Home কলাম ডোন্ট ট্রাই

ডোন্ট ট্রাই

ফরিদ আহমেদ : চার্লস হেনরি বুকোস্কি নামের একজন সাহিত্যিক ছিলেন। জাতিগতভাবে তিনি একজন জার্মান-আমেরিকান। উপন্যাস, ছোটগল্প এবং কবিতা লিখেছেন তিনি। তাঁর জন্ম হয়েছিলো ১৯২০ সালে, মারা যান ১৯৯৪ সালে। লস এঞ্জেলসে সমাধিস্থ আছেন তিনি। সমাধিতে সৌধে সাধারণত ব্যক্তির নাম এবং জন্ম সাল ও মৃত্যু সাল থাকে। মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনও আবেগের বশে অনেক সময় অনেক কিছু লিখেও রাখে সেখানে। হেনরি বুকোস্কির সমাধিতেও সেই রকম একটা কিছু লেখা আছে। তবে, মাত্র দু’টো শব্দ। সেই দু’টো শব্দ হচ্ছে, ‘ডোন্ট ট্রাই’।

বেশ বিচিত্রই বলতে হবে এটাকে। আমরা সাধারণ ‘ট্রাই হার্ড’ বা ‘ট্রাই ইয়োর বেস্ট’ ধরনের কথাবার্তা শুনতে অভ্যস্ত। সেখানে এই কবি চেষ্টা না করার জন্য তাঁর শেষ উপদেশ বাণী দিয়ে যাচ্ছেন কবরে থেকে। আশ্চর্যই বটে। আশ্চর্য হলেও কিছু করার নেই। এটাই হয়তো তাঁর জীবন দর্শন ছিলো, চেষ্টা না করাটা। দেখা যাক, বিষয়টা কতোখানি সত্যি।

১৯৬৩ সালে তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, তিনি কীভাবে লেখেন? কীভাবে কবিতার জন্ম দেন? কতখানি প্রচেষ্টা তাঁর দেওয়া লাগে কবিতা লেখার জন্য? এর জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘ইউ ডোন্ট ট্রাই। দ্যাটস ভেরি ইম্পরট্যান্ট।’ প্রশ্নকর্তা চোখ গোল গোল করে তাকানোর পরে তিনি সেটাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন এইভাবে, ‘আপনি শুধু অপেক্ষা করবেন। দেখবেন কিছু একটা ঘটবে। তারপরেও যদি কিছু না ঘটে, আরও অপেক্ষা করুন। দেয়ালের অনেক উঁচুতে বসে থাকা পোকার মতো। তাকে মারার জন্য চেষ্টা করে লাভ নেই। আপনি সেখানে পৌঁছোতে পারবেন না। কাজেই মারার চেষ্টা না করে আপনি বরং অপেক্ষায় থাকুন। এক সময় না এক সময় সে নেমে আসবে আপনার কাছাকাছি। ঠিক সেই সময়টাতে তাকে আঘাত করে মেরে ফেলুন।’
১৯৯০ সালে তাঁর এক বন্ধু উইলিয়াম প্যাকার্ডকে একটা চিঠি লিখেছিলেন তিনি। সেই চিঠিতে তিনি লেখেন, “আমরা কঠোর পরিশ্রম করি সবকিছুতে। খুব বেশি চেষ্টা চালাই আরাধ্য বিষয়কে অর্জনের জন্য। এতো পরিশ্রম করার কিছু নেই। এতো চেষ্টারও দরকার নেই। আপনার যা পাওনা তা এমনিতে পড়ে আছে কোথাও না কোথাও। শুধু সেটাকে তুলে নেবার অপেক্ষা। কবিতা লেখা বিয়ার খাওয়ার মতোই সহজ একটা কাজ। এর জন্য বিরাট প্রচেষ্টার কোনো প্রয়োজন নেই।”

চার্লস হেনরি বুকোস্কি, হ্যাঙ্ক নামেই যিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি জীবন শুরু করেছিলেন একজন পরাজিত ব্যক্তি হিসাবে। জীবনের একটা বিরাট অংশও তিনি কাটিয়েছেন পরাজিত হিসাবেই। সাফল্য তাঁকে ছোঁয়নি।
হ্যাঙ্ক একজন মদ্যপ লোক ছিলেন, ছিলেন একজন নারীলোভী। সেই সাথে জুয়ার প্রতিও তাঁর সুতীব্র নেশা ছিলো। এইসব লোভ আর নেশা নিয়েই দিন কাটতো তাঁর। বাজে নেশার পরে সামান্য যেটুকু সময় তিনি অবসর হিসাবে পেতেন, সেই সময়টাতে মাঝে মাঝে অখাদ্য সব কবিতা লিখতেন তিনি। চেষ্টা না থাকলেও, মনের মধ্যে তাঁর ইচ্ছা ছিলো লেখক হবার।

সেই ইচ্ছা থেকেই বছরের পর বছর ধরে লিখে গেছেন তিনি। লেখা শেষ হলে সেই সব লেখা পাঠিয়েছেন নানা পত্র-পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে এবং প্রকাশকদের কাছে। সব জায়গা থেকেই প্রত্যাখ্যান পত্র পেয়েছেন তিনি। তাঁর লেখা লেখার যোগ্য না, কিছুই হয়নি, খুবই বাজে বা স্থূল রুচির, এ’রকম অসংখ্য মন্তব্য তাঁকে হজম করতে হয়েছে প্রায় পুরোটা জীবন ধরে।

এমনিতেই একটা হতাশ জীবন কাটাতেন তিনি। তার উপরে এই সব প্রত্যাখ্যান তাঁকে আরও গভীর হতাশার মাঝে ঠেলে দিতে থাকে। তিনি আরও বেশি মদে ডুবে যান। সারাদিন ধরে মদ খেতেন। পোস্ট অফিসে ছোট্ট একটা কাজ করতেন তিনি। সামান্য বেতনের বেশিরভাগ অংশটাই তিনি ব্যয় করে ফেলতেন মদ, মেয়েমানুষ আর রেসট্রাকের জুয়ার পিছনে। রাতে মদ্যপ অবস্থায় টাইপ রাইটারের সামনে বসে কবিতা প্রসবের চেষ্টা চালাতেন। কখনো কখনো কবিতা বের হতো, কখনো বা বেহুশ হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকতেন তিনি। পরাজিতের এক জীবন!

এভাবেই কেটে যায় লেখালেখির তিরিশ বছর। কেউ জানে না যে তিনি লেখেন। কোথাও ছাপা হয়না তাঁর একটাও কবিতা। তাঁর বয়স যখন পঞ্চাশ বছর, এক প্রকাশকের দয়া জন্মায় তাঁর প্রতি। প্রকাশকও বড় কোনো প্রকাশক ছিলেন না। তারপরেও এই প্রকাশক হ্যাঙ্ক এর উপরে জুয়া খেলার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত নেন হ্যাঙ্কের বই তিনি প্রকাশ করবেন। খুব অল্প পয়সাতে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়।

চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের তিন সপ্তাহের মধ্যে ‘পোস্ট অফিস’ নামে একটা উপন্যাস লিখে তিনি জমা দেন প্রকাশককে। এর উৎসর্গের জায়গায় লেখেন, ‘কাউকেই উৎসর্গ করা হলো না।’ তাঁর যে আপনজন বলতে কেউ ছিলো না, সেটা পরিষ্কার এই উৎসর্গপত্র থেকে।

এই এক ঘটনা মোড় ঘুরিয়ে দিলো তাঁর জীবনের। বইটা পাঠকপ্রিয় হয়ে পড়লো। সাহিত্যিক হিসাবে বুড়ো বয়সে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেন তিনি। এই সাফল্যের পথ ধরে ছয়টা উপন্যাস আর শত শত কবিতা লিখে ফেললেন তিনি। তাঁর বই বিক্রি হতে থাকলো লক্ষ লক্ষ কপি। আমেরিকাতে তিনি না যতোটা জনপ্রিয় হলেন, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় তিনি ছিলেন জার্মানিতে।

তাঁর এই জনপ্রিয়তা এবং সাফল্য বিস্ময় হয়ে দেখা দিলো সবার কাছে। অন্যদের কথা বাদ দেই, তিনি নিজেও নিজের সাফল্যে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। একজন ব্যর্থ সাহিত্যিক হিসাবে নিজেকে তিনি মেনে নিয়েছিলেন। সেই জায়গা থেকে এরকম একটা উল্লম্ফন নিজের কাছেই বিস্ময় জাগানিয়া ছিলো তাঁর জন্য।

হয়তো এ কারণেই তাঁর বিশ্বাস জন্মেছিলো চেষ্টার করার কোনো দরকার নেই। খামোখাই সময় নষ্ট এতে। যার যেটা হবে, সেটা এমনিতেই হবে। শুধু নিজের কাজটা করে যেতে হবে, আর অপেক্ষা থাকতে হবে সঠিক সময়ের জন্য।

Exit mobile version