সাহাদাত হোসেন পরশ : মিরপুর ১০ নম্বর বি ব্লকের ১৫ নম্বর সড়ক। এই সড়কের দু’পাশে মোট ১৬টি বাড়ি। এর মধ্যে ১১টি বাড়িতেই ঝুলছে টু-লেট। ঢাকায় বাসায় বাসায় ভাড়াটিয়া সংকট কতটা তীব্র, তা স্পষ্ট এই এক দৃশ্যপটে। শুধু মিরপুরের বি ব্লকের চিত্র নয়, ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় এখন ভাড়াটিয়ার অভাব। একসময় ঢাকায় কাঙ্ক্ষিত এলাকায় সাধ্যের মধ্যে ভাড়ায় বাসা পাওয়া যেন ছিল ‘সোনার হরিণ’। করোনাকালে বদলে গেছে সেই অবস্থা। মহামারির এই সময়ে অনেকেই কাজ হারিয়ে ঢাকা ছাড়ছেন। কারও আবার আয় কমে যাওয়ায় রাজধানী ছেড়ে আশপাশ এলাকায় অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার এলাকায় বাসা নিচ্ছেন। অনেকে গ্রামে গিয়ে আর না ফেরায় বাড়িওয়ালা পড়েছেন বিপদে। নতুন ভাড়াটিয়া খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য হচ্ছে। ঢাকার একাধিক এলাকা ঘুরে বাড়িওয়ালাসহ সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বাসা ভাড়া নিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া, ভাড়াটিয়া হিসেবে যথার্থ সম্মান দেওয়া আর না দেওয়া নিয়ে অনেক কাল ধরে ঢাকার অধিকাংশ বাড়ির মালিকের সঙ্গে তার ভাড়াটিয়ার সম্পর্ক খুব বেশি ভালো ছিল না। তবে এর মাঝে ব্যতিক্রমও রয়েছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে বাড়ির মালিক আর ভাড়াটিয়া কেউ যেন খুব বেশি ভালো নেই। উভয় পক্ষই রয়েছে সংকটে। করোনাকাল দীর্ঘায়িত হলে আগামীর অজানা শঙ্কা আরও প্রকট হবে।
মিরপুর ১০ নম্বর বি ব্লকের ১৫ নম্বর সড়কের ১২ নম্বর বাড়ির মালিক মো. রাসেল। তিনি সমকালকে জানান, আট রুমের একটি মেস রয়েছে তার। একেকটি রুমের ভাড়া সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত। করোনা সংক্রমণের পর থেকে গত চার মাস তার পাঁচটি রুম খালি পড়ে আছে। যারা মেসে ছিলেন তারা বাড়ি গিয়ে আর ফেরত আসেননি। নতুন ভাড়াটিয়াও পাওয়া যাচ্ছে না।
রাসেল আরও বলেন, কর্মজীবী, ছাত্ররা তার মালিকানাধীন মেসে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতেন। তাদের রুমে খুব বেশি জিনিসপত্র থাকে না। বাড়িতে যাওয়ার পর মেসেও দামি কিছু তাদের নেই। তাই আর না ফিরলেও আর্থিকভাবে তারা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। তবে নতুন ভাড়াটিয়া না পেলে বাড়ির মালিকই নানা সংকটে পড়বেন।
ধানমন্ডি ১৫ এলাকার অধিবাসী রাশেদা খানম জানান, তার মালিকানাধীন তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে। একটিতে নিজেরা থাকেন। দুটি ভাড়া দিয়ে আসছিলেন। দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া বাবদ ৩৪ হাজার টাকা দিয়ে তাদের সংসারের খরচ চলছিল। গত তিন মাস ধরে দুটি ফ্ল্যাটই ফাঁকা পড়ে আছে। ভাড়াটিয়ারা গ্রামে গিয়ে আর ফেরত আসেননি। নতুন ভাড়াটিয়া না পাওয়ায় দুশ্চিন্তা বাড়ছে তাদের।
পল্লবীর বি ব্লকের বাসিন্দা আবদুল মোতালেব জানান, তার বাড়িতে ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে। নতুন ভাড়াটিয়া পাচ্ছেন না। মিরপুর ১০ নম্বরে ১৯ নম্বর লেনের ১/৩ নম্বর বাসার ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম জানান, তিন মাস ধরে তাদের ভবনে দুটি ফ্ল্যাট খালি রয়েছে। দু-একজন ভাড়া নিতে এলেও আগের তুলনায় অনেক কম ভাড়া দিতে চান। আগে একেকটি ফ্ল্যাট ভাড়া ছিল ১৮ হাজার টাকা। এখন ১৪ হাজার টাকার বেশি দিতে রাজি হচ্ছেন না।
আগারগাঁওয়ের তালতলা এলাকার অধিবাসী আবদুস সাত্তার জানান, ঢাকায় তার একাধিক বাড়ি রয়েছে। একটিতে বাড়িতে নিম্ন আয়ের লোকজন বসবাস করেন। করোনা সংক্রমণের পর ওই বাড়ির ভাড়া তিনি স্বেচ্ছায় মওকুফ করে দিয়েছেন। তবে অন্য দুই বাড়িতে মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছেন। তারা অনেকে বাড়ি গিয়ে আর ফেরেননি। বাসা খালি পড়ে আছে। আবার কয়েকজন ঢাকার বাসা ছেড়ে আশপাশ এলাকায় একটু কম ভাড়ার বাসা খুঁজে চলে গেছেন।
এপ্রিলে ব্র্যাক একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে। তাতে উঠে আসে করোনাভাইরাসের প্রভাবে তখনই মানুষের আয়-রোজগারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ওই জরিপে অংশ নেওয়া ৯৩ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে।
ঢাকার চাকরিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের আয়ের একটি বড় অংশ খরচ হয় বাসা ভাড়ায়। ব্র্যাকের আরেকটি পৃথক গবেষণায় উঠে এসে রাজধানীতে যাদের নিজেদের বাড়ি নেই এমন চাকরিজীবী বা শ্রমজীবী মানুষের আয়ের ৪৪ শতাংশ অর্থ বাসা ভাড়ায় ব্যয় হয়ে যায়। বাকি যে অর্থ থাকে, তা দিয়ে কোনোভাবে চলতে হয়।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদর্শ শহরে কোনো ব্যক্তির মাসিক আয়ের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ অর্থ বাসা ভাড়ার জন্য ব্যয় করতে পারেন। এর বেশি বাসা ভাড়ায় ব্যয় হলে তা হবে অস্বাভাবিক।
ব্র্যাকের গবেষণায় উঠে আসে- রাজধানীর ৮২ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। ৬৮ শতাংশ মানুষ ঢাকায় বাড়ি কেনার কথা ভাবেন না। ৫২ শতাংশ ক্ষেত্রে বাসা ভাড়ার পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাড়ির মালিকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, পুরান ঢাকা, মগবাজার, উত্তরা এলাকায় বাসা বাড়িতে অপেক্ষাকৃত টু-লেট বেশি। বিশেষ করে যেসব এলকায় নিম্ন আয়ের ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন বেশি বসবাস করতেন সেখানে বাসা খালি হচ্ছে। উপার্জন কমে যাওয়া ও অনেকের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবারের বাসিন্দাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে কেউ কেউ মেসে উঠেছেন। ঢাকা ছেড়ে কামরাঙ্গীরচর, সাভার ও গাজীপুরের দিকে কম ভাড়ার বাসা খুঁজে নিয়েছেন।
মিরপুরের লালকুট্টি এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, দোকানে দোকানে তৈরি পোশাক সরবরাহ করে সংসার চালাতেন তিনি। করোনার কারণে তার আয় বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
প্রাইভেটকার চালক ইব্রাহিম বলেন, প্রাইভেটকার চালিয়ে মাসে ১৪ হাজার টাকায় আয় ছিল তার। করোনার মধ্যে চাকরি হারিয়েছেন। নতুনভাবে চাকরি না পাওয়ায় গ্রামের বাড়ি ভোলা থেকে আর ঢাকায় ফেরেননি। নাম প্রকাশ না শর্তে মোহাম্মদপুরের একজন বাড়িওয়ালা জানান, বাসা ভাড়া কমিয়ে দেওয়ার পর ভাড়াটিয়া পাওয়া যাচ্ছে না। এ ধরনের অবস্থায় কখনও পড়তে হয়নি।
করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়েই অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে আছে। বাংলাদেশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ চালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে দিনমজুর থেকে শুরু করে চাকরিজীবী সবার জীবনের এরই মধ্য উপার্জনের বৈরী হাওয়া লেগেছে। এর প্রভাব পড়ছে বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে।
ঢাকায় মেসে বসবাসকারী অধিকার নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ করছে ‘বাংলাদেশ মেস সংঘ’। সংগঠনটির মহাসচিব আয়াতুল্লাহ আখতার বলেন, পুরো ঢাকার মেসের বাসিন্দাদের নিয়ে তাদের জরিপ রয়েছে। সেখানে উঠে আসে মেসের বাসিন্দা প্রায় ২৫ লাখ। তাদের মধ্যে ছাত্র, কর্মজীবীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছে। করোনার এই সময়ে পুরো ঢাকাজুড়ে যারা মেসে থাকতেন তাদের অনেকে সংকটে পড়ে গেছে। একটি অংশ গ্রামে গিয়ে আর ফেরেসনি। তিনি আরও বলেন, মেসে যারা বসবাস করেন তাদের অনেকে ছোটখাটো পার্টটাইম জব করে খরচ চালান। এটাও বন্ধ। সব মিলিয়ে করোনা পরিস্থিতি মেস মালিক ও মেসের বাসিন্দাদের সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
করোনাকালে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের অধিকার নিয়ে একাধিক কর্মসূচি পালন করেছিল ‘নতুন ধারা বাংলাদেশ’। সংগঠনটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান শান্তা ফারজানা বলেন, করোনার মহামারিতে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল মওকুফে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের সংকট সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আমরা স্মারকলিপি দিয়েছি। পরে দেখলাম মওকুফের উল্টো ভূতুড়ে বিল দেওয়া হচ্ছে। দ্রুত এই সমস্যা সমাধানে সংশ্নিষ্টদের মনোযোগী হতে হবে।