মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
নয়.
এগুলো আমার জীবনের বেদনাময় অধ্যায় ছিল। একজন যে কোনো পরম মাতৃভক্ত সন্তানের মতই আমি আমার মা’কে ভালোবাসতাম। আর সেই মা যখন কোনো কারণে কোনো রকম দুঃখ কষ্টের মধ্যে থাকতেন, সেই দুঃখ কষ্টের চরম যাতনা আমার দেহমন ছুঁয়ে যেতো। কিন্তু এটাও ঠিক, এটা আমাকে অনেক নতুন কিছু শিখিয়েছে। এটার মাধ্যমে আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি, আমার মা এবং বাবা দুজনের মধ্যেই অতি সাধারণ মানুষের কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল যার ফলে তাঁদের জীবনেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু ত্রæটির ঘটনা ঘটেছে, সেই সাথে তাঁদের নিজ নিজ চিন্তা চেতনায় তাঁদের মত করে বেড়ে উঠা’টায় কিছুটা গরমিল ছিল। যার ফলে তাঁরা তাঁদের সংসারটা টিকিয়ে রাখতে পারেননি।
আমাদের নিজেদের মধ্যে আমরা বিভিন্নভাবেই শিশুর মত বসবাস করি। আমাদের জীবনের শুরুর দিকে যে সব ভয় ভীতি দ্বারা সব সময় আতংকিত থাকি, আমাদের বয়স হবার সাথে সাথে সে সব কেটে যেতে পারে, কিন্তু সেগুলো সব সময় কিন্তু আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, যেমন করে আমাদের ক্লোজেটে আমরা কংকাল লুকিয়ে রাখি। মায়ের অসুখের সবচেয়ে খারাপ সময়ে তাঁর ভয় ভীতি ও দুঃস্বপ্নের ধরনটা ছিল অনেকটা ছোট ছেলেমেয়েদের মতো। আমি বিশ্বাস করি না যে, তাঁর বয়সের অন্যান্য বয়স্কদের থেকে তিনি এ ব্যাপারে একেবারে আলাদা ছিলেন, আসলে তাঁর অসুখের সেই কারণগুলোর জন্যই তাঁর অন্তর মহলের দরজার সেই অর্গলটা খুলে গিয়েছিল, যার ফলে তাঁর ভিতরের লুকিয়ে থাকা সেই কংকালটা টলতে টলতে বের হয়ে তাঁর মনকে একেবারে তছনছ করে চারিদিকে ঘুরে বেড়াতো।
এবং এখানেই আমার বাবা আর মা’র মধ্যে সেই মোটা দাগে জ্বলজ্বল করা পার্থক্যটা লক্ষ্য করা যায়। আমার মায়ের দিকটা ছিল তাঁর আবেগের আধিক্য, এবং আমি তাঁর এই আবেগের কাছেই বারবার নিজেকে সমর্পণ করতাম। কিন্তু আমার বাবার চরিত্রে আবেগের লেশমাত্র দেখা যেতো না, আর তিনি আমাকে সব সময়ই আবেগ দ্বারা আক্রান্ত না হওয়ার জন্য বলতেন। জীবনের প্রতি আমার বাবার মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পুরোটাই বুদ্ধিবৃত্তিক। আমার মনে হয়, সব কিছুই নিছক বুদ্ধিবৃত্তিক মনোভাবে দেখার তাঁর যে নীরস দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল তার মধ্যেই তাঁর সমস্যাগুলো নিহিত থাকতো। কোনো এক মুহূর্তে তিনি আমাকে এলিস মিলারের ক্ল্যাসিক ‘দ্য ড্রামা অব দ্য গিফটেড চাইল্ড : দ্য সার্চ ফর দ্য ট্রু সেল্ফ’ এর একটা কপি দিয়েছিলেন।
তোমরা যদি সেই বইটা পড়ে না থাকো, সেক্ষেত্রে আমি শুধু বলতে পারি, বইটা সে সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে লেখা যারা তাদের নেতিবাচক আবেগী অভিজ্ঞতার পরও নিজেদের সামনে এগিয়ে নেবার জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। এই বইটা আমাকে আমার বাবা-মা’র দাম্পত্য বিচ্ছেদটা সহজভাবে নেবার উপলব্ধিটা জাগিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, তাঁদের একজন ভালো সন্তান হয়ে আমি তাঁদের মনে কিছুটা প্রশান্তি এনে দিতে পারি। আমার এটাও মনে হয়েছিল, এটা আমাদের চারপাশকে আরো সুন্দর করবে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, ওটা হয়নি।
ঘটনাগুলোর দৃশ্যপটের দিকে তাকালে বাহ্যিকভাবে মনে হয়, আমাদের মা শাসা, মিশেল আর আমাকে ছেড়ে গেছে কারণ এর ফলে তিনি ইচ্ছেমত হৈ চৈ আর পার্টিতে আনন্দ ফুর্তিতে তাঁর জীবন কাটাতে পারবেন এবং আমরা তাঁর নিজের মত চলার যে জীবন তাতে কখনো কোনো রকম বাঁধার সৃষ্টি করবো না। কিন্তু বাস্তবতাটা ছিল একেবারে আলাদা। মা আমাদেরকে তাঁর জীবন থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি, বরং তিনি আমাদের জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিলেন। তিনি প্রায়ই ২৪ সাসেক্স এর বাড়ীতে এসে রাত কাটাতেন। সেই রাতগুলোয় তিনি তাঁর পুরাতন সেলাই ঘরে ঘুমাতেন।
তাঁর এবং আমার মধ্যে একটা গভীর মা-ছেলের বন্ধন ছিল। আমি লক্ষ্য করতাম তিনি আমাকে সবার চেয়ে অন্য চোখে দেখতেন এবং আমার সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল সবচেয়ে মধুর। আমার মনে হয়, আমার প্রতি তাঁর এই ভালোবাসা আমি তাঁর প্রথম সন্তান বলে নয়, বরং আমি তাঁর জীবন ও ব্যক্তিত্বের অনেক কিছুই যেমন; দুঃসাহসিক নতুন কিছুর প্রতি প্রবল আগ্রহ, স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনন্দ প্রকাশ করা এবং আশপাশের মানুষদের সাথে একটা আবেগের বন্ধন তৈরী করা- মনে প্রাণে ধারণ করতাম।
আমি যখনই জানতে পারতাম যে মা ২৪ সাসেক্স এ আমাদের কাছে আসছেন, আমি আমার আনন্দ ধরে রাখতে পারতাম না। তখন আমার মাথা জুড়ে নানা রকম পরিকল্পনা গিজগিজ করতো যে আমি কিভাবে মা’কে অভ্যর্থনা জানাবো। একবার আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ২৪ সাসেক্স এ তাঁর আগমনকে আমি সংগীতের সুরে সুরে বরণ করবো।
আমি উপহার হিসেবে একটা ছোট্ট ক্যাসেট প্লেয়ার পেয়েছিলাম এবং সেই সময়ের সব হিট গানগুলো আমার সংগ্রহে ছিল। সেই সময় বলতে আশির দশকের শুরুর সময় বলছি। কিম কারনেস এর ‘বেটার ডেভিস আইস’, হল এন্ড ওয়েটস এর ‘প্রাইভেট আইস’, জুইস নিউটন এর ‘কুইন অব হার্টস’ এবং বিশেষ করে ভ্রমণের সময়ের সেই বিখ্যাত রোমান্টিক ব্যালাড ‘ওপেন আর্মস’। আমার এই সংগ্রহ শুনে হাসবেন না, ‘রক ৮২’ এ্যালবামের মত বয়স্কদের উপযোগী মিউজিকটা আমার কাছে ছিল। কিন্তু আমি মেনে নিচ্ছি, রাফি’র মিউজিক এক্ষেত্রে বয়সের সাথে বেশী মানানসই ছিল। আমার ছেলেবেলায় মা ভ্রমণ-সংগীত নিয়ে তাঁর ভালো লাগার কথা বলতেন। আমি ঠিক করেছিলাম, বেশ দীর্ঘ দিন পর মা যখন ২৪ সাসেক্স এর বাড়ীটাতে প্রবেশ করবেন তখন সাউন্ড ট্রাকে আমি সেই সংগীতটা বাজাবো।
আমি অপেক্ষা করতে থাকতাম মা কখন তাঁর ভিডবিøউ র্যাবিট এ চড়ে আসবেন। আমার এই অপেক্ষার পালা শুরু হওয়ার আগে ওপরতলায় আমার ঘরটায় ছোট্ট টিনের রেকর্ড প্লেয়ারটা জায়গামত সাজিয়ে রাখতাম। তিনি যখন এসে দরজাটা খুলে কেবল ভেতরে ঢুকতেন, তখনই ভলিউমটা বাড়িয়ে ছুটে সিঁড়ির কাছে এসে চিৎকার করে বলতাম, ‘মা, শুনছো, এই গানটা শুধু তোমার আর আমার জন্যে।’
আমার এই কাণ্ডতে মা আমার দিকে তাকাতেন, বুঝতাম তিনি আমাকে এমনভাবে দেখে খুবই সুখ পেতেন, কিন্তু আমি মা’কে কী শুনাতে চাইছি এটা ঠিক তিনি বুঝতে পারতেন না। কারণ, তাঁর কানে সেই গানের কিছুই যেতো না। আমার সেই রেকর্ড প্লেয়ারের শব্দের তীব্রতা বর্তমান সময়ের সেল ফোনের শব্দের প্রায় অর্ধেক ছিল। আমার মনে আছে, আমাদের পরিবারের সেই ভাঙ্গাচুরা সময়ে আমি আমার সব দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করতাম, আমরা সবাই মিলে আমাদের এক পরিবার।
আমার মা’ও মাঝে মাঝে এমন কিছু করতেন যে মনে হতো, আমাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো চির ধরে নি। তিনি যখনই নিউইয়র্ক সিটিতে থাকতেন তখন প্রায়ই ফিফথ এভিনিউ’র এফএও এচওয়ার্জ এ গিয়ে আমাদের তিন জনের জন্য প্রচুর সুন্দর সুন্দর খেলনা কিনে পাঠাতেন।
১৯৮১ সালের জুলাই এ প্রিন্স চার্লস ও লেডী ডায়নার বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি আমাকে লন্ডনে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে আমার খালা বেটসী’র ফ্লাটে আমরা উঠেছিলাম। খালা তাঁর স্বামীর সাথে লন্ডনেই থাকতেন। অন্যরকম সুন্দর ও মনে রাখার মতো মুহূর্ত ছিল সেটা।
সন্ধ্যায় বেটসী আর রবিন ফায়ারওয়ার্কস দেখানোর জন্য আমাকে হাইড পার্কে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাজকীয় বিয়ের সেই ফায়ারওয়ার্কস এ লাখ লাখ মানুষ সেখানে জমা হয়েছিল। মা তখন ছিলেন বিশেষ বিশেষ অতিথিদের আমন্ত্রিত পার্টিতে। পরের দিন সকালে মা আমার সাথে সেই পার্টিতে আসা বিশেষ বিশেষ তারকাদের কথা বলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখ করার মতো ছিল, সুপারম্যান চলচ্চিত্রের অভিনেতা ক্রিস্টোফার রীভ, মন্টি পাইথন ট্রুপের সদস্যরা এবং আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রবিন উইলিয়ামস।
পার্টি থেকে ফিরে এসে মা বলেছিলেন, ‘তুমি আমার সাথে গেলে সময়টা চমৎকার উপভোগ করতে।’ একটু থেমে তিনি আবার বলেছিলেন, ‘আমার উচিৎ ছিল তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া।’ এ ধরনের সময়ে মা সাধারণত এমনভাবেই কথা বলতেন। কিন্তু আমার সেই কিশোর মনে তখন অন্য কিছু কাজ করতো। আমার শুধু মনে হতো, মা যদি মনে করে অর্কের মর্ক এর সাথে দেখা করার জন্য আমাকে নিয়ে যেতেন!
অবশেষে মা তাঁর নিজের ঠিকানা পেয়েছিলেন। অটোয়ার ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের একটা ছোট্ট লাল ইটের বাড়ী। সত্যি বলতে কি এটাকেই তিনি তাঁর একেবারে নিজের আবাস বলে ভাবতেন। তার কারণও ছিল। কারণ, এই বাড়ীটার ডাউন পেমেন্ট তিনি দিয়েছিলেন তাঁর গ্রন্থ ‘বিয়ন্ড রিজন’ থেকে প্রাপ্ত অর্থ থেকে। সাধারণত শাসা, মিশেল আর আমি সপ্তাহের ছুটির দিনগুলো সেখানে কাটাতাম। স্কুল ছুটি থাকলে, সেখানে আমরা এক নাগাড়ে কয়েক সপ্তাহও কাটাতাম। ২৪ সাসেক্স এর সেই জৌলুসওয়ালা ঘেরাটোপের বন্দী জীবন থেকে নিজেকে মুক্ত করে এখানে তিনি তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও প্রতিভাকে নিজের মতো করে উম্মোচিত করতে শুরু করতে পেরেছিলেন। মা যখন আমার বাবাকে তাঁর নতুন গৃহে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, বাবা সেখানে গিয়ে সরল মনেই বলেছিলেন, মা এবার তাঁর নিজের প্রাণের এক নীড় খুঁজে পেয়েছেন। বাবা বাড়ীটার ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর চোখটা নীচে রেখে বলেছিলেন, ‘মার্গারেট… তাহলে তোমার এখন একটা নিজের বাড়ী হলো।’ বাবা অস্ফুট স্বরে কথাটা বলে মায়ের দিকে তাকিয়েছিলেন। কিছুটা নিঃস্তব্ধতার সেই সময়ে দুজন শান্তভাবেই শুধু দুজনের দিকে নীরবে তাকিয়েছিলেন। আমি বিশ্বাস করি, এই নীরবতার মুহূর্তটা ছিল দুজনের একান্ত নিজেদের এক সময়, যে সময়ের গভীরতর সৌন্দর্য্য এক সময় দুজনকে দুজনার একেবারে হৃদয়ের কাছে এনেছিল।
প্রতিটি বিবাহ বিচ্ছেদেই এক ব্যাপক ভাঙ্গাচুরা হয় আর এই ভাঙ্গাচুরার আঁচ লাগে সন্তানদের দেহমনে। আমার বাবা-মা দুজনেই ব্যাপারটা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন আর সেই কারণেই তাঁরা দুজনেই চাইতেন সবকিছুর পরও কিভাবে আমরা সবচেয়ে ভালো থাকতে পারি। তাঁরা আমাদেরকে তাঁদের আয়ত্বে রাখার বিষয়ে দুজন দুজনের প্রতি সব রকমের ছাড় দেবার চেষ্টা করতেন। তাঁরা কে কতক্ষণ আমাদেরকে তাঁদের সাথে রাখতে পারলেন এ নিয়ে কোনো ধরনের বচসায় যেতেন না। শাসা, মিশেল আর আমার মঙ্গলের জন্য যা যা করা দরকার তাঁরা দুজন মিলে সেটাই করতেন। বাবা-মা’র সম্পর্কের স্বরূপটা বলতে গিয়ে মা একবার বলেছিলেন, ‘আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একেবারে ভালো ছিলাম না, কিন্তু বাবা-মা হিসেবে আমরা দুজনেই ছিলাম খুবই চমৎকার।’
(চলবে)
মনিস রফিক : চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো, কানাডা