Home কলাম ডিবি হারুন, গয়েশ্বর রায় এবং একটি রাজকীয় ভোজের দায়

ডিবি হারুন, গয়েশ্বর রায় এবং একটি রাজকীয় ভোজের দায়

ফরিদ আহমেদ : বাঙালির চরিত্র দ্বৈততায় ভরপুর। সহজ করে বললে, বলতে হয় প্রায় প্রতিটা বাঙালির মধ্যেই বিপরীতমুখী চরিত্র বিদ্যমান রয়েছে। দেখবেন, দিনের বেলা যে লোক বউকে হয়তো গরুর মতো পেটায়, সেই একই লোক রাতের আঁধারে বউকে বিছানায় কাছে টেনে নেয়। আদর সোহাগে ভরিয়ে দেয়। যে লোক ধর্মের কথা বলছে, সেই একই লোক অধর্মের কাজ করছে, যিনি শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাঁর নিজের বাড়িতেই অল্পবয়সী কাজের লোক রয়েছে। আমাদের এই বিপরীতমুখী চরিত্রের সবচেয়ে বড় উদাহরণ অবশ্য এরা কেউ না। সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে আমাদের রাজনীতিবিদরা। এদের মতো বিপরীত কথা, বিপরীত কাজ এবং বিপরীত আচরণের মানুষ খুঁজে পাবেন না।

ঢাকায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে অগণতান্ত্রিক উপায়ে জোর করে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের পতনের জন্য মহা-সমাবেশ করেছে বিএনপি। বিএনপির সেই মহা-সমাবেশকে অকার্যকর করতে পালটা সমাবেশ ডেকেছে আওয়ামী লীগ। ফলে, ঢাকায় দুই পক্ষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছে। দুই দল যদিও দাবি করেছে যে তাদের সমাবেশ হচ্ছে শান্তি সমাবেশ। কিন্তু, শান্তির বদলে সহিংসতাই বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে। নানা জায়গায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এই সংঘর্ষে অবশ্য আওয়ামী লীগের তেমন কোনো সমস্যা হয়নি বড় কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতিও হয়নি। হবার কথাও নয়। আওয়ামী লীগ একা মাঠে নেই। তাদের সাথে শক্তিশালী পুলিশ লীগও রয়েছে। বিএনপির দুর্ভাগ্য বলা যেতে পারে। পুলিশ দিয়ে গঠিত কোনো বাহিনী তাদের সাথে এখন আর নেই। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পুলিশ দল নামে তাদেরও একটা দল ছিলো এক সময়ে। সেই জাতীয়তাবাদী পুলিশ দলটা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে ২০০৬ সালে। তখন থেকেই বিএনপি এক শক্তিহীন দল। পড়ে পড়ে মার খাওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। একদিন যারা অন্যদের মার দিতো পুলিশ দলের ভরসায়, এখন তারা মার খায় পুলিশ লীগের হাতে। জাতীয়তাবাদী পুলিশ দলটা থাকলে আজকে এভাবে পড়ে পড়ে মার খেতে হতো না।

এই পড়ে পড়ে মার খাবার ঘটনা সা¤প্রতিক আন্দোলনেও ঘটেছে। আওয়ামী লীগ আর পুলিশ লীগের হাতে মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়েছে বিএনপির অসংখ্য কর্মী। বিএনপির নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং আমানুল্লাহ আমান মার খেয়ে আহত হয়েছেন। আহত হবার পরেও রেহাই পাননি তারা। ওই অবস্থাতেই দুইজনকেই ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। তাঁদের জেলে পুরে দেওয়া হবে কোনো মামলা দিয়ে কিংবা রিমান্ডের নাম করে পুলিশের গোয়েন্দা অফিসে নিয়ে গিয়ে তাঁদের উপরে পুলিশি নির্যাতন চালানো হবে, সেটাই ছিলো সবার ধারণা। কিন্তু, সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এই দুইজনই রাজকীয় ধরনের আপ্যায়ন পেয়েছেন।

আমানুল্লাহ আমানকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সুচিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁকে খাবার পাঠিয়েছেন। তাঁর খোঁজ খবর নেবার জন্য লোক পাঠিয়েছেন। এই ধরনের উন্নত সংস্কৃতি আমাদের রাজনীতিতে আগে কখনো ছিলো না। যে প্রধানমন্ত্রীকে অবৈধ ঘোষণা দিয়ে তারা রাজপথে নেমেছেন আন্দোলন করতে, সেই প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া খাবার ফিরিয়ে দিয়েছেন, এমন কোনো সংবাদ আমার চোখে পড়ে নাই। উন্নত আচরণ শুধু এক পক্ষ থেকেই দেখানো হয়নি, এক্ষেত্রে মনে হচ্ছে বিপরীত পক্ষও কম যান না।

পুলিশের হাতে মার খাবার পরে গয়েশ্বর রায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীন দেশে মার খাবার জন্য আমাদের জন্ম হয়নি।” সত্যি কথা। একটা স্বাধীন দেশের জন্ম আমাদের আগের প্রজন্ম দিয়েছিলেন নিপীড়ন-নির্যাতন বিহীন একটা দেশ পাবার আশায়। আশা ছিলো সেই দেশে গণতন্ত্র থাকবে, বাক-স্বাধীনতা থাকবে, মানুষে মানুষে সাম্য বজায় থাকবে। সেই আশাটা অবশ্য পুরোপুরি মেটেনি আমাদের। গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরতন্ত্রই পেয়েছি আমরা শুধু।

গয়েশ্বর রায় যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, সেই ক্ষোভের কথা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত না গেলেও, ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের প্রধান হারুন সাহেবের কান পর্যন্ত গিয়েছিলো। তিনি গয়েশ্বর রায়কে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে এসেছিলেন। সবার ধারণা ছিলো গয়েশ্বর রায়কে বন্দি করা হবে। কিন্তু, সেটা বদলে ঘটনা ঘটে একেবারে ভিন্নতর। ডিবি প্রধান হারুন তাঁর অফিসে বসিয়ে গয়েশ্বর রায়কে রাজকীয়ভাবে মধ্যাহ্ন ভোজন করিয়েছেন। গয়েশ্বর রায়ের জন্য পাঁচ তারা হোটেল সোনারগাঁও থেকে খাবার এনেছেন তিনি। এই খাবারের দাম বিপুল হবার কথা। এতো টাকার বিল তাঁর অফিস দিয়েছে, নাকি হারুন সাহেব নিজেই নিজের পকেট থেকে দিয়েছেন, তা অবশ্য জানা যায়নি। এটা জানা না গেলেও, এই ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশ এখন ধনীদের দেশ। সরকারী একজন কর্মকর্তা কিংবা সরকারের একটা অফিসের পক্ষেও বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাকে এনে পাঁচ হোটেলের খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা যায়।

পাঁচ তারা হোটেলের খাবার দেখেই হয়তো নিজের রসনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন নাই গয়েশ্বর রায়। তিনি বেশ রসিয়ে রসিয়ে সেই দামি খাবার খেয়েছেন। এই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। পুরো দেশবাসীই তাঁর খাবার খাওয়ার দৃশ্য দেখেছে। সুস্বাদু খাবার খেতে খেতে নিজের এবং কর্মীদের মার খাবার কথা ভুলে গিয়েছেন তিনি।

আমাদের রাজনীতিবিদদের এই দ্বৈত চরিত্র আজকের নয়, এর অনেক পুরনো ঐতিহ্য রয়েছে। ১৯৭২ সালেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছিলো। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি খুব খারাপ, এই বিবেচনা করে পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভা করেছিলেন মওলানা ভাসানী। জনসভা শেষ করে একটা ভুখা মিছিল নিয়ে তিনি গণভবনের দিকে অগ্রসর হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে ছিলেন। গণভবনের গেইট থেকে তাঁকে সম্মানের সাথে ভিতরে নিয়ে যান তোফায়েল আহমেদ এবং আব্দুর রাজ্জাক। ভিতরে নিয়ে যাবার পরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদরা তাঁর আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মওলানার জন্য স্যান্ডউইচ এবং পাকা পেঁপে আনা হয়। ভুখা মিছিলের কথা ভুলে গিয়ে মওলানা পেট পুজোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ইত্তেফাকের রিপোর্টে লেখা হয়েছিলো, ‘মওলানা ভাসানী স্যান্ডুইচ খাইতে খাইতে বলেন, সকলকেই সুখ-দুঃখ সমানভাবে ভাগ করিয়া লইতে হইবে।”

আমাদের রাজনীতিবিদরা সবকিছুই সমানভাবে ভাগ করে নেন, তবে কিছু ভাগ থাকে একটু বেশিই সমান। আর সেই ভাগটা থাকে তাঁদের নিজেদের জন্য।

Exit mobile version