাসায় চলে এলো। কেউ বসেছে দাবার খোট নিয়ে, হারমোনিয়ামের বেসুরো রিডগুলো সুরে ফেরাচ্ছে কেউ, পেয়ারা গাছ তলায় টেবিল পেতে দুজন কেরামবোর্ড খেলায় ব্যস্ত, উল্টোদিকের বাসার দুই সুন্দরী বিউটি আর বেবী ওদের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো কিনা, তা দেখার দায়িত্বে দুজন। সিগারেট ধরেছি বলে ক’মাস হল বন্ধুসভায় আমার অবস্থান বেশ পোক্ত হয়েছে। সোফার উপরে বসে টি-টেবিলে পা তুলে সিগারেট ফুঁকছি। এটা আব্বার স্টাইল। আব্বার মতো আয়েস করে বসে সিগারেট টানবো; বহুদিন থেকেই এই সুযোগটুকুর অপেক্ষায় ছিলাম।
শুধু সিগারেট টানার স্টাইলের কথাই বা বলছি কেন? আব্বা কেমনে হাঁটেন, কেমনে বসেন, কোন কাইতে ঘুমান, রেগে গেলে ইংরেজি বলতে থাকেন, হাসবার পরিমিতি, বলেন কম শোনেন বেশি, পড়ার অভ্যাস, কোচ দিয়ে কুপিয়ে মাছ ধরার নেশা, তাঁর স্বল্পাহার, পরিচ্ছন্ন পোশাক ইত্যাদি সবই তো অনুকরণের চেষ্টা করছি আজো। মনে পড়ে, আব্বা যখন দাদী বাড়ির তল্লাটে রাস্তাঘাটে বেরুতেন বা শালিসি বৈঠকে বসতেন তখন খানিক বাদে বাদেই তাঁকে বলতে হতো, “ওয়ালাইকুম আসসালাম”। সারাজীবন চেষ্টা করেও তাঁর কোন গুণই তো আয়ত্ত করতে পারলাম না। তাই বোধ হয় আমাকে “আসসালামু আলাইকুম” বলে বলেই জীবন কাটাতে হচ্ছে।
তো বলছিলাম সেই দিনটির কথা। বন্ধুদের সাথে সুখোসময় বেশ এগুচ্ছিলো। এমন সময় জানালা দিয়ে দেখি বাসার গেট ঠেলে সাইকেল নিয়ে মনিরুল ঢুকছে। ও আমাদের গাঁয়ের সব থেকে নম্র ছেলেটি, আমার এক কাস নিচে পড়ে। আমাকে সে মামা ডাকে, আর আমি ওর নাম ধরে। দাদী বাড়ির এলাকা থেকে প্রতিদিনই নানান কাজে আব্বার কাছে লোক আসে। বসার ঘরখানি সব সময় গিজগিজ করে। মনিরুলও অনেকবার এসেছে। বাসায় ওর এই ‘আসাটা’ স্বাভাবিক ঘটনা। তবে তার সাথের সাইকেলখানা দেখে আমার বিস্ময়ের শেষ নেই। দাদী বাড়িতে দুখানা সাইকেল, একখানা সবাই চালায়; আরেকখানা কেবলমাত্র ছোট কাকার বাহন। আব্বা তাঁর কলিজার টুকরা ছোট ভাইকে ফনিক্স ব্রান্ডের ওই সাইকেলখানা ম্যালা টাকা খরচ করে কিনে দিয়েছেন। চালানো তো দূরের কথা, সে সাইকেলের দিকে আমরা কেউ তাকালেও খবর আছে।
কুটিকাকা তাঁর যতনের ধন এই সাইকেলখানাকে পরিষ্কার ত্যানা দিয়ে দিনে অন্তত ৪ বার মোছেন। একটা মাছি এসে বসলেও সারা বাড়ি তাড়া করে পোকাটির মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে তবেই তাঁর শান্তি। সাইকেলখানা সারাক্ষণ তালা দেওয়া, কাউকেই ছুঁতে দেন না। আর মনিরুল কিনা সেই সাইকেল চালিয়ে গোপালগঞ্জ এসেছে। অবিশ্বাস্য ঘটনা? নিশ্চয়ই কোথাও মস্ত কোন একটা ক্যাচাল ঘটেছে! সিগারেট ফেলে দিয়ে বাইরে বেরিয়েই আমার বিস্মিত জিজ্ঞাসা,
হ্যারে মনিরুল কুটিকাকা তোরে সাইকেল দিলো?
থরথর করে কাঁপছে সে! কথা বেরুচ্ছে না তার মুখ দিয়ে! যেটুকু বা বেরুচ্ছে তাও আউড়ে যাচ্ছে। খানিক চেষ্টার পরে বলল,
মামা ভাইজান খুব অসুস্থ, আপনি এক্ষণি বাড়ি চলেন।
মনিরুলের চিবুক ধরে সজোরে ঝাঁকি দিয়ে বললাম,
কি হইছে আব্বার? সত্যি কইরা ক’তো? তেমন বড়সড় দুর্ঘটনা না ঘটলি কুটিকাকা তো তোরে সাইকেল দেয়া মানুষ না!
মামা কথা বাড়াইয়েন না তো, ঘরে তালা দেন, আর শিগগির রওনা হন। ভাইজান ভারি কাবু, আপনারে দেখতে চাইছে।
তুই এ রকম কাঁপতিছিস ক্যান, চোখে পানি ক্যান তোর? সত্যি ক’তো আব্বার কি হইছে?
মাথা নিচু করে রইলো মনিরুল, আর বন্ধুরা অনেকটা যেন সামরিক কায়দায় ঘিরে ধরল আমাকে। বাবা অসুস্থ হলে ছেলের কর্তব্য কি, তাতো আমি বুঝি না। আমি তো অত বড় না, ক’দিন আগে মাত্র মেট্রিক পাশ করেছি। পরিবারের যে কোন আনন্দে সব থেকে বড় লম্ফটা আমিই দেই বটে, কিন্তু আপদকালীন কর্তব্যতো এখনও কিছু শিখি নি! বন্ধুদের হাবভাবে বেশ বুঝতে পারছি যে, প্রলয়ঙ্করী কোন একটা কিছু ওরা আমার কাছে লুকচ্ছে। অজানা কোন ভয়ঙ্কর বার্তা যেন আমার ইন্দ্রিয়গুলো একে একে অবশ করে দিচ্ছে। তবুও “ভাইজান অসুস্থ” মনিরুলের এই কথাটিই অবুঝ মন আঁকড়ে ধরলো।
বেলা ১টার ফিরতি লঞ্চখানা ধরবো বলে তড়িঘড়ি লঞ্চঘাটা পৌঁছুলাম। বিকাল ৫টা নাগাদ সোনাডাঙ্গা ঘাটে লঞ্চ পৌঁছাবে, সেখান থেকে আধাঘন্টার হাঁটা পথ পেরিয়ে তবেই দাদীর বাড়ি। গতরাতে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাটি ততক্ষণে লোকমুখে সারা অঞ্চলে ছড়িয়েছে। সবাই সত্যটি জানে, কিন্তু আমাকে বলছে না কেউ। লঞ্চঘাটে পৌঁছে দেখি বন্ধুরা ক’জন আমার আগেই সেখানটায় উপস্থিত। রিক্সা থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞাসা করলাম,
কিরে, তোরা এখানে কেন?
কেউ একজন বললো, আমরাও যাবো তোর সাথে।
তার মানে কি? তোরা কেন যাবি? কোনদিন তো যাস না?
আমার সমগ্র চেতনা যেন অসাড় হয়ে আসছে। অনেকটা বেসামাল হয়ে বললাম,
সত্যি ক’তো তোরা, আমার আব্বা নাই, তাই নারে?
খুব জোরের সাথে ওদের একজন বললো,
ধুর বোকা কি কচ্ছিস এ সব, কাকা অসুস্থ তাই আমরা দেখতে যাচ্ছি। আর কথা কইস না, লঞ্চে উইঠা পড়।
ঘাটেবাঁধা লঞ্চে যাত্রী উঠানামার জন্য পুরু কাঠের সিঁড়ি লাগানো। আমি সিঁড়ির গোঁড়ায় পৌঁছুতেই লঞ্চের সারেং গনিকাকা এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে তুলে নিলো। শতবার তার লঞ্চে যাওয়া আশা করেছি। এমনটি তো কখনও করে না সে। আজ কেন তবে আমার জন্য এমন বিশেষ যত্ন? মনের খটকা আরো বাড়লো। নিয়ে বসালো সারেং ক্যাবিনে, তার পাশেই। ঘাট ছেড়ে চলমান লঞ্চের নিয়ন্ত্রণ সংহত করেই গনিকাকা স্বগতোক্তি করে বলে চলেছেন,
তোর আব্বার তদবিরে আমি এই লঞ্চ কম্পানিতে চাকরী পাইছিলাম, গত বছর নিজি দাঁড়ায় থাইকা আমারে বিয়া দিছে, অহনও ভাইজান আমার কাছে ৮০ডা ট্যাকা পায়!
এটুকু বলে মানুষটি ঘাড়ের গামছায় চোখ মুছল। আমি শান্তভাবে তার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলাম,
কাকা আমার আব্বা মইরা গ্যাছে তাইনা?
একহাতে লঞ্চের স্টিয়ারিং ধরে আরেক হাত আমার মাথায় ডলে দিয়ে বললো,
আউ অমন কথা মুখি আনিস না বাজান। তুই বাড়ি যা, ভাইজান অসুস্থ!
বসে আছি সারেংয়ের ক্যাবিনে, চলছে লঞ্চ। বন্ধুরা কেউ আমার কাছে ঘেঁষছে না। ডেকের সামনের দিকের রেলিংয়ের দুপাশে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওরা। বেশ বুঝতে পারছি, আমার দিকে সজাগ দৃষ্টি ওদের। গনিকাকা লঞ্চের ইঞ্জিনম্যানকে ডেকে পাঠিয়ে বললো,
ওই বরকইত্যা আইজ ফুলস্পীডে ইঞ্জিন চালাবি, ত্যাল বেশি খায় খাক। বড় ভাইজান অসুস্থ, বাজানরে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতি হবি, বুঝছোস। মাথা নেড়ে বরকত ইঞ্জিনের গতি বাড়াতে গেল।
খানিক বাদেই টিক্কা চা নিয়ে হাজির। পিরিচের উপরে দুখানা লাল ফোটা দেওয়া বিস্কুটও দিয়েছে। বললাম, কিরে তুই চা আনছিস ক্যান? আমি তো চাই নাই?
ভাইজান খান, আপনার জন্যি স্পেশাল বানাইছি।
টিক্কা এই লঞ্চে চায়ের দোকান চালায়। ও আমাদের নিকটাত্মীয় বালা কাকার ছেলে। এ পথে যাতায়াতের সময়ে কতবারই তো টিক্কার দোকনের চা খেয়েছি। তবে না চাইতে সে কখনওই চা নিয়ে আসেনি। চায়ের কাপ-পিরিচ হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করলাম,
হ্যারে টিক্কা খবর কিছু জানিস নাকি? আব্বা কি বাইচা আছে?
নাউজবিল্লাহ্ ভাইজান এইডা কি ক’ন? বড়কাকা ইট্টু অসুস্থ, আপনি বাড়িত যান।
সেদিন সবাই যেন আমার সাথে মিথ্যা বলবার পণ করেছিলো। আমার প্রতি সকলের মনোযোগের বাড়াবাড়িতে চিন্তা শক্তি যেন বিধ্বস্ত হয়ে এলো। দ্রুত চলবার কারণে লঞ্চখানা আধাঘণ্টা আগেই সোনাডাঙ্গা ঘাটে পৌঁছালো। বন্ধুদের নিয়ে নেমে পড়লাম। গনিকাকা খালের পাড় অব্ধি নেমে এলো, বললো বাজান তুই যা, আমি গোয়লগাঁ ঘাটে লঞ্চ নোঙ্গর কইরা রাইতে তগো বাড়ি আমুনে। রাস্তা দিয়ে বাড়িমুখি হাঁটছি আমরা, তবে কেউই কারো সাথে কথা বলছি না।
মামুদপুর গ্রামটা পেরুলেই আমাদের গাঁ। এ রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর আমার অনেক চেনা। এখানকার মানুষদের কাছে আমি অত্যন্ত স্নেহের পাত্র, আর ওরা আমাদের আপনারজন। দূর থেকে দেখে চিত্তকাকু ক্ষেত মাড়ায়ে এগিয়ে এলেন। রাস্তায় উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। বললেন,
খানিক আগেই তগো বাড়ি থেইক্যা ফিরলাম।
নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, আমার আব্বার সাথে দেখা হইছে কাকু?
বন্ধুদের মধ্যে কেউ হয়তো তাকে ইশারা করে থাকবে। ঢোক গিলে বললেন,
চেয়ারম্যান দাদা ঘুমাচ্ছিলো, কথা হয় নাই। চল তোর সাথে আবার যাই, দেখা কইরা আসি।
আরো খানিক এগুতেই সহপাঠী বুলিদের বাড়ি থেকে সম্ভুকাকু ডাক ছাড়লেন,
ছোটবাপ কি এই লঞ্চে আসলি?
জ্বী কাকু, গলা চড়িয়ে বললাম।
আইচ্চা বাপ বাড়িত যা।
এ পথে বহুবার হেঁটেহেঁটে বাড়িতে ফিরেছি। তবে আজকে একটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করছি। সঙ্গীদের নিয়ে হেঁটে এগুনোর সাথে সাথে প্রত্যেক বাড়ির মেয়েছেলেরা কাজকর্ম ফেলে বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে আমাদের যাওয়া দেখছে। যতক্ষণ না আমরা দৃষ্টির আড়াল হই, ততক্ষণই তারা দাঁড়িয়ে। কিন্তু কেন? আরো খানিক এগুতেই প্রিয়লাল কাকুর বৃদ্ধ বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। আমি বললাম,
কি হয়েছে দাদু, আপনি কাঁদছেন যে?
বিচক্ষণ মানুষ তিনি, মুহূর্তেই বুঝে ফেললেন যে ঘটনা আমি জানি না। বললেন,
বাড়ি যাও দাদুভাই, সব কিছু তোমার অপেক্ষায় আছে!
মানুষের জীবনে “বাবা থাকা” কতটা জরুরি? সেকি আমরা তাঁকে না হারানো অব্ধি বুঝতে পারি? জন্মাবধি যে পাখি গাছের শক্ত ডালে নিশ্চিন্তে বসে, সে কি করে বৃক্ষহীন মরুতে উড়ন্ত পাক্ষির ডানা ঝাপটানোর কান্তি বুঝবে? হাওড় বিলে সাঁতরে বেড়ানো মৎস্য যদি হঠাৎ কখনও লাফ দিয়ে ডাঙ্গায় গিয়ে পড়ে; তখনই না সে জলের মাহাত্ম্য বুঝতে পারে! কৈশোরের সেই দিনটিতে বাড়িমুখি পথ চলার প্রতিটি বাঁকে জীবনদায়িত্বের পোটলাগুলো যেন একে একে আমার দুই কাঁধে জমছিল।
শরৎ কাকুর বাড়িটি পেরোতেই গাঁয়ে ঢুকলাম। লক্ষ্য করলাম, আমাদের হেঁটে এগুনোর সাথে সাথে বাড়িগুলো থেকে ছেলে বুড়ো এমনকি মহিলারা পর্যন্ত পিছু নিচ্ছে। এরা সবাই আমার চেনা, অথচ আজ অচেনার মতো আচরণ করছে। সাথে হাঁটছে তবু কেউ আমার সাথে কথা বলছে না। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে, কিন্তু কারো দিকে আমি তাকাতেই সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। প্রায় সবার চোখই জলে ভেজা, আর মুখে সর্বনাশা কিছু একটা ঘটে যাওয়ার শঙ্কা। আরো কিছুটা এগুতেই দেখলাম লোকে লোকারণ্য! বাড়ির ভিটা ছাড়িয়ে পালান, খেলার মাঠ, ফসলের ক্ষেত পর্যন্ত শুধু মানুষ আর মানুষ। মনের সংশয় আরো বাড়লো। একজন অসুস্থ মানুষ যদি মুমুর্ষও হয় তবুও তো তাঁকে দেখতে এত লোক সমাগমের কথা না! তবে কি আমার আব্বা সুস্থ/অসুস্থের জাগতিক গন্ডি অতিক্রম করেছেন?
ডানে বায়ে না তাকিয়ে টানা হেঁটে এগুচ্ছি। বাড়ি সংলগ্ন পাথারে পৌঁছানোর পরে লোকেরা দুপাশে সরে দাঁড়িয়ে আমাকে পথ ছেড়ে দিচ্ছিলেন। এমন পথে হাঁটা অতীব দু:সহ! আমার দিকে সহস্র মানুষের জোড়া জোড়া চোখ। দুপাশ থেকে ফোঁপানো কান্নার শব্দও শুনতে পাচ্ছি। ছোট্ট মিলনটা কোথা থেকে দৌড়ে এসে আমার মাজা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর সাথে হাঁটছে। ওর কান্নার হাবভাব ভারি অবুঝের মতো। তবে আরো দুশো কদম এগুতেই “বুঝমান কান্নার” ধ্বনি শুনতে পেলাম। আব্বার প্রধান সেনাপতি, আমার নোয়াকাকা রেন্ট্রি গাছের তলা থেকে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি সেদিন যে আর্তনাদ করেছিলেন, তার অনুরণন আমি আজও শুনতে পাই। তিনি যেন তাঁর সব কষ্টটুকু আটকে রেখেছিলেন আমার কাছে উগরে দিবেন বলে।
সহস্র মানুষের কান্নার আভরণ ভেদ করে অবশেষে বাড়ির বাইরের উঠানের প্রান্তে পৌঁছুলাম। দেখি দক্ষিণ ঘরের দরজা সংলগ্ন চত্তরে শীতল পাটির উপরে সাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে কেউ একজন ঘুমিয়ে আছে। তাঁর শিয়রে বসে আবুজায়েদ কাকা, দুপাশে পান্ডবদাদা আর আতিকাকা। ওরা তিনজনই তো আমার আব্বার সর্বক্ষণের সাথি। তবে কি ওখানটায় আব্বাই শুয়ে? সেদিন সবার সেই গগনবিদারী হাহাকার আর কান্নার ধ্বনি সারাবেলা যেন আমারই অপেক্ষা করছিলো। শ্বেতবস্ত্রাবৃত ওই ঘুমন্তের দিকে চেয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। নোয়াকাকা বলে উঠলেন,
আতিভাই বেলা যায়, কাপড় সরাও, ওরে মুখখান দেখাও। লাশ দাফন করতে হবে।
কাপড় সরাতেই দেখি আব্বা ঘুমিয়ে! শান্ত স্নিগ্ধ ঘুমন্ত, আমার আব্বা! আমি চেঁচিয়ে বললাম,
দাফন করবেন কেন? আব্বা তো ঘুমাচ্ছে!
নোয়াকাকার ইশারায় দুএকজনে আমাকে পাঁজা কোলে তুলে ভেতর বাড়ির উঠানে দাদীর সামনে নিয়ে ছাড়লো। আম্মা আর দাদী আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! আমি যেন সেদিন ওদের কান্নার ভাষা বুঝতে পেরেছিলাম। দাদী যেন বলছেন,
আমার সব শেষ হইয়া গেল রে
আর আম্মার কান্নাধ্বনি যেন বলছিলো,
তুইই এখন শেষ ভরসা রে বাবা!
এই যে শত স্বজনেরা এত যে কান্নাকাটি করছেন, কিন্তু আমি কাঁদছি না মোটেই। সেই মুহূর্তটি থেকে আজ অব্ধি আমার মনে হয় যে, মরা কান্নার থেকে অনেক বড় কর্তব্য আমার ঘাড়ে। আমি হাতপা ছেড়ে কাঁদতে বসলে কর্তব্য দেখবে কে? জীবনে যদি কখনও অবসর আসে, তখন না হয় মন ভরে কেঁদে নেবো।
ভেতর বাড়ির উঠোনে তখন দশ গাঁয়ের মহিলাদের গিজগিজানো ভিড়! কতক্ষণ আম্মা আর দাদীর কাছে ছিলাম মনে নেই। কে যেন আমার একমাত্র ভাই দুমাসের আলভীকে আমার কোলে ছেড়ে দিলো। বড় বড় চোখে সে আমার দিকে তাকাছে, পলক ফেলছে না। হায়রে অভাগাটা, বুঝতেও পারছে না কি হারিয়েছে! সেই মুহুর্ত থেকে সারাজীবনের তরে ওকে বুকে জড়িয়ে নিলাম।
ওই ভিড়ের মধ্যে খুঁজছিলাম আমার বোন ৫টিকে। দেখি পুবের ঘরে কান্নাকান্ত ওরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপাচ্ছে। সেদিন সব স্বজনদের চোখেমুখে দেখেছিলাম শোকের ছায়া, আর বোন ক’টির মুখ জুড়ে দেখি আতঙ্ক! ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা ভীত হয়ে পড়েছে। দেখতে পেয়েই ৫ জনে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
বুড়ি, চম্পা, কলি, সেলি, তুলি, আমার পাঁচ পাঁচটি প্রাচুর্য! কাঁদছে আর বলছে,
দাদু এখন আমাদের কি হবে?
আব্বার মৃত্যুর ক্ষণটিতেই ওরা বিপদ আঁচ করতে পেরেছে। আমাদের এখন কি হবে? এই মস্ত প্রশ্নটির কি জবাব দেবো আমি? নাকি গুরুতর সেই সংকটের স্বরূপ বোঝার উপযুক্ত বয়স তখন আমার? তবুও মনে সাহস রেখে দুহাতে ওদের চোখের জল মুছাতে মুছাতে বলেছিলাম সেদিন,
ভয় কিসের? আমি আছি না?
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)