খুরশীদ শাম্মী : কলকল আনন্দ স্রোতে শুরু হয় নতুন বছর কুড়িকুড়ি। পঞ্চাশ যাত্রার রুপালি নকশা আঁকা মন-দেয়ালে। খুব সাধারণ এক জীবন চিত্র, ছোপ ছোপ রঙিন ভাবনাগুলো মিলেমিশে। গোটাগোটা অক্ষরে ভরে যায় দিনপঞ্জিকা। হরেক রকম অনুসূচি : বিদেশ ভ্রমণ, কন্যা বিবাহ, ভাগ্নির নতুন বাড়িতে বেড়ানো, বাগান প্রস্তুতকরণ, নতুন বইয়ের কাজ ইত্যাদি ইত্যাদি। সহকর্মীর সাথে আলোচনা শেষে কর্মস্থানে ছুটির দরখাস্ত পেশ করা হয়। ভাবনা, পরিকল্পনা ও কর্মের লেজে লেজে ব্যস্ততা। বন্ধুদের আড্ডায় যাতায়াতে ভাটা পড়ে কিছুটা, তবুও তাদের সাথে ভ্রমণ পরিকল্পনা পাকাপোক্ত।

প্রকৃতিও পুচ্ছমেলে ত্রিতালে নেচে গেয়ে এগিয়ে চলে। শীতের চাপটা কমতেই কাঁচা হরিত্ নবীণ পাতায় ভরে ওঠে বসন্ত বাগিচা। ড্যাফোডিল, টিউলিপ উন্নত শিরে উঁকি দেয়। সমান্তরালে ঢেউ খেলে আসতে থাকে চীনের করোনা সংবাদ। বিশ্বাস-অবিশ্বাসে দোল খায় পশ্চিমা জগত। ততদিনে চীন বিশ্বের সকল দেশেই বিনা শুল্কে রপ্তানি করে অতিক্ষুদ্রাকার করোনাভাইরাস। কাস্টমস বিলম্ব এড়াতে জাহাজ ভাড়াও পরিশোধ করে তারা অগ্রিম। ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ার দাপট অনুমান করতে পারি বলে করোনার ভয় হতে থাকে মনে। কিন্তু চারপাশের সকলে আমাকে নিয়ে হাসে। আমি তখন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে এক বোকা মানুষ।

বছরের প্রথম চতুর্থাংশেই করোনা ঢেউয়ের জোর বেড়ে যায় হু হু করে। শুরু হয় প্লাবণ। প্রতিদিন আক্রান্ত হয় হাজার হাজার মানুষ। ধুয়ে নিয়ে যায় শত শত জীবন। তবুও বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তবে একপর্যায়ে প্রায় সকলেই পৌঁছে যায় করোনা স্রোতকে প্রতিহত করতে লকডাউন সিদ্ধান্তে। পুঁজিবাদী দেশগুলোও লকডাউনে বাধ্য হয় জনগণের দাবিতে। আমার দিনপঞ্জিকার গোটাগোটা অক্ষরগুলো তাকিয়ে থাকে আমার দিক। মুখ চেপে হাসে। তবুও মনকে সান্ত্বনা দেই, “খুব সত্বর কেটে যাবে এই আঁধার কাল। বিজ্ঞান পারে না এমন কিছু নেই। এই তো ভ্যাকসিন এলো বলে।”

ওদিকে আমার সহকর্মী, পরিচিতজন, প্রিয় মানুষ, আপনজনেরাও আক্রান্ত হয় ভাইরাস দ্বারা। তাদের কেউ দীর্ঘ যুদ্ধের পর সুস্থ হয়ে ওঠে, আবার কেউ পারি জমায় অতলপুরী। দুশ্চিন্তার দৌড় বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ম্যারাথন দুশ্চিন্তায় ক্লান্ত হয় অন্তর। ভয় জয় করে নেয় আমার আত্মবিশ্বাস। পরাজয়ের গলা ধরে তখন কাঁদতে ইচ্ছে হয় খুব। আত্মীয়, রক্তিয়, সুহৃদ, সকল শাখার আপনজন, প্রিয়জনদের আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখার সুযোগ থাকলেও স্পর্শ করার সুযোগ মেলে না কোনো।
লকডাউন দ্বারা কানাডাসহ প্রায় সকল দেশই নিয়ন্ত্রণ করে করোনার প্রথম তরঙ্গ। গ্রীস্ম আগমণে তা আরও মৃদু হতে থাকে। এক এক করে শিথিল হয় প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞাগুলো। জনগণ স্বস্তি ফিরে পায়। প্রায় সকল অফিস, আদালত, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়। মানুষ ফিরে যায় কর্মস্থানে। ঘরের বাইরে যাতায়াত শুরু করে অপ্রয়োজনেও। রেস্তোরাঁয় বসে খাবার উপভোগ করে। বার ও নাইট ক্লাবগুলোও জেগে থাকা শুরু করে ভোর-রাত পর্যন্ত। চিকিত্সা বিজ্ঞানীদের উপদেশ ও অনুরোধে প্রশাসন জরিমানার ভয় দেখিয়ে আমাদের গতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। তবুও আমাদের হৃদয় উতলা হয়ে ওঠে। একদম বেপরোয়া যাকে বলে। সুহৃদ, আত্মীয়, রক্তিয়দের সান্নিধ্য সুদে আসলে ভোগ করার ইচ্ছে জাগে। চার-পাঁচমাস বন্দী জীবনের পর সামাজিক জীব মানুষের এমন বাসনা খুব স্বাভাবিক। আবেগ ন্যায়-অন্যায় বুঝে না। আমিও মানুষ। আমার অন্তরেও আবেগ আসন পেতে বসে। তবে দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে আমার বাবা-মা, ভাই-বোনসহ আপনজনের কাছাকাছি হওয়া সম্ভব হয়নি। স্থানীয় কিছু প্রিয়জনের কাছাকাছি হয়েছি মাত্র। তাও সবার সাথে একবারে নয়। নিয়মের গোলক-ধাঁধাঁয় দেড় মাসে টুকরো টুকরো উঠোন আড্ডা, চায়ের বৈঠক, অকারণ ঘোরাঘুরিতে তাদের বদন দেখেছি অন্তত। এতকিছুর পরও মেলেনি সবার দেখা। কেহ স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আমাদের শতবর্ণের গল্পগুজবের সমাবেশ এড়িয়েছেন, কেহ কাজের চাপে মনকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, কখনো নির্ধারিত নাম্বারের চাপে মনকে দমিয়ে দিয়েছি আমি নিজেই। ভেবেছি, পরের সপ্তাহান্তেই কব্জি ডুবিয়ে আড্ডা দেবো তাদের সাথে।

ওদিকে কানাডার সর্বাধিক রঙিন ঋতু হেমন্ত তার আগমনে তাড়াহুড়ো করে এবার একটু বেশিই যেন। রঙিন পাতাগুলো উদাস হয়ে ঝরে পড়তে শুরু করে সেপ্টেম্বরের লেজে বসেই। বাইরে খড়খড় হিমেল বাতাস, সাথে সংবাদমাধ্যমগুলোর ঢং ঢং বিকট সতর্কীকরণ বার্তা, “ঢেউয়ের পর ঢেউ আসছে, সাবধান!”

চিকিত্সা বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন তাদের বক্তব্যে, নিজেকে বাঁচাও, অন্যকে বাঁচতে সহায়তা করো। হ্যাঁ, করোনা ভাইরাস আবারও ঢেউ তুলে ছড়িয়ে পড়ছে কানাডার বিভিন্ন শহরে। শোনা যায় প্লাবণের দ্বিতীয় ধাক্কা নাকি সর্বদা মারমুখো, দানবরূপী হয়। করোনার ক্ষেত্রেও সেই রকমই অনুমান করা হচ্ছে।

জানি না, করোনাভাইরাস কোন দিকে নিয়ে যাবে আমাদের। কবে, কখন, কীভাবে প্রকৃতির নিয়মের কাছে আটকে যাবে আমার চলার শক্তি। তবে, যতক্ষণ আছে শ্বাস ততক্ষণ থাকবে আশ। সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্য নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা থাকবে শতভাগ। আবার হয়তো কিছুদিন দেখা হবে না প্রিয় মানুষের মুখ, আলিঙ্গন হবে না পরস্পর, গোল বৈঠকে গল্প-হাসিতে মাতিয়ে তোলা হবে না চারপাশ। উদাস মন ছুটে যাবে বারবার অতীতে। তখন হয়তো ঢেউয়ের মাঝের ওই দেড় মাস হবে আমার মনের এক মহৌষধ, ভালো থাকার অনুপ্রেরণা। জীবনের সাথে কুড়িকুড়ি বছরটি জড়িয়ে রাখার উপায়। আমার রুপালি পঞ্চাশকে স্বাগত জানানো।
খুরশীদ শাম্মী : টরন্টো, অন্টারিও