অনলাইন ডেস্ক : ঢাকার পূর্বাঞ্চলের নিচু এলাকা প্লাবিত হতে পারে। দ্রুত ভ্রাম্যমাণ পাম্প বসাতে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ।
উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট দিয়ে শুরু হয়ে বন্যার পানি এখন দেশের মধ্যাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকায় চলে এসেছে। গত মঙ্গলবার বন্যার পানি ঢাকার চারপাশের জেলাগুলোতে পৌঁছে গেছে। ঢাকার নবাবগঞ্জ, দোহার ও মানিকগঞ্জের নিম্নাঞ্চল এখন বন্যার পানির নিচে। সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে পানি চলে আসতে পারে।
ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলে বেড়িবাঁধ থাকলেও পূর্বাঞ্চলে বন্যা ঠেকানোর মতো বাঁধ বা অন্য কোনো অবকাঠামো নেই। পূর্বাঞ্চলে বেশির ভাগ নিচু এলাকার জলাভূমি ভরাট করে আবাসিক এলাকা করা হয়েছে। ফলে পানি এসে সেই আবাসিক এলাকাগুলোকে প্লাবিত করবে সহজেই।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঢাকা ওয়াসা পানিনিষ্কাশনের জন্য পাঁচটি স্থানে পাম্প স্থাপন করলেও তা পূর্বাংশের নিম্নাঞ্চলকে বন্যামুক্ত করতে পারবে না। গোড়ান, বনশ্রী, বাসাবো, আফতাবনগর, সাঁতারকুলসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় কমপক্ষে ৫০ লাখ মানুষের বসবাস। এ ছাড়া ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মধ্যবর্তী ডেমরা, যাত্রাবাড়ী ও ডিএনডি বাঁধ এলাকাতেও বন্যার পানি আসতে পারে। বিস্তীর্ণ এলাকায় একবার পানি ঢুকে পড়লে তা কমপক্ষে এক সপ্তাহ লাগবে নামতে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক বলেন, ‘ঢাকার দিকে বন্যার পানি আসছে, সেটা আমরা জানি। ডিএনডি এলাকায় বন্যার পানি দূর করতে সেনাবাহিনীর একটি টিম কাজ করছে। ঢাকায় পানি ঢুকে পড়লে তা নিষ্কাশন করার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি।’
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের হিসাবে, বর্তমানে দেশের ১৫টি জেলার প্রায় ১২ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। এদের জন্য প্রায় ১ হাজার আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেগুলোতে প্রায় ২১ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ১ হাজার আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। আজ বুধবার দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত ১৪টি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
দেশের বন্যা পরিস্থিতি তুলে ধরতে গতকাল ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বন্যা মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগ তুলে ধরে বলেন, বন্যার পানি ১৭ জুলাই সর্বোচ্চ বাড়বে। সেই বৃদ্ধিটা আরও এক থেকে দুই সপ্তাহ স্থায়ী হবে। ২৩টি জেলায় বন্যা বিস্তৃতি লাভ করবে। ভারতের মেঘালয়, চেরাপুঞ্জী, আসাম, ত্রিপুরা এবং চীন ও নেপালের পানি এসে দেশে এই বন্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তিনি।
ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বন্যায় আক্রান্ত জেলার সংখ্যা এখন ১৭। বন্যায় আক্রান্ত মোট ইউনিয়নের সংখ্যা ৪৬৪।
ঢাকার চারপাশে নদীর পানি বাড়ছে
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, পদ্মার পানি প্রতিদিনই অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। জেলার হরিরামপুরে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ উপজেলার দৌলতপুরের প্রায় ২০০ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এখনো জেলায় কোনো আশ্রয়কেন্দ্র চালু হয়নি।
বাঘুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তোফাজ্জাল হোসেন জানান, পানি বাড়ায় তাঁর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণদী, কাশি দয়ারামপুর, রামনারায়ণপুর, পুরানপাড়াসহ আরও কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ব্রাহ্মণদী গ্রামের বেশ কয়েকটি বসতভিটায় পানি ঢুকেছে।
নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, শীতলক্ষ্যার পানি বাড়লেও এখনো তা নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করেনি। তবে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, আগামী তিন–চার দিনের মধ্যে জেলার নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলোর মধ্যে তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গার পানি দ্রুত বাড়ছে। ঢাকা শহরের পশ্চিমাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকার পয়োনিষ্কাশন লাইন বুড়িগঙ্গা ও তুরাগে গিয়ে পড়েছে। আর পূর্বাংশের পয়োনিষ্কাশন লাইন পড়েছে বালু ও শীতলক্ষ্যায়। কিছু অংশের নিষ্কাশন নালা হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন লেকের মধ্যে পড়েছে। ফলে ঢাকার চারপাশের নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি চলে গেলে রাজধানীর বড় অংশের পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবে। আর বিপৎসীমা অতিক্রম করলে খালগুলো দিয়ে পানি নিম্নাঞ্চলে প্রবেশ করতে পারে।
ঢাকা ওয়াসার পানির পাম্প রয়েছে কল্যাণপুর, সেগুনবাগিচা, রামপুরা ও জনপদে। আর গোড়ানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাম্প আছে। সাধারণত পানির উচ্চতা ৩ দশমিক ৬৫ মিটার উঠলেই গেট বন্ধ করে দিয়ে পাম্পগুলো চালু করে ঢাকা ওয়াসা। গতকাল পর্যন্ত পানির উচ্চতা সাড়ে ৩ মিটার পর্যন্ত ছিল। তবে প্রতিদিনই পানির উচ্চতা বাড়ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন বলেন, ঢাকা শহরের পশ্চিমাংশের ১৬৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বেড়িবাঁধ থাকায় সেখান দিয়ে পানি প্রবেশ করতে পারবে না। তবে পূর্বাংশের কিছু নিচু এলাকায় পানি ঢুকলে বেশি কিছু করার নেই। পানি পাম্প করে দ্রুত নামানোর চেষ্টা করতে হবে।
এদিকে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গে গতকালও ভারী বৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিদিনই ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টি আগামী দু-তিন দিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। এর ফলে আগামী তিন-চার দিন উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ। এখানে প্রতিবছর বন্যা হবে এবং যদি তা ২০ শতাংশ এলাকার মধ্যে থাকে, তাহলে তা এখানকার জন্য ভালো। কারণ, এতে সারা বছর ভূগর্ভের পানি পূর্ণ ভরাট হয়। তবে রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হচ্ছে, বন্যার পানি ঢুকে পড়লে তা নামতে বেশি সময় লাগবে। এর কারণ হলো, নদীগুলোর প্রবাহ পথে বাঁধ ও সড়কসহ নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি মনে করেন, ঢাকার পানি নামানোর জন্য আপাতত করণীয় হলো, চারপাশের নদীগুলোর সঙ্গে সংযোগ খালগুলো দ্রুত যুক্ত করা এবং ভ্রাম্যমাণ পাম্প বসিয়ে নিম্নাঞ্চলের পানি সরানোর দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।