অনলাইন ডেস্ক : গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অনেকটা টানাপোড়েন চলছিল। তবে সেই সরকার উৎখাতের পর শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। নজিরবিহীনভাবে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে একান্তে এবং আন্তরিকতাপূর্ণ বৈঠক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এই সরকারকে পূর্ণ সমর্থনের পাশাপাশি যেকোনো ধরনের সহযোগিতায় প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন তিনি।

এক বিবৃতিতে হোয়াইট হাউজ বাংলাদেশের নতুন সংস্কার কর্মসূচিতে অব্যাহত মার্কিন সমর্থনের কথা জানিয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশে তাদের আশ্রয়দানকারী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে প্রায় ২০ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে।

ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা জানিয়েছেন, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত সেই সুযোগ কাজে লাগানো।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারপ্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের জাতিসংঘে উপস্থিতির পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো যে উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা থেকে বাংলাদেশও যেমন সহযোগিতার বার্তা পেয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা পেয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বিবিসিকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অধ্যাপক ইউনূসের যে গ্রহণযোগ্যতা, তাতে এ ধরনের অভ্যর্থনাই তার জন্য স্বাভাবিক। প্রভাবশালী রাষ্ট্র নেতারা যেভাবে তাকে গ্রহণ করেছেন তাতে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও বেড়েছে।’

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বাংলাদেশে যে একটি নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বা দেশটি যে নতুন দিকে যাচ্ছে সেই বার্তাই মুহাম্মদ ইউনূসের মাধ্যমে বাইরের পৃথিবীতে গেল। তাকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রে যা হয়েছে তাতে বাংলাদেশ নিয়ে ইতিবাচক বার্তা বিশ্ব পেয়েছে। এখন বাংলাদেশ যে প্রক্রিয়ায় এগোতে চাইছে তা নিয়ে বিশ্ব বুঝতে চেষ্টা করবে। আবার বাংলাদেশও এটি জেনেছে যে সংস্কার কার্যক্রম বৈশ্বিক সমর্থন পাবে।’

হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য বার্তাটা পরিষ্কার যে, নতুন প্রেক্ষাপটে বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে আগ্রহী। এখন তারা যাতে সহযোগিতা করতে পারে সেই ক্ষেত্র বাংলাদেশকে প্রস্তুত করতে হবে। অধ্যাপক ইউনূস এমনি বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত। এখন তিনি সরকারপ্রধান। এটার একটা সুবিধা যে বাংলাদেশ পাবে তারও ইঙ্গিত আছে।’

এদিকে সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) মো. শহীদুল হক জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ড. ইউনূস-বাইডেন বৈঠকের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমাকে বিস্মিত করেছে৷ জড়িয়ে ধরা, গলায় হাত রাখা, এরকমটি সাধারণভাবে দেখা যায় না৷ এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায় অন্তর্বর্তী সরকার ও সংস্কারকে পুরো সমর্থন দিয়েছে তারা৷ এখন সরকারের দায়িত্ব হবে এই সমর্থন কাজে লাগিয়ে সংস্কারের কাজ করা৷’

শহীদুল হক বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা হয়েছে৷ আশা করি এখন এই সংকট নিরসনে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবে৷ জিএসপি সুবিধা নিতে কাজ করতে হবে৷ অর্থনৈতিক সংস্কার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য কাজে লাগাতে হবে৷’

শহীদুল হক মনে করছেন, ‘এখানে ভূরাজনীতির একটা ভারসাম্য হবে৷ ভারত আর এককভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না৷ যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও বৈঠক করেছেন বাইডেন৷ কিন্তু বাইডেন বাংলাদেশের ব্যাপারে তার সমর্থন স্পষ্ট করেছেন৷ আর যদি কমলা হ্যারিস ক্ষমতায় আসেন তাহলে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে৷’

তবে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত৷ তিনি বলেন, ‘মার্কিন স্বার্থের জায়গাগুলো বুঝতে হবে৷ সেইখানে বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে।’

অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের এত সমর্থন বাংলাদেশ কখনো পায়নি বলে মনে করেন আরেক সাবেক রাষ্ট্রদূত এস এম রাশেদ আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘শুধু বাইডেন নয়, অন্য রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে ড. ইউনূসের যে বৈঠক হয়েছে তাতেও স্পষ্ট যে, সারা বিশ্বের সমর্থন আছে তার ও তার সরকারের প্রতি৷ এখন অ্যামেরিকা ও ইউরোপ সমানভাবে ইউনূসের সঙ্গে আছেন৷ সেটা কতটা দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগানো যায় সেটাই দেখার বিষয়৷’

রাশেদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিতে পোশাক খাতের একটা বড় অবদান আছে৷ যুক্তরাষ্ট্র একক দেশ হিসেবে আমাদের তৈরি পোশাকের বড় ক্রেতা৷ ইউরোপে আমাদের বড় বাজার৷ এই বাজারগুলোতে আমাদের অবস্থান আরও শক্ত করতে হবে৷ আর বাংলাদেশে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আছে৷’

সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে৷ পোশাক খাত নিয়েও হচ্ছে৷ আঞ্চলিক রাজনীতিতেও সেটা আছে৷ তবে মার্কিন ও ইউরোপের এই সমর্থনে বাংলাদেশ সেটা কাটিয়ে উঠবে আশা করি৷’

রাশেদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের এত সমর্থন বাংলাদেশ কখনো পায়নি৷ জো বাইডেনের যে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ড. ইউনূসের সঙ্গে, তা অনবদ্য৷ এটা বলে দেয় তার এগিয়ে যাওয়ার পথে সব ধরনের সমর্থন দেবে যুক্তরাষ্ট্র৷’