আতোয়ার রহমান : আমার মনে আছে এটা ছিল ২০১০ সালের গ্রীস্মকাল, যখন আমি প্রথম কানাডায় আসি। সেই থেকে আমি টরন্টোর ড্যানফোর্থ অ্যাভিনিউ-এ বসবাস করলেও প্রতিদিন এটি আমার কাছে নতুন রুপে প্রতিভাত হয়। কোন বস্তু বা স্থানের মধ্যে আত্মা থাকে কিনা জানি না, তবে এখানে কেমন যেন একটা প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করি আমি। বাংলাদেশি প্রবাসীদের প্রায় সকলেই এখানে বসবাস করে, কেউ আগে, কেউ পরে।
আমিও গত পাঁচ বছরে ড্যানফোর্থ অ্যাভিনিউ-এর দুটো ঠিকানায় থেকেছি। পাঁচ বছর আগে প্রথম যখন আমার স্ত্রী রুনাকে সাথে নিয়ে ড্যানফোর্থ অ্যাভিনিউতে আসি, সেই সময়ের কথা আমার এখনো মনে পড়ে। আমার ক্রিসেন্ট টাউনের ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টের দশ তলার বাসায় যখন উঠি, তখনই বুঝতে পারি যেরকম চেয়েছিলাম, আমাদের নতুন বাসাটি ঠিক সেরকম। পথঘাট চেনা হল। ধীরে ধীরে জায়গাটি ভাল লাগতে লাগল। বাচ্চারা স্কুলে ভর্তি হলো।
শুরুতে বেশ আনন্দেই দিন কাটতে লাগল। কিছুদিন পর মনে হলো বাসাটা আমাদের জন্য ছোট হয়ে গেছে, আরও বড় বাসা দরকার। আগে থেকেই লেখালেখির অভ্যেস। এখানে এসে শুরুর দিকে কাজের চাপে লেখালেখিটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন থেকে এখানকার বাংলা পত্রিকাগুলোতে আবার লেখালেখি শুরু করেছি। পূরনো বইপত্র, ম্যাগাজিন সংগ্রহ করছি, কিন্তু সেগুলো রাখার মত পর্যাপ্ত জায়গা নেই। ডজ রোডস্থ পাবলিক লাইব্রেরীতে মাঝেমধ্যে যাই, বাংলা বইয়ের সংগ্রহ দেখে যুগপৎ অবাক ও আনন্দিত হই।
এক বছর পরে একই রাস্তার ধারে অন্য বøকে আর একটা ভবনের আট তলায় বড় একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলাম। বন্ধুদের সহায়তায় বেড, কম্পুটার টেবিল, চেয়ার এবং কয়েক ব্যাগ ভর্তি বই রাস্তার ওপারে সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিয়ে আসলাম। এ অ্যাপার্টমেন্টা বেশ বড়সড়-লিভিংরুম-ডাইনিংরুম, কিচেন, দুই বেডরুম এবং বাথ। সাবওয়ে, স্কুল সহ সবকিছুই হাঁটার দুরুত্বে। বাসার মালপত্র বহন শেষে একসাথে বসে বিস্কিট ও চা খেলাম। খাওয়া শেষে বন্ধুরা চলে গেলে আমি ও রুনা আমাদের নতুন বাসা সাজানো গোছানো শুরু করলাম।
এতদিন পরে এখনও আমার দ্বিতীয় অ্যাপার্টমেন্টটি মানশ্চোখে দেখি। বাদামি কাঠের মেঝে, মাঝে মাঝে ছাল উঠে গেছে, আমি খালি পায়ে হাঁটার সময় পায়ের পাতায় তার স্পর্শ অনুভব করি। কক্ষের ভিতরে সুপরিসর জায়গা, সেখানে বইপত্র, ল্যাপটপ, টেবিল রাখলাম। পশ্চিম মুখি বাসা, দিনের বেলায় বসার কক্ষটি শীতল ও স্বল্প আলোকিত এবং সন্ধ্যায় গোধুলির আগে অস্তগামী সূর্যের আলোক রশ্মিতে কিছুক্ষণের জন্য জমকালো রুপ ধারণ করত।
শুরু থেকেই ড্যানফোর্থের দিনগুলি ভালভাবেই কাটতে লাগল। কিচেনে কফি বানিয়ে নীল চায়না কাপে নিয়ে পিছনে ঝুলবারান্দায় বসতাম, রুনা ও আমি মুখোমুখি বসে কথা বলতাম আর কফি খেতাম, সকালে কচি রোদের আলোকে স্নাত আশেপাশের বাড়িগুলোতে তাকাতাম, সেখানে বসে আমি ল্যাপটপে কাজ করতাম। বসন্তে ওখানে বসে, আমি লাইলাকের ঝোপ থেকে আসা সুবাসের গন্ধ্য পেতাম, এবং শীতকালে, জানালার কাঁচের ওপরে ল্যাপটানো তাপরোধক প্লাস্টিকের উপর দিয়ে ঝাপসা চোখে তাকাতাম এবং পড়ন্ত আলোতে তুষার ঢাকা বৃক্ষে স্ফটিকের মিনার দেখতাম, গলে পড়া বরফের মৃদু রিনিঝিনি শুনতাম।
ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে যখন বাইরে তাকাতাম, দেখতাম গাছ ও জানালাগুলো, গলিগুলো, বাড়ির পেছনের বেড়া দেয়া গোলাপ ও টিউলিপ ফুলের বাগানগুলো। আমি প্রতিবেশি বাড়িগুলোর রহস্যগুলো উপভোগ করতাম, একজন প্রতিবেশি যে তার মোটরসাইকেল ঘরের ভিতর রেখে নিজে গ্যারাজে ঘুমাত, ডাকপিয়নটি যে একটা বড় ব্যাগ হাতে সকালবেলা নিয়মিত চিঠি ও পার্সেল বিলি করত, মধ্যবয়সী মোটা লোকটি যে তার মোটা তাজা কুকুরটিকে ডেন্টোনিয়া পার্কে জমে থাকা শুভ্র বরফের উপরে দৌড়াদৌড়ী করাতো। পড়ন্ত কোন বিকেলে ডেন্টোনিয়া পার্কে ছেলেদের বেসবল খেলা দেখতাম, কখনো দেখতাম একটা হামিংবার্ড পার্শ্বের ঝোপের একটা তরুন ওক গাছের লতায় ঝুলন্ত ফুল থেকে চমৎকার কৌশলে মধু পান করছে। আবার কখনো দেখতাম স্কুল পড়ুয়া ছেলেদের সিগারেট খেয়ে পার্কের বেড়ায় লাথি মারতে।
এখানে আসার শুরুর দিনগুলোর একদিন। আমি আমার বাসার কাছে ড্যানফোর্থ অ্যাভিনিউয়ের একটি ব্যাংকে গেলাম একটা হিসাব খোলা ও একটা ক্রেডিট কার্ডের জন্য। একজন ছোটখাট চশমা পরা আধা বয়েসি সোনালি চুলের মহিলা কাউন্টারে আসলো।
“তুমি কী চাকরি কর?”
আমি তাকে বললাম।
সে তার মাথা নিচে নামাল এবং আমতা আমতা করে কি যেনো বললো।
“বেকার?”
“না।”
সে যখন আমার নাম, ঠিকানা এবং অন্যান্য খুঁটিনাটি লিখছিল, আমি বুঝতে পারছিলাম সে বিশ্বাস করছিল না যে আমি কোন চাকরি বাকরি করি। আমি আশ্চর্য হলাম কেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার গায়ে ছিল একটা নতুন শীতের কোট। আমি একটা টাই, একটা পরিপাটি শার্ট, একটা ঘন কাল রঙের স্যুট পরেছিলাম। এক জোড়া ভাল জুতাও ছিল আমার পায়ে।
পশ্চিমে ডন ভেলি থেকে পূর্বে লরেন্স এভিনিউ পর্যন্ত বিস্তৃত ড্যানফোর্থ অ্যাভিনিউ। দেখতে অনেকটা হাইওয়ের মত। টরন্টো নগরীর যখন পত্তন হয় সেই সময় আজ থেকে সাড়ে তিনশত বছর আগে তৈরি এ সড়কটি। জনশ্রুতি অনুযায়ী তারও অনেক অনেক আগে বরফ যুগে সৃষ্ট লেক অন্টারিওর উত্তর পার্শ্বের এ জনপদটি ছিল ডাইনোসরদের অবাধ বিচরণভূমি। তাই বলে এখানকার অধিবাসীরা আধুনিক ডাইনোসর নয়, তারা উদ্যমী ও নতুন নতুন ধারণা, ভাব ও রীতির প্রবর্তয়িতা। সড়কের দুই পাশে ওক, পাইন, ম্যাপল ইত্যকার হরেক রকম গাছের সারি, নানারকম গায়ক পাখির সেখানে সরব কলরব। সন্ধ্যায় চাঁদ এবং তারাগুলো বাগানের শিশিরসিক্ত সদ্য-ফুটিত ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সড়কটির পশ্চিম অংশে ব্রডভিউ থেকে উডবাইন পর্যন্ত গ্রীক বংশোদ্ভুত অধিবাসীদের আধিক্য আর মেইন স্ট্রীট থেকে এগলিন্টন পর্যন্ত এলাকায় সবচেয়ে বেশি বাঙালির বসবাস। এ এলাকার বেশিরভাগ দোকানপাটের মালিক বাংলাদেশি এবং সেগুলোর সাইনবোর্ডও বাংলা হরফে। রাস্তায় বের হলে এত বেশি বাঙালির পদচারণা দেখে মনে হয় হয়ত একসময় এ এলাকাটা ঢাকা অ্যাভিনিউ হিসেবে পরিচিতি পাবে।
ছুটির দিনগুলোতে সময় কাটানোর জন্য ড্যানফোর্থের রেস্তোরাঁগুলোতে বসি। বন্ধু, পরিচিতজন অথবা রিয়েল এস্টেট এজেন্টদের সাথে আড্ডা দেই, হাসাহাসি করি। ড্যানফোর্থের রেস্তোরাঁগুলোতে আমাদের এ আড্ডা চলে গভীর রাত পর্যন্ত। দেশে ফেলে আসা দিনগুলো, দেশের রাজনীতির হালচালই মূলত আমাদের এসব ঘরোয়া আড্ডার আলোচনায় উঠে আসে। গণজাগরণ থেকে হেফাজত কোন কিছুই বাদ যায় না। দলের সমর্থক হোক আর না হোক সবাই দলীয় লাইনে যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করে। যুক্তি তর্ক চরম উত্তেজনার পর্যায়ে চলে যায় কখনো কখনো।
বন্ধু সেলিম বেশ কয়েক মাস আগে আমার বাসার কাছেই রাস্তার অপরদিকের অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছে। ও দুবছর মন্ট্রিয়লে থাকার পর এখানে এসেছে। আজ ওর বাসায় দাওয়াত খেলাম। ওর ছোট বাচ্চাটির বয়স এখন ছয় বছর আর বড়টির বয়স দশ বছর। বড়টির নাম বর্ণীল আর ছোটটির নাম মৃত্তিকা। বর্ণীল অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলে, তবে অ্যাক্সেন্টা এখনো বাংলাদেশি। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারে, তবে বাংলায় লেখা ও পড়া ভুলে গেছে। ওরা কোন স্কুলে, কোন গ্রেডে পড়ে তা জিজ্ঞেস করলাম। একেবারে কানাডিয়ান ইংরেজিতে সপ্রতিভ উত্তর দিল। বর্ণীল আগে আমাকে চাচু বলতো, কিন্তু আজ সে আমাকে আঙ্কেল বলে সম্বোধন করল। ওদের চালচলনে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। কিন্তু মৃত্তিকার অ্যাক্সেন্টটাও এখানকার। বাংলায় লেখাপড়া তো ভুলে গেছে, বলাও ভুলে গেছে। যদিও তার বাংলা নামটা এখনও ঠিক আছে। সেলিমকে বিষয়টা নিয়ে ভাবিত মনে হলেও নীলা ভাবিকে বরং খুশিই মনে হল তাদের বাচ্চাদের এই সা¤প্রতিক পরিবর্তনে। সেলিম খুশির খবর দিয়ে বললো ও শীঘ্রই আবার বাবা হতে যাচ্ছে, আশা করছে এবার তাদের একটা ছেলে সন্তান হবে। বর্ণীল ও মৃত্তিকা তাদের হবু ভাইকে নিয়ে আনন্দ করার জন্য উচ্ছ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করছে। ডাল, চচ্চড়ি, বেগুন ভাজি আর ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে, হবু মা বাবাকে অগ্রিম অভিনন্দন জানিয়ে বাসায় ফিরলাম।
আজ রোববার। আমাদের দুজনেরই ছুটির দিন। রুনা লাল পাড়ের নীল শিফন শাড়ি আর আমি সাদা স্পোর্টস শার্ট ও নীল রঙের জিন্স প্যান্ট পরে রেস্তোরাঁয় ডিনার খেতে গেলাম। পূর্ব দিকের কোণার টেবিলে কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ তরুণ গোল হয়ে বসে তন্দুরী আর কাবাব খাচ্ছে। দক্ষিণ পার্শ্বের কোণার কক্ষে একজনের বার্থডে পার্টী হচ্ছে। মোমের আলোয় সবাই দাঁড়িয়ে একটা গান গাচ্ছে। ওদের দেখে আমার বাচ্চারাও দাঁড়িয়ে গান গাওয়া শুরু করল। ওরা খুবই অনুকরণ প্রিয় হয়েছে। এ বয়সেই ওরা জাস্টিন বিবারের ভক্ত হয়েছে। ওরা যে বুদ্বিমত্তার সাথে অনুকরণ করে তা দেখে আমরা আশ্চর্য হই, আমার ও রুনার বুদ্ধি ও হাস্যরসের ধারণার বাইরে চলে যায়- ওরা দুজনই যেভাবে রাস্তায় দেখা কুকুরের সাথে বড়দের মত আচরণ করে, তাদের ধীরলয়ে হেঁটে যাওয়া ও তাদের চেহারা অনুকরণ করে। তারা কুকুরের বিভিন্ন ধরণের প্রকাশভঙ্গি দেখে বুঝতে পারে কুকুর কি চাচ্ছে, কি আশা বা কামনা করছে। এসব দেখে আমরা আনন্দিত হই।
বেশ কিছু ভাল রেস্তোরাঁ ছিল ড্যানফোর্থ অ্যাভিনিউ-এ। যে ধরনের আপনি চান ঠিক সেরকম, বাংলাদেশি, গ্রীক, চাইনিজ, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি, আফগান, ইটালিয়ান, ক্যারিবিয়ান। ছুটির দিনগুলোতে আমরা বাইরে যেতাম, কখনো রেস্তোরাঁয় খেতে যেতাম, কখনো নতুন নতুন জায়গায় বেড়াতে যেতাম। সিনেমা হলে নতুন কোন ছবি দেখতাম, লম্বা ছুটিতে টরন্টোর বাইরে কটেজ কান্ট্রিতে যেতাম, দু একদিন সেখানে থাকতাম, কিছু সময়ের জন্য প্রকৃতির খুব কাছাকাছি হয়ে দারুণ রোমান্টিক হয়ে যেতাম, মনটা হাল্কা হয়ে যেত। ড্যানফোর্থের কোন রেস্তোরাঁর খাবার বিখ্যাত তা আমাদের জানা। মনে পড়ে ঢাকায় থাকতে আমরা মাঝে-মধ্যে নীরব হোটেলে খেতে যেতাম, বিখ্যাত বিখ্যাত সব পদের খাবার পেট পুরে খেয়ে অনেক রাত করে বাসায় ফিরতাম। রুনাকে নিয়ে সুবিধা হল আমি যা যা পছন্দ করি, ও তাই পছন্দ করে, সংসার নিয়ে ওর বেশ রোমান্টিকতা। বিয়ের এতদিন হল, ওর রোমান্টিকতা এতটুকু কমেনি। শুধু ওর অতিরিক্তি কেনাকাটার বাতিক ছাড়া সব কিছুতেই আমাদের দুজনের মধ্যে মিল আছে।
কক্সওয়েল থেকে ভিক্টোরিয়া পার্ক অ্যাভিনিউয়ের মধ্যে সাইডওয়াকে দেখা হত অনেক শারীরিক প্রতিবন্ধি ও বৃদ্ধ লোকদের যারা ইঞ্জিনচালিত হুইলচেয়ারে সাইডওয়াকে চলাচল করছেন অথবা রাস্তা পার হচ্ছেন, ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়ার কেউ দৌড়াদৌড়ী করছেন, কেউ কেউ দেশে বাবা, মা, ভাইবোন, স্ত্রী পরিজনের কাছে টাকা পাঠাবেন। আবার কেউ তার আইফোন চেক করে দেখছেন তার উকিলের পাঠানো কোন গুরুত্বপূর্ণ বার্তা মিস করেছেন কিনা। আমি প্রায়ই এক বৃদ্ধা মহিলাকে হুইল চেয়ারে রাস্তা পার হতে সাহায্য করতাম। নাম লুসি। একটু ঝাঁকুনি লাগলেই সে রেগে যেত। রাস্তায় বের হই কিন্তু বেশ কিছু দিন আর লুসির দেখা নেই। ভাবছি তার কোন সমস্যা হয়েছে হয়তো। কয়েকদিন তাকে দেখতে না পেয়ে অনেক কষ্টে ঠিকানা যোগাড় করে ড্যানফোর্থ অ্যাণ্ড ভিক্টোরিয়া পার্কস্থ ওল্ডহোমে খোঁজ নিতে গেলাম। বিল্ডিং ম্যানেজার সিন্থিয়া বলল, দুদিন আগে লুসি মারা গেছে। শুনে মনটা খুব খারাপ হল।
আমি ডাউন্টাউনে তেমন যেতাম না। আমার নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছুই ড্যানফোর্থ থেকে কিনতাম, ভিক্টোরিয়া পার্ক অ্যাণ্ড ড্যানফোর্থের শপার্স ওয়ার্ল্ড প্লাজায় সব কিছুই পাওয়া যেত। তাছাড়া আমি যখন ব্লোর সাবওয়ে থেকে নামি, রাস্তা হারিয়ে ফেলতাম, দিক ভুলো হয়ে যেতাম। রুনা অবসর পেলেই এখানে আসে, এটা ওটা কেনে, কেনাকাটার বাতিক ওর দেশে থাকতেই ছিল, যেদিন ঢাকার বসুন্ধুরা সিটিতে ও দুপুরে যত, রাতে শপিংমলটি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ওর কেনাকাটা চলতেই থাকত। ওটা এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে গেছে, ও একটা শপাহলিকে পরিণত হয়েছে। কোন কিছু কিনে ও যে আনন্দ পায়, অন্য কিছুতে তা পায় না। লাল রঙের প্রতি ওর বাতিক। বাচ্চাদের জন্য লাল রঙের এতগুলো দামী খেলনা কেনার মানে হয়? এটা ওটা কিনে বাসাটাকে একটা মিনি শপিংমল বানিয়ে ফেলেছে। আর আমি আমার ড্রয়িং রুমটাকে পুরনো বই ম্যাগাজিন দিয়ে একটা মিনি লাইব্রেরী বানিয়ে ফেলেছি।
ভিক্টোরিয়া পার্ক অ্যাণ্ড ড্যানফোর্থ এলাকায় বেশ কিছু বাংলাদেশি গ্রোসারি আছে। এলাকাটা বাংলা টাউন নামে পরিচিত। বাংলা সুপার মার্কেট-রেস্তোরাঁ-সেলুন; কী নেই নাই সেখানে। দেশের মানুষ রেস্তোরাঁয় বসে চা-সিঙ্গারা, পেয়াজু খায় আর জমিয়ে বাঙালি স্টাইলে জম্পেশ আড্ডা দেয়। চারদিকে শুধু বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড দেখে মনেই হয় না যে আমি কানাডায় আছি, মনে হয় দেশের কোন শহরে এসেছি, হোক না তা কিছুক্ষণের জন্য। এসব দোকানে চাল-ডাল মশল্লা, লাউ, বেগুন, টমাটো ছাড়াও কই, শিং, মাগুর, ইলিশ ইত্যাদি সব মাছই পাওয়া যায়। আমি এখান থেকে আমার প্রিয় কই মাছ কিনি। রোবোটিক ব্যস্ততার ফাঁকে সপ্তাহান্তে আমি যখন এ দোকানগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটি, তখন স্বদেশের ঘ্রাণ অনুভব করি, স্বদেশি আমেজ পাই এখানে।
মে মাসের শেষ সপ্তাহ। গতকাল পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী মেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলো। রুনা ও আমাদের দুই সন্তানসহ আমরা মেলার শেষ দিনে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার সঙ্গীতানুষ্ঠান ‘বাংলাদেশ নাইট’ উপভোগ করলাম। প্রবাসী নতুন প্রজন্মের শিশুদের গান ও নাচের পরিবেশনায় মুগ্ধ হলাম। অনুষ্ঠানের শেষে ঢাকা থেকে আগত জনপ্রিয় শিল্পি রথীন্দ্রনাথ রায় ও মমতাজের কিছু অসাধারণ গান শুনলাম। রথীন্দ্রনাথ রায় যখন দরাজ কন্ঠে ‘তুমি আর একবার আসিয়া, যাও মোরে কান্দাইয়া’ গানটি গাচ্ছিল, রমিজ চাচাকে দেখলাম হেড়ে গলায় সবার সাথে গান গাচ্ছে আবার চোখেও পানি। বুঝলাম না তার চোখের পানিটা কি আনন্দের না কষ্টের। চাচাকে কখনো জিজ্ঞাসা করা হয়নি সেই চোখের পানির কথা।
আজ রোববার। আমার ও রুনার দুজনেরই ছুটির দিন। সকালবেলা ঝুলবারান্দায় বসে রুনার বানানো গ্রীন টি খাচ্ছি আর ভাবছি কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়। আমিই রুনাকে বললাম ‘বল তো কোথায় যাওয়া যায়? বিচে যাবে?’
‘চলো।’
ড্যানফোর্থ অ্যাভিনিউ ঘেঁষেই উডবাইন বিচ, ড্যানফোর্থ অ্যাভিনিউ থেকে উডবাইন রোড ধরে দক্ষিণে অল্প দূরেই। আমরা সেখানে সুবিশাল লেক অন্টারিওকে সামনে রেখে একটা পুরনো নিঃসঙ্গ কাঠের চেয়ারে পাশাপাশি বসলাম। এই গরমকালে সারাদিন হইহল্লা থাকে এখানে, অথচ সকালে এখানে নৈসর্গিক নির্জনতা বিরাজ করছে, স্বর্গীয় রুপ ধারণ করেছে সারিসারি বৃক্ষরাজি আর অতিকায় দানবাকৃতির লেক অন্টারিও ঘেরা এই টরন্টো নগরী। রুনার গাওয়া মিষ্টি সুরের গান শুনলাম, আমাদের কৈশোরের উদ্দাম প্রেমের দিনগুলোতে ফিরে গেলাম, সুখ-দুঃখের কথা বললাম, হাতে হাত রেখে, কাঁধে মাথা রেখে সুদূরের স্বপ্ন দেখলাম, ভালোবাসার সিঁড়ি বেয়ে সৈকতের গরম বালুতে হাঁটলাম অনেকদূর। লেকের অপূর্ব সৌন্দর্য সুধা উপভোগ করে এভাবে আমরা এখানে জীবনের অনেক আনন্দময় সময় কাটিয়েছি। যখনই আমার মন খারাপ হয় তখনই আমি উডবাইন বিচে চলে আসি, দুপুরের কোলাহলে ঘুরে বেড়াই বালির সৈকতে, গোধূলি আর সন্ধ্যায় বালিতে বসে গলায় গলা জড়িয়ে অস্তগামী সূর্যকে দেখি। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এলে আমার মন ভাল হয়ে যায়, আমি প্রাণশক্তি ফিরে পাই।
এর মধ্যে আমাদের কিচেনে ছারপোকার উৎপাত শুরু হয়ে গেল। টরন্টোর অন্যান্য অ্যাপার্টমেন্ট থেকে এটা ব্যতিক্রমি হল না। চারিদিকে এদের ডিম খোসা পাওয়া যেতে লাগল। একদিন রুনা চা খাওয়ার জন্য নীল কাপে হাত দিলে তা কাপের হাতলে বসে থাকা ছারপোকার উপর পড়লে সে ভয় পেয়ে চিৎকার করে কাপটি কক্ষের ভিতরে ছুঁড়ে মারে এবং কাপটি ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়। এ ছোট বাদামী রঙের প্রাণীটির সংখ্যা কমানোর জন্য প্রথমে কীটনাশক স্প্রে করি। তাদের সংখ্যা আরও বাড়ল। বরিক এসিড ব্যবহার করলাম। তারা সংখ্যায় আরও বেশি হলো। আমার কিচেনের দেয়ালের আনাচে কানাচে, পুরনো গ্যাস স্টোভের পাশে এবং কাঠ বিছানো মেঝের নিচে পরিস্কার করা অসম্ভব, এবং সেগুলো ছিল এদের প্রজননের বা বংশ বিস্তারের আদর্শ জায়গা।
সাধারণত যা ঘটে অন্য অ্যাপার্টমেন্টবাসীরা আমার চেয়ে বেশি আক্রান্ত হল এ ক্ষুদ্র প্রাণীটি দ্বারা। এককভাবে এটাকে দমন করা যে সম্ভব নয় অল্প কিছুদিনে তা বুঝে গেলাম। আমরা তিনজন মিলে বিল্ডিং সুপারিন্টেন্ডেন্ট জুলির কাছে গেলাম এবং বিশেষ রাসায়নিক ঔষধ স্প্রে করার দাবি জানালাম। আমরা এরকম দাবি করায় জুলি আমার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকাল, বিরক্তি প্রকাশ করল। দাবির কাছে মাথা নত করা মর্যাদার হানি হওয়ার শামিল তার কাছে। জুলি ছারপোকা সংকটকে গুরুত্ব দিল না।
‘চিনির সঙ্গে বিষ মিশিয়ে মেঝেতে ছিটিয়ে দাও’ বলে সে আমাদের মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দিল।
আশপাশের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ভাড়াটিয়াদের নিয়ে ছারপোকা সংকট নিয়ে মিটিং করলাম।
‘ছারপোকার হুমকির কাছে আমরা আত্মসমর্পণ করতে পারি না। মানুষ এই পরিবেশে বাশ করতে পারে না। এসব ব্যাপারে আইন আছে’ সমবেত সকলে বলল এবং আমরা একমত হলাম।
এ সংকট সমাধানে জুলির অযথা বিলম্ব করা ও দায়সারা গোছের তৎপরতার কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাব। জানানোর এক সপ্তাহের মধ্যে একজন স্বাস্থ্য পরিদর্শক আসলো এবং ঔষধ ছিটানোর অর্ডার দিল। কয়েকবার স্প্রে করার পর এদের উৎপাত কিছুটা কমলো।
যাহোক ছারপোকা সংকট নিয়ে জুলির সঙ্গে আমাদের তিক্ততা বাড়ল। বাসার অন্যান্য সমস্যা যেমন-হিটার, ফ্রিজ কাজ না করা ইত্যাদি বিষয়ে সে আর আগের মতো সহযোগিতা করতো না। এর মধ্যে জুয়েল ও নাথান বাসা ছেড়ে মিডল্যান্ড অ্যাভিনিউ-এ চলে গেল। এরিককে বাসা থেকে উচ্ছেদ করলো। আমরা সকলেই যেন একই পরিবারের সদস্য হয়েছিলাম। সে পরিবারে ভাঙ্গন দেখা দিল। যেকারণে পরবর্তীতে বাড়ি ছেড়ে দেয়ার দিন আমার জিনিসপত্রগুলো সরানোর সহায়তা করার জন্য পুরাতন প্রতিবেশি ও বন্ধুদের কাউকে কাছে পাইনি।
এতদিনে আমি কিছু টাকা সঞ্চয় করেছি। রুনা ও আমি এবার একটা বাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নিলাম। ড্যানফোর্থ এলাকায় বাড়ির দাম অনেক বেশি। তাই অল্প দূরে বার্চমাউন্ট রোডে একটা বাড়ি কিনলাম। জুলিকে আগেই বাড়ি ছাড়ার নোটিস দেয়া ছিল। নোটিস পেয়ে জুলি মনে মনে খুশিই হয়েছিল হয়ত।
সেপ্টেম্বরের প্রথম মঙ্গলবারে আমি আমার নতুন বাসায় উঠলাম। গাড়িতে বাসার জিনিসপত্র বোঝাই করা হলো। মনে হলো যাওয়ার সময় জুলির সংগে হয়ত দেখা হবে না। কিন্তু হঠাৎ দেখি কাছেই জুলি তার ড্রাইভওয়ে দিয়ে এগিয়ে আসছে। সে কি লক্ষ্য করছিল আমি অ্যাপার্টমেন্টের কোন কিছু সংগে করে নিয়ে যাচ্ছিলাম কি না? সে আমাকে বিদায় জানানোর ভঙ্গিতে হাত উঠাল।
‘তুমি অনেকদিন ধরে এখানে বসবাস করছ,’ সে বলল।
‘আমি তোমাকে মিস করবো।’
এর মধ্যে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। আজ আমি ড্যানফোর্থ অ্যাভিনিউ দিয়ে আমার আমার নতুন গাড়ি চালিয়ে গেলাম, এখানে আগে যে যে অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে ছিলাম, সেগুলো দেখলাম। অনেক পরিবর্তন হয়েছে, বাড়িগুলো সংস্কার করা হয়েছে, বাইরের দেয়ালের দাঁত বের করে থাকা মলিন ইটগুলোতে নতুন রঙ করা হয়েছে, বাইরে থেকে এগুলোকে আর জরাজীর্ণ মনে হল না। আমি প্রথম যখন এখানে এসেছিলাম, তখন আমার বাসার পার্শের রাস্তায় অল্পসংখ্যক লোক চোখে পড়ত। সবাই আমাকে চিনত, এমনকি তাদের পোষা কুকুরগুলোও। এলাকাটা এখন অনেক জনবহুল হয়েছে। আজকে রাস্তায় অনেক নতুন লোক দেখলাম। এদের অনেককেই চিনি না। একজন মোটা ভদ্রমহিলা, যাকে আমি আগে এখানে কখনো দেখিনি, সে দেখতে ডাইনোসরের মত একটা বড় গ্রে হাউন্ড কুকুর নিয়ে হাঁটছিল। আমি যখন তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, কুকুরটি আমাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
আতোয়ার রহমান : কবি ও কথাসাহিত্যিক, টরন্টো, কানাডা