অনলাইন ডেস্ক : জ্বরে আক্রান্ত আদরের ছোট্ট সন্তানের জন্য এক কেজি মাল্টা কিনতে বাজারে এসেছিলেন কদমতলী এলাকার বাসিন্দা অটোরিকশা চালক মো. কাশেম মোল্লা। প্রতি কেজির দাম ৪০০ টাকা শুনে কেনা হয়ে উঠল না আর। ওদিকে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু-আক্রান্ত ভাইয়ের জন্য দুটো ডাব কিনতে এসে বেসরকারি চাকরিজীবী মো. রাইয়ান ইসলামের পকেট থেকে হাওয়া ২৮০ টাকা। কারণ ডাবের বাজারে সরকারের মনিটরিং জোরদারের পরও বাড়তি দামই নিচ্ছেন বিক্রেতারা। এছাড়া কমলা, নাশপাতি, আঙ্গুর, বেদানার মতো অন্যান্য বিদেশি ফলের দামেও আগুন। বিশেষ করে হাসপাতাল এলাকাগুলোতে ডাব ও ফলের দাম অত্যধিক বেশি।
কথা হলে রাইয়ান বলেন, ডেঙ্গু রোগীর জন্য ডাব অনেক উপকারী। তাই সুযোগসন্ধানী বিক্রেতারা অতিরিক্ত দাম রাখছেন। এত দামে কিনে পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
অটোরিকশা চালক কাশেম বলেন, দাম বেশি হওয়ায় এমনিতেই খাওয়া হয় না। অসুখ-বিসুখে মানুষ একটু ফলমূল খায়। এখন আর খাওয়ার উপায় নেই। দেশি ফলের দামও আগের চেয়ে অনেক বেশি।
রাজধানীর ফলের বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক থেকে দুই মাসের ব্যবধানে প্রায় সব ধরনের বিদেশি ফলের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মাল্টার। মাস দেড়েকের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ১৫০ পর্যন্ত বেড়ে বর্তমানে ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেড় মাস আগে যা ২৫০ থেকে ২৬০ টাকায় কেনা গেছে। দশদিন আগে বিক্রি হয়েছে ৩৫০ টাকায়। অর্থাৎ দশ দিনে দাম ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
গত পনের দিনের ব্যবধানে কমলার দাম কেজিপ্রতি ৪০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকায়। লাল আঙ্গুরের দাম বেড়ে প্রতি কেজি ৪৫০ টাকা হয়েছে। গালা ও ফুজি আপেলের দাম কেজিপ্রতি ৩৫০ টাকায় ঠেকেছে। এই তালিকায় বেদানা ৪৫০ টাকা এবং নাশপাতি ৩২০ টাকা হয়েছে। দেশি ফলের মধ্যে কলা ও পেঁপের দাম অনেকটা অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে ডেঙ্গু ও জ্বরের প্রকোপে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাতাবিলেবুর দাম বেড়ে প্রতি পিস ১০০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এছাড়া পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ৮০ টাকায়।
ডেঙ্গুর কারণে দাম বাড়েনি জানিয়ে মালিবাগ বাজারের কুমিল্লা ফল ভাণ্ডারের ব্যবসায়ী মো. আবু তাহের বলেন, দাম বেড়েছে ডলার সংকটে আমদানি কমে যাওয়ার কারণে।
মুগদা হাসপাতাল এলাকায় ফল বিক্রেতা মো. আলাউদ্দিন বলেন, পাইকারিতেই ফলের দাম অনেক বেড়েছে। এর পেছনে আমাদের হাত নেই। আমাদের লাভ খুবই সামান্য।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ফল বিক্রেতা মো. সুমন অবশ্য এক রকম স্বীকার করলেন, ডাব ও ফলের দাম বাড়ার পেছনে ডেঙ্গু ও জ্বরের প্রকোপ বাড়ার প্রভাব রয়েছে। তিনি বলেন, এমনিতেও ফলের দাম বাড়তি। এর মধ্যে ডেঙ্গুর কারণে চাহিদা বাড়ায় অনেক বিক্রেতা দাম অতিমাত্রায় বাড়িয়েছে। হাসপাতাল এলাকায় দাম বেশি। তবে দরদাম করলে কমে পাওয়া যায়।
এদিকে হাসপাতাল এলাকাগুলোতে এখনও এক পিস ডাবের দাম রাখা হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা পর্যন্ত। সারা দেশে ডাবের বাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মনিটরিং জোরদারের পরেও বাজারের চিত্র বদলায়নি; দাম ১০০ টাকায় নামেনি।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার খরচ সামাল দিতেই কষ্ট করতে হচ্ছে অনেককে। এর মধ্যে ব্যবসায়ীরা অনৈতিকভাবে ডাবের পানি ও ফলের মতো পথ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় রোগীদের কষ্ট আরও বেড়ে যাচ্ছে। নিত্যপণ্যের মতো মানুষের অসুস্থতা নিয়েও বাণিজ্য করা চরম অমানবিক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারওয়ান বাজারের ফলের একজন পাইকারি ব্যবসায়ী জানান, বাজারে একদিকে অভিযান হয়, আরেক দিকে ‘যেই লাউ সেই কদু’ অবস্থা। অভিযান হলে ডাবের দাম কমে। আবার পরে তা বেড়ে যায়। অথচ মাদারীপুরে বাগানে প্রতিটি ডাব ৩০-৪০ টাকা; আকারে বড় হলে সর্বোচ্চ ৫০-৬০ টাকায় কেনাবেচা হয়। ডেঙ্গু ও জ্বরের কারণে মাল্টা, কমলা, বাতাবিলেবুর মতো ফলগুলো অনেকে কেনা দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু কিংবা জ্বর হলেই ডাব, কমলা, মাল্টা খাওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সাধারণ মানুষ না বুঝেই এসব কিনতে বাজারে ছোটেন। আর ‘মওকা বুঝে চৌকা’ মারেন ফল বিক্রেতারা। রাতারাতি অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নেন তারা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে রোগীকে হাইড্রেট থাকার জন্য বেশি বেশি তরল খেতে বলা হয়। যেমনÑ স্যালাইন, ডাবের পানি, ফলের রস ইত্যাদি। এর মানে এই নয় যে, ডাবের পানিই খেতে হবে। বরং ডাবের পানির চেয়ে স্যালাইনের উপকারিতা অনেক বেশি। আর এটা অনেক সস্তাও। রোগীর মুখে স্বাদ না থাকায় ফলের রস খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তার মানে এই নয় যে, শুধু মাল্টা, কমলার রসই খেতে হবে। এর পরিবর্তে লেবুর সরবত খাওয়া যেতে পারে। এতে চিনি থাকায় ক্যালরিও বেশি মেলে। অল্প খরচেই তৈরি করা যায়।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ডেঙ্গু হলেই ডাব খেতে হবে, মাল্টার রস খেতে হবে। কিন্তু এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এর জন্য স্যালাইন ও লেবুর সরবতের মতো অনেক সহজ ও সস্তা বিকল্প উপায় রয়েছে।