আতোয়ার রহমান : কোভিড মহামারীর কবলে পড়ে গত দু’বছর সম্পূর্ণ গৃহবন্দি থেকেছি ড্যানফোর্থে তেমন একটা আসা হয় নি, ঘোরাফেরা করা বা আড্ডা দেয়া হয়নি, অন্যান্য অনেকের মতো একেবারে সম্পূর্ণ গৃহবন্দি থেকেছি। এ বছর ভ্যাক্সিনে ভর করে আড়মোড়া ভেঙে ঘর থেকে বের হয়েছি।বেশ কয়েক দিন আগে আমার একটা ট্রাফিক টিকেট বিষয়ে কথা বলার জন্য ড্যানফোর্থের মিজান ফার্নিচার কপ্লেক্সের বেসমেন্টে প্যারালিগ্যাল আবুল শফিকুল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। অনেক দিন পর ওনার সাথে দেখা ও কথা হল এই কমপ্লেক্সে তার নিজ চেম্বারে। তিনি স¤প্রতি তার চেম্বার এই ভবনের উপর থেকে বেসমেন্টে মুভ করেছেন। অল্প সময়ে নানা বিষয়ে অনেক কথা হল।
এদিন টরন্টো তথা কানাডায় বাঙালিদের প্রাণকেন্দ্র ড্যানফোর্থে এসে অনেক পরিবর্তন চোখে পড়ল। শফিকুল্লাহ ভাই ও আমি প্রায় একই সময় ২০১০ সালে কানাডায় আসি এবং এই লেক অন্টারিওর গা ঘেঁষে অবস্থিত এই ড্যানফোর্থ এলাকায় বসবাস করা শুরু করি। তাই আমাদের ধুমায়িত লাল চায়ের আড্ডার আলাপচারিতা ও অতীতের স্মৃতিমন্থনে স্বাভাবিকভাবেই এক দশকের ব্যবধানে ড্যানফোর্থ এলাকায় ঘটে যাওয়া উন্নয়ন ও পরিবর্তন সহ অন্যান্য অনেক বিষয়ই চলে আসল।
আগে এখানে এখনকার মতো বাঙালিদের জমজমাট উপস্থিতি ছিল না। এখন দেখে মনে হয়, এ যেন এক মিনি বাংলাদেশ! এখন যেমন কমিউনিটি বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে দোকান পাট, অফিস, প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংখ্যাও। আগে যেমন এখানে মাত্র দুটী গ্রোসারি ছিল, এখন হয়েছে পাঁচটি। এশিয়ান ও কানাডিয়ানদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্য এখানে রয়েছে। মুসলিম ক্রেতাদের কথা বিবেচনা করে হালাল খাদ্য বিক্রী হচ্ছে। লোকজন সপরিবারে সবধরণের সামগ্রী ক্রয় করছে। এগুলো সপ্তাহের সাত দিনই সকাল ১০টা ঠেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
এক দশক আগে যখন এখানে প্রথম আসি, তখন এখানে এত ঘন ঘন দোকান পাট ছিল না। এত ক্রেতার সমাগমও ছিল না। দশ বছর আগের দেখা সেই শান্ত শিষ্ট ড্যানফোর্থ এখন প্রানচাঞ্চল্যে ভরপুর। এখানে এখন অনেক নতুন নতুন দোকান পাট ও অফিস হয়েছে। বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাওয়ায় এখানকার জাকজমক আগের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দোকানপাটের জৌলুশ ও বৈভব যেমন বেড়েছে, খরিদ্দারের সংখ্যাও তদ্রুপ বেড়েছে, স্বাভাবিকভাবে বেচাবিক্রির পরিমানও বেড়েছে। তবে ডাইনে বাঁয়ে ট্র্যাশবিন থাকা সত্তে¡ও রাস্তায় পাবলিক ট্র্যাশ প্রায় চোখে পড়ে। এদিকটায় আমাদের নজর দিতে হবে।হাতের জিনিষপত্র ছুড়ে ছুড়ে ফেলা জাবে না যত্রতত্র।
আগে যেখানে মিজান ফার্নিচার ছিল, সেখানে এখন অনেক দোকান চোখে পড়ল। ভেতরে ছোটখাট শপিংমলের মতো বিশাল স্পেস, হরেক রকমের দোকান, অফিস ও ছাত্রদের কোচিং সেন্টার। আশেপাশের পুরনো ঐতিহ্যবাহী বাঙালি দোকানগুলি যেমন ঘরোয়া, মক্কা, সুইস বেকারির পাশাপাশি নতুন কয়েকটি রেস্টুরেন্ট হয়েছে। এসব খাবার দোকানে প্রচুর ভোজনবিলাসী বাঙালির আনাগোনা চোখে পড়ার মতো। কিছু কানাডিয়ানও মাঝে মাঝে বাংলাদেশি খাবারের স্বাদ পেতে এসব রেস্তরাঁয় ঢুঁ মারে। এভাবে কানাডায় বাংলাদেশি কারির সুনাম ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। তবে টরন্টো তথা কানাডা জুড়ে সমাদৃত হওয়ার জন্য বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবারের মান আরও উন্নত করার অবকাশ রয়েছে। সাইডওয়াক দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় খাবারের দোকানগুলোতে হরেক রকম দেশি খাবার কেনার জন্য উপচে পড়া ভিড় সহজেই যে কারো নজরে পড়ে। চা, ঝাল-মুড়ি, ফুচকা, চটপটি, শিঙাড়া, সামোসা, লুচি, খেজুর গুড়, খিচুড়িতে মায়ের গায়ের গন্ধ সব মিলেমিশে স্মৃতির গন্ধ হয়ে ভাসে।
মারহাবা ও সরকারের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি নতুন গ্রোসারি চালু হয়েছে। স¤প্রতি চালু হওয়া ঢাকা-টরন্টো সরাসরি বিমান সার্ভিসের কল্যাণে সেগুলোতে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি দেশি তাজা মাছ, ফলমূল ও শাকসব্জি পাওয়া যায়। অনেকে টরন্টোর পার্শ্ববর্তী শহর বা দূর দূরান্ত থেকে এখানে কেনাকাটা করতে আসে, যেন এক টুকরো বাংলাদেশের ঘ্রাণ নিতে এখানে সবাই চলে আসে। রেস্তরাঁ ব্যবসায় সহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই কানাডায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের উন্নতি প্রতীয়মান হচ্ছে। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় বানিজ্য, উন্মোচিত হচ্ছে নতুন নতুন ব্যবসার সম্ভাবনা।
সাম্রতিক বছরগুলোতে এখানে ঢাকার গাওসিয়া মার্কেটের আদলে বিশাল আকারের কয়েকটি শাড়ির স্টল বসেছে। ক্রেতায় পরিপূর্ণ থাকে সেগুলো সবসময়।
বিয়ে, ঈদ বা পুজার সময় কাপড় কেনার জন্য এখন আর আমাদের ইন্ডিয়ান বা পাকিস্তানি দোকানে যেতে হয় না। রাস্তার অপরপার্শে শপার্স প্লাজা মলও আগের চেয়ে অনেক জমজমাট, অনেক নতুন নতুন দোকানও এখন এখানে এসেছে। আগে যেখানে ‘যেলার্স’ ছিল, সেখানে পরে ‘টার্গেট’ এবং সবশেষে কয়েক বছর আগে ‘লোয়ি’ চলে এসেছে। ক্রেতাদের ভাল আনাগোনা রয়েছে দোকানটিতে। তাছাড়া মেট্রো ও ডলারামা সহ বেশকিছু জনপ্রিয় স্টোর তো রয়েছেই।
শুধু তাই নয়, এখানে অফিস নিয়েছেন টরন্টোর এক ঝাঁক উজ্জ্বল উচ্ছল তরুণ সাংস্কৃতিক কর্মী বাহিনী। এটা আমাদের জন্য অবশয়ই আশাজাগানীয়া। সারা সপ্তাহের হাড় ভাঙা পরিশ্রম শেষে সপ্তাহান্তের দিনগুলোতে এলাকাটি আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক ও চিত্তবিনোদনমুলক কর্মকাণ্ডে মুখর হয়ে ওঠে । অফিসে অথবা বেসমেন্টের হলঘরে বসে কবিতা ও আবৃত্তির আসর, গানের ও নাচের আসর; অনুষ্ঠিত হয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও সেমিনার। প্রবাসে বাংলা নাটক, যেমন তেমন কাজ? সমস্ত কুশীলবের ফুল টাইম জব সত্বেও তা সম্ভব করছেন এখানে। বাংলাদেশ ও কানাডার পটভূমিতে লেখা বেশ ভাল ভাল বাংলা নাটকও মঞ্চস্থ হয় এখানে। সেগুলো প্রচুর নাট্যোত্সাহী মানুষ উপভোগ করে। অ-বাংলাভাষী দর্শক শ্রোতারাও উপস্থিত হন। অনেকে সপরিবারে সেগুলো উপভোগ করতে আসেন। এসব অনুষ্ঠানে নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মতো। এভাবে আমরা কানাডায় বেড়ে ওঠা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমাদের নিজ দেশের সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি এবং কৃষ্টির প্রতি তাদের আগ্রহকে আকৃষ্ট করতে ও তা ধরে রাখতে সমর্থ হচ্ছি। এছাড়া বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাখ, কানাডা ডে ইত্যাদি বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজকরা বিভিন্ন উত্সবের আয়োজন করে থাকে। সেগুলোতে বিভিন্ন বয়সী মানুষের ঢল নামে। এমন কথা প্রত্যয় নিয়ে বলা যায় কানাডায়, বিশেষ করে টরন্টোতে বাংলা ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা, খেলাধুলা গত এক দশকের চেয়ে বহুগুণে বেড়েছে। এটা আমাদের বাঙালি কম্যুনিটির জন্য নিতান্তই খুব খুশির খবর।
আতোয়ার রহমান : কবি ও গল্পকার, টরন্টো, কানাডা