শুভ্র দেব ও পিয়াস সরকার : দেশে করোনা থাবার ১০১ দিন পূর্ণ হয়েছে। এই সময়ে ১ হাজার ২৬২ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আর আক্রান্ত হয়েছেন ৯৪ হাজার ৪৮১ জন। কিন্তু দীর্ঘ এ সময়ে এখনো দেশে করোনা পরীক্ষার জটিলতা, অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা কাটেনি। আর করোনা চিকিৎসার অভাব রয়েছে দেশের সর্বত্রই। দেশের বিভিন্ন স্থানের মানুষ সহসাই করোনা পরীক্ষা করাতে পারছেন না। নমুনা দেয়া থেকে শুরু করে পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া পর্যন্ত দীর্ঘসূত্রিতা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যারা নমুনা দিতে পারছেন ফলাফলের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে সপ্তাহের বেশি সময়।
চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় রয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। রোগীদের ভোগান্তি আর হয়রানি চরমে। সরকারি নির্দেশনার পরেও দেশের বেশিরভাগ হাসপাতাল করোনা পরীক্ষার ফলাফল না দেখে রোগী ভর্তি নিচ্ছে না। শুধুমাত্র সরকারের করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো করোনা পরীক্ষার ফলাফল ছাড়া রোগী ভর্তি নিচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালে শত চেষ্টা করেও ঠাঁই হয়না। রোগী ও স্বজনরা হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও চিকিৎসা পাচ্ছেন না। ফলাফলের অপেক্ষা করতে করতে অনেক রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, সরকারিভাবে সারাদেশের ৬১টি ল্যাবের করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা শহরে রয়েছে ২৭টি ল্যাব। ঢাকা শহরের যেসকল স্থানে করোনা পরীক্ষার নমুনা নেয়া হয় এসব স্থানে প্রতিদিন লম্বা লাইন দেখা যায়। কিছু কিছু স্থানে কয়েকদিন আগে থেকে যোগাযোগ করেও পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে করোনা আক্রান্ত, উপসর্গ আছে এমন এবং আনুষাঙ্গিক সকল রোগীদের বিড়ম্বনার শেষ নাই। বেসরকারি হাসপাতালে ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়া টেস্ট করানোর সুযোগ থাকলেও খরচ বেশি হওয়াতে অনেকেই যেতে নারাজ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষনা ইন্সটিটিউটের হিসাবে, গতকাল পর্যন্ত সারা দেশের ৬১টি ল্যাবের ৮৫টি পিসিআর মেশিনে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৭১৭ জন ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এরমধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১৭ হাজার ২১৮ জনের। এরমধ্যে সংক্রমনের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৮৬২টি।
সূত্র বলছে, টেস্ট বিড়ম্বনা কাটিয়ে উঠতে পারছে না সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। ল্যাব সংকট থেকে শুরু করে দক্ষ জনবল, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও পারস্পরিক সমন্বয়হীতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যার কারণে যতটুকু সক্ষমতা আছে প্রতিষ্ঠানটি তার চেয়ে অনেক কম পরীক্ষা করাচ্ছে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে উঠে এসেছে আইইডিসিআর এপ্রিল ও মে মাসে দিনে ৪২ হাজার টেস্ট করানোর সক্ষমতা থাকলেও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও অন্যান্য জনবল সংকট, মেশিন নষ্ট ও সমন্বয়ের ঘাটতির অভাবে এ সময়ে মাত্র ১৫ হাজার টেস্ট করেছে। সারা দেশের মাঠ পর্যায়ে নমুনা সংগ্রহ এবং পিসিআর মেশিন চালানোর জনবলেরও সংকট রয়েছে। অদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে নমুনা সংগ্রহ করালে অনেক নমুনা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে অনেক সময় ভুল রিপোর্ট আসে। অথচ বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের জনবল ও মেশিনের সক্ষমতা থাকলেও তাদেরকে সেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না।
ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবির) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম করোনা আক্রান্তের পরীক্ষা হচ্ছে। দেশে পরীক্ষার হার মাত্র ০.২৯ শতাংশ। যা সারা বিশ্বে ১৪৯ তম। দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৬১টি ল্যাবে প্রায় ৮৫টির মতো পিসিআর মেশিন দিয়ে প্রায় ২৪ হাজার নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে। সর্বশেষ ১৪ দিনে গড়ে ১৩.৬ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জনবল সংকটের কারণে অনেক ক্ষেত্রে নমুনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং ভুল প্রতিবেদন আসছে। টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে মাত্র একটি পরীক্ষাগারের মাধ্যমে পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছিল। এই সময়ে নির্ধারিত হটলাইনে প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষ পরীক্ষার জন্য যোগাযোগ করে। তার মধ্যে পরীক্ষা করা হয় মাত্র ৭৯৪টি। ঢাকার বাইরে পরীক্ষার সুবিধা সম্প্রসারণ করা হয় ২৫শে মার্চের পর। ততদিনে সীমিত আকারে কমিউনিটি পর্যায়ে সংক্রমণ বিস্তার শুরু হয়ে যায়। দেশে করোনার প্রভাব শুরু হওয়ার পর আইইডিসিআর’র হটলাইনে ১৪ই জুন পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ১০ লাখ ফোন কল আসলেও পরীক্ষা হয় মাত্র পাঁচ লাখ। নানা ভোগান্তির ফলে ৫৭ শতাংশ হাসপাতাল প্রয়োজনের চেয়ে অর্ধেক সংখ্যক পরীক্ষা করাতে বাধ্য হচ্ছে। এছাড়া করোনা পরীক্ষার ফল পেতে ৮ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত বিলম্ব হচ্ছে।
এদিকে ঢাকার বাইরেও করোনা পরীক্ষা ও করোনা চিকিৎসা নিয়ে ভোগান্তির শেষ নাই। চট্টগ্রাম থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার ইব্রাহীম খলিল জানান, চট্টগ্রামে প্রায় ৭০ লাখ লোকের বাস। করোনার এই ১০১ দিনে টেস্ট হয়েছে মাত্র প্রায় ২০ হাজার। তারমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৪০০জন। কারো করোনার উপসর্গ দেখা দিলে নমুনা পরীক্ষার জন্য যোগাযোগ করলে ২ থেকে ৪ দিন পর ডাকা হয়। অনেক সময় নির্ধারিত সময়েও পরীক্ষা করাতে পারেননা। আর পরীক্ষা করালেও রিপোর্ট মিলতে মিলতে সময় লেগে যায় ৭ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত। চট্টগ্রামের অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এছাড়াও যারা উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশরই টেস্ট করানো হচ্ছে না ফলে তাদের স্বজনরা ঝুঁকির মুখে পড়ে যাচ্ছেন। এছাড়া চট্টগ্রামের টেস্ট করানোর অধিকাংশ স্থানগুলোই শহর থেকে অনেকদুরে। ফলে যাতায়াতের একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
রংপুর থেকে স্টাফ রিপোর্টার জাবেদ ইকবাল বলেন, করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহের জন্য যোগাযোগের সাধারণত ৫ থেকে ৬ দিন পর নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর পরীক্ষার ফল জানতে পারছেন ৩ থেকে ৪ দিন পর। যারা পরীক্ষা করাতে চাচ্ছেন তারা সকলেই পরীক্ষা করাতে পারছেন না। অনেকেরই পরীক্ষার জন্য ধরনা দিতে হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। খুলনা স্টাফ রিপোর্টার রাশেদুল ইসলাম বলেন, উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও খুলনায় করোনা পরীক্ষার জন্য সুযোগ মিলছেনা। এখানে দীর্ঘ দিন ধরে শুধুমাত্র খুলনা মেডিকেল কলেজে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। যোগাযোগের ১ থেকে ২দিন পর নমুনা পরীক্ষার জন্য দিতে পারলেও ফলাফল পেতে সময় লাগছে ৫ থেকে ১০দিন পর্যন্ত। বড় সমস্যা করোনা টেস্ট না করে জ্বর, সর্দি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদির রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে না। তাদের করোনা পরীক্ষার ফলাফল দেখে ভর্তি নেয়া হয়। ফলে পরীক্ষার এই সময়টাতে রোগীদের অবস্থার অবনতি হচ্ছে এবং এভাবে অনেকেই মৃত্যুবরণও করেছেন।
সিলেটে থেকে স্টাফ রিপোর্টার ওয়েছ খছরু বলেন, সিলেটে প্রধান সমস্যা পরীক্ষা না হওয়া। সিলেট থেকে নমুনা পাঠাতে হচ্ছে ঢাকায়। এখানে নমুনা দিতে লেগে যায় গড়ে ৫দিন। আর পরীক্ষার ফল পেতে সময় লাগে গড়ে ১০দিন। সিলেট জেলায় নমুনা সংগ্রহ করা হয় প্রতিদিন ৪শ’ টি। আর বিভাগে ৬শ’টি। আর ফলাফল জানা যায় মাত্র ৩৬০টির। ফলে করোনা আক্রান্ত রোগীরা বা যাদের উপসর্গ আছে তারা ভয়াবহ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তবে বরিশালের অবস্থা অন্যান্য এলাকার থেকে ভালো বলে জানান স্টাফ রিপোর্টার জিয়া শাহীন। তিনি বলেন, এখানে টেস্টের জন্য যে কেউ নমুনা দিতে পারেন। এক দিনের মধ্যেই নমুনা নেয়া হয়। আর ফলাফল পেতে সময় লাগে ৩ থেকে ৪দিন। তবে এখানের প্রধান সমস্যা চিকিৎসা নিয়ে। হাসপাতালে চিকিৎসার মান খুবই খারাপ। রাজশাহী থেকে স্টাফ রিপোর্টার আসলাম উদ দৌলা বলেন, এখানে নমুনা সংগ্রহের জন্য সময় লাগছে ২ থেকে ৩ দিন। ২/৩ দিন পর ফল পাওয়া যায়। একজন সাধারণ মানুষ খুব সহযেই নমুনা দিতে পারছেন না। ফলে যাদের উপসর্গ আছে তাদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিচ্ছে। ময়মনসিংহ থেকে স্টাফ রিপোর্টার মতিউল আলম বলেন, এখানে একদিনের মধ্যে নমুনা দেয়া সম্ভব হয় এবং সাধারণত পরের দিনই ফলাফল পেয়ে যাচ্ছেন রোগীরা। সমস্যা হচ্ছে এখানে মাঝে মধ্যে জনবল সংকটের কারণে নমুনা সংগ্রহ এবং ফল পেতে রোগীদের অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়।
হয়রানি চরমে: এদিকে করোনা পরীক্ষা নিয়ে রোগীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন এমন অভিযোগও প্রথম থেকে ছিল। ভুক্তভোগীরা আইইডিসিআরের হটলাইন নম্বরে একাধিকবার ফোন করে রেসপন্স পান না। রোগীর ইতিহাস শুনে অনেক সময় পরীক্ষা করতে নিরাশ করে বাসায় থাকতে বলা হয়। নির্ধারিত বুথে গিয়ে রোগীদের নমুনা দিতে বেগ পেতে হয়। কিছু কিছু রোগীরা ভুল তথ্য পেয়ে অনেক স্থানে ঘুরে নমুনা দিতে পারে না। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় ভুল ফলাফল চলে আসে। আর করোনার উপসর্গ থাকলে বেসরকারি অনেক হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা মিলেনা। করোনার উপসর্গ নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে শুধুমাত্র চলতি মাসের প্রথম ১০দিনের অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
বেশ কিছু দিন ধরে মুত্রথলীর সংক্রমণে ভুগছিলেন যশোরের মতিউর রহমান। একই সমস্যায় তিনি আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে পারেননি। ফের তিনি অসুস্থ হয়ে ঢামেকেই ভর্তি হন। পরে হাসপাতাল থেকে তাকে করোনা পরীক্ষার পরামর্শ দেয়া হয়। সেই টেস্ট করানোর জন্য গত চার দিন ধরে মতিউর রহমান ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু তার ভাগ্য টেস্ট জুটেনি।
সোমবার নারায়নগঞ্জের মদনপুরের গৃহবধু রুমানাকে নিয়ে তার পরিবার ভোগান্তিতে পড়ে। জন্মগত শ্বাসকষ্টের রোগী রুমানা কিছুদিন ধরেই একটু বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সোমবার সকাল থেকে শ্বাসকষ্টের সমস্যা বেড়ে যাওয়াতে তাকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয় তার পরিবার। তারপর নারায়নগঞ্জ থেকে ঢাকার একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে কোথাও জায়গা হয়নি রুমানার। সবকটি হাসপাতালেই করোনা পরীক্ষার ফলাফল দেখতে চায়। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একসময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রুমানাকে ভর্তি করায় স্বজনরা। গত শনিবার ঢাকা মেডিকেলের সামনে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি মৃত মোহাম্মদ আব্দুল হাই’য়ের ছেলে হাসিবুল মুগ্ধ আক্ষেপ করে বলেন, চারটা দিন ঢাকা মেডিকেলসহ সরকারি বেসরকারি সবকটি হাসপাতালেই খোঁজ করেছি। সবাই আগে করোনা পরীক্ষার রেজাল্ট দেখতে চায়। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির দুদিন পর বাবার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তারপর ৭২ ঘণ্টা পরে ফলাফল দেয়া হবে বলে জানানো হয়। মৃত্যুর দ্বার প্রান্তের রোগীর করোনা ফলাফল পেতে আমাদেরকে ৭২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। এসময়টা আমরা রোগী নিয়ে কোথাও মুভ করতে পারছিলাম না। যখন ফলাফল হাতে পেলাম তখন সেটি নেগেটিভ ছিল। আর ততক্ষণে বাবাও না ফেরার দেশে। অথচ দুদিন আগে যদি এই ফলাফল পেতাম তবে বাবাকে অন্য হাসপাতালে ভর্তি করে আইসিইউ সাপোর্ট দিতে পারতাম।