শওগাত আলী সাগর : ১. ফেসবুকে নানা রকমের চ্যালেঞ্জের খেলা হয়। শাড়ির চ্যালেঞ্জ, রঙের চ্যালেঞ্জ, বইয়ের চ্যালেঞ্জ- কতো কি! জাস্টিন ট্রুডো নতুন এক চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাঁর এই চ্যালেঞ্জের নাম- ’৫০-৩০ চ্যালেঞ্জ’। আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে তাঁর এই চ্যালেঞ্জ।

জাস্টিন ট্রুডোর এই চ্যালেঞ্জটা কি? নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে রোববার দুপুরে তিনি লিখেছেন, যখন কোনো নারী কিংবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কেউ এসে টেবিলের অপরপ্রান্তে বসার একটা জায়গা পায়, তাতে আমাদের অর্থনীতি উপকৃত হয়। আর সেই কারণেই সারাদেশে কাজের জায়গাগুলোকে আরো বেশি বৈচিত্রময়, গতিশীল এবং সবাইকে ধারণক্ষম করা দরকার। এই ভাবনা থেকেই তার সরকার ‘৫০-৩০ চ্যালেঞ্জ’ ঘোষণা করেছে।

চ্যালেঞ্জটা তিনি দিয়েছেন দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সংগঠনকে। তাদের তিনি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের পরিচালনা পরিষদ এবং সিনিয়র ম্যানেজমেন্টে ৫০ শতাংশ নারী এবং ৩০ শতাংশ পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী থেকে পূরণ করার জন্য। জাস্টিন ট্রুডো কিন্তু নারদের নিয়োগের কথা বলছেন না। তিনি বলছেন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত থাকেন- এমন সিনিয়র লেভেলে নিয়োগ দেয়ার কথা। এর জন্য প্রধানমন্ত্রী বা তার সরকার কোনো বিশেষ প্রণোদনার ঘোষণা দেননি। কোনো সুবিধা দেয়া হবে বলে ঈঙ্গিতও দিচ্ছেন না। তিনি শুধু চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সেই চ্যালেঞ্জ কতোটা গ্রহণ করতে পারবে, আদৌ পারবে কী না- সে সব নিয়ে কোনো কথাবার্তা তিনি বলছেন না। তিনি শুধু বলছেন, চ্যালেঞ্জটা আমি দিলাম, তোমরা গ্রহণ করো দেখি!
প্রধানমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ নিয়ে প্রচার প্রচারণারও কোনো ব্যাপার নেই। কানাডা সরকারের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে একটা লিংক তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ নিতে আগ্রহীরা সেখানে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তথ্য দেবে। সেটি যে জনগণ প্রকাশ্যে দেখতে পাবে তাও না। তবে কারা কারা এই চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে তাদের বিস্তারিত তথ্য থাকবে সরকারের কাছে, তারা প্রয়োজনীয় ফলোআপ করবে। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিন পর্যন্ত জাস্টিন ট্রুডোর লক্ষ্য হচ্ছে এক হাজার সংগঠন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তার চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করুক।

২. আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আগে জাস্টিন ট্রুডোর এই চ্যালেঞ্জের কি বিশেষ কোনো মাহাত্ম আছে? অবশ্যই আছে। তাঁর চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর। দেশভেদে, অবস্থান বেদে নারীর পরিস্থিতি এবং অগ্রাধিকার ভিন্ন হয়। জাস্টিন ট্রুডোর সরকারের কাছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং নেতৃত্বে নারীর অংশ বাড়ানোটাই অগ্রাধিকার পাচ্ছে। কানাডায় নারী বিষয়ক আলোচনায় ‘জেন্ডার ইকুইটি’ এবং ‘জেন্ডার জাস্টিস’- এই দুটি বিষয় নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। সরকারের কাছে নারীকে ক্ষমতাকেন্দ্রের সমান ভাগিদার করাটা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।

৩. কানাডার প্রভাবশালী পত্রিকা ‘গ্লোব অ্যান্ড মেইলের’ সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তারা দেখিয়েছে- কানাডার কর্পোরেট হাউজগুলোর বোর্ডরুমে কেবল পুরুষের আধিপত্যই নয়, সাদাদেরও একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। বোর্ডের সভাগুলোর বিভিন্ন ছবি একসাথে করলে সেখানে নারীর উপস্থিতি চোখেই পরে না। ‘গ্লোব অ্যান্ড মেইল’ প্রশ্ন তুলেছিলো- কানাডার কর্পোরেট দুনিয়া কি তা হলে এখনো ‘বয়েজ ক্লাব’! জাস্টিন ট্রুডো কি কানাডার কর্পোরেট দুনিয়ার ‘বয়েজ ক্লাব’ ইমেজ ভেঙ্গে সেটিকে ‘হিউম্যান ক্লাব’ করার চেষ্টা করছেন! কর্পোরেট দুনিয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া নারী পুরুষের অংশগ্রহণে সমতা আনতে চাচ্ছেন!

লক্ষণীয় বিষয়, সরকার কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চায়নি, সব প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজমেন্ট লেভেলে সমান সংখ্যক নারী পুরুষ থাকতে হবে- এমন কোনো আইন বা বিধান করার কথাও বলছেন না। সেগুলো সময় এবং আলোচনাসাপেক্ষ ব্যাপার। জাস্টিন ট্রুডো এক ধরনের সামাজিক আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছেন, সেই আন্দোলনে নিজেই নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছেন।

৪.কর্পোরেট দুনিয়ার ম্যানেজমেন্ট লেবেলে নারী-পুরুষের সংখ্যা সমান হলেই কি নারীর পরিপূর্ণ ক্ষমতায়ন হয়ে যায়? নাকি আরো কিছু দরকার হয়! রাজনীতি যদি নারীর অনুক‚লে না থাকে, তা হলে? গণতান্ত্রিক দেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে রাজনীতি। রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশিদারিত্বও জরুরি। জাস্টিন ট্রুডো যখন ’৫০-৩০ চ্যালেঞ্জ’ নিয়ে এসেছেন, তখন তার রাজনীতিতে নারীর অবস্থানটার দিকেও আমরা দৃষ্টি দিতে পারি।

জাস্টিন ট্রুডোর ৩৭ সদস্যের মন্ত্রীসভায় ১৮ জন পুরুষ, ১৮ জন নারী। প্রধানমন্ত্রীর পদটা বাদ দিয়ে বাকি পদগুলো নারী পুরুষের মধ্যে সমানভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য নিজেকে ‘ফেমিনিষ্ট’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। আর প্রধানমন্ত্রীর পরের উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড, একজন নারী।

কানাডার রাজনীতিবিদরা এখন মনে করছেন, ফেডারেল কিংবা প্রভিন্সে- সর্বত্রই সংসদে নারী-পুরুষের প্রতিনিধিত্বটাও সমান হওয়া দরকার। ফলে দুই পর্যায়েই বেশি সংখ্যক নারী প্রার্থী খোঁজার কাজ শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। বর্তমানে অবশ্য কানাডার হাউজ অব কমন্সের ৩৩৮ জন সদস্যের মধ্যে সরাসরি নির্বাচিত ১০০ জন নারী সদস্য আছেন।

৫. আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্কালে জাস্টিন ট্রুডোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম। নারী দিবসটাকে কানাডা কিভাবে দেখছে- সেই আলোচনাটাও একটু করা দরকার বলে মনে করছি।

এটা সত্য, এ বছর সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে। ফলে এবার দিবসটির তাৎপর্য কিংবা আবেদন অন্য সময়ের চেয়ে আলাদা। আর মেয়েদের অবস্থা এবং অবস্থান বিবেচনায় নিলে তো দেশে দেশে নারীর অবস্থান ভিন্নরকমই হয়।

কানাডার এ বছরের নারী দিবসের মূল থিম হচ্ছে ‘ফেমিনিষ্ট রিকভারি’। কোভিড উত্তর পরিস্থিতিতে কানাডা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। অর্থনীতি চাঙ্গা করার সেই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হচ্ছে নারীর। মূলত নারীকে ঘিরেই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করছে কানাডা। সেই পরিকল্পনা থেকেই কানাডা ‘ফেমিনিষ্ট রিকভারি’কে এ বছরের মূল প্রতিপাদ্য বা থিম হিসেবে বেছে নিয়েছে।

‘হ্যাশট্যাগ ফ্যামিনিষ্ট রিকভারি’ নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ক্যাম্পেইনও শুরু করেছে কানাডা। সেই ক্যাম্পেইনে নাগরিকদের অঙ্গীকার করার আহ্বান জানানো হচ্ছে যে তারা কানাডার রাজনীতি, সমাজ এবং অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে ‘জেন্ড্রা ইকুয়ালিটি’ প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দেবে এবং ভূমিকা রাখবে।

রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীকে যদি সমান অংশিদার হিসেবে ভাবতে এবং স্বীকৃতি দিতে শুরু করে তা হলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। দেশে দেশে রাজনীতিকদের মধ্যে এই ভাবনাটা জাগিয়ে দেয়াই এখন জরুরি।