ড : বাহারুল হক : টিম হরটন্স কানাডার সর্ব বৃহৎ একটি বহুজাতিক রেস্টুরেন্ট চেইন যা তার কফি এবং ডোনাটের জন্য বিখ্যাত। এই বিখ্যাত চেইন রেস্টুরেন্টের প্রতিষ্ঠাতা হলেন কানাডিয়ান হকি খেলোয়াড় টিম হরটন। তিনি ১৯৬৪ সনে অন্টারিওর হ্যামিলটনে টিম হরটন্সের গোড়া পত্তন করেন। এখন ওকভিলে রয়েছে এর সদর দপ্তর। বর্তমানে বিশ্বের নয়টি দেশে চলছে টিম হরটন্সের ৪৬১৫টি রেস্টুরেন্ট; তম্মধ্যে ৩৪৬৮টির অবস্থান কানাডায়। টরন্টো নগরীও টিম হরটন্সে ভরা।

সেই প্রথম থেকেই টিম হরটন্সের কফি আমার খুব প্রিয় একটি পানিয়। শুরুতে আমার কফি ছিল স্মল সাইজের ‘ডাবল-ডাবল’ প্রকৃতির (সেই কফি যে কফিতে রেগুলারের তুলনায় ডাবল পরিমাণ ক্রিম ও চিনি দেওয়া হয়। রেগুলারে থাকে এক ক্রিম ও এক চিনি আর ডাবল-ডাবল- এ থাকে দুই ক্রিম ও দুই চিনি।) বছর দুয়েক হলো ডাক্তারের পরামর্শে চলে এসেছি সোজা ব্লেক কফিতে; ব্লেক কফিতে ক্রিম, চিনি এই সব মেশানো হয় না। বেøক কফিতেও আমার অতৃপ্তি নেই। বেশ মজা করেই আমি ব্লেক কফি খেয়ে যাচ্ছি। প্রায় আমি আমার এই প্রিয় কফি খাওয়ার জন্য কোন না কোন টিম হরটন্সে ঢুকে পড়ি। প্রায়ই আমার ঠাঁই হয় কাস্টমারদের লম্বা লাইনে। কিন্তু তাতেও আমি বিরক্ত বোধ করি না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বরং রেস্টুরেন্টটি দেখি, দেখি ক্রুদের কর্মতৎপরতা। কফি হাতে এলে তা নিয়ে বসে পড়ি যুৎসই একটা জায়গায় যেখান থেকে ক্রুদের স্পস্ট দেখা যায়। তারপর শুরু করি ধীরে ধীরে কফি খাওয়া। কফি খাওয়ার সাথে সাথে চলে রেস্টুরেন্টটিকে আমার নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ। প্রথমেই দেখি রেস্টুরেন্টটি কিরকম পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। দেখি ফ্লোর, চেয়ার-টেবল, ডাইনিং রুমের দেয়াল, উইন্ডো-ডোরের গ্লাস, ইত্যাদি। ক্রুরা যেখানে কাজ করছে সে এলাকাও আমার নজরে থাকে। আমি ক্রুদের সামনে দিয়ে ধীরে হেঁটে দেখে নেই ইউটেনসিল-এপ্লায়েন্সেসগুলি কতটুকু পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। চেয়ারে ফিরে এসে এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলি কর্তব্যরত ক্রুদের উপর। দেখি তারা নিজেরা কিরকম পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এবং পরিপাটি। ক্রুদের সংখ্যা কত, তম্মধ্যে মেল কয় জন এবং ফিমেল কয় জন। ক্রুদের সবার বয়সও আন্দাজ করে নেই। চেয়ারে বসে বসে ক্রুদের প্রত্যেকের মুখের উপর চোখ বুলাই। বোঝে নেই ওরা কতটা প্রাণবন্তু-সজীব; সেবাদানে ওরা কতটা আন্তরিক এবং একনিষ্ঠ।
কাস্টমারদেরকে তারা কিভাবে সম্ভাষণ জানায়, কাঙ্খিত খাদ্যদ্রব্য কাস্টমারদের হাতে তুলে দিয়ে তাদেরকে কিভাবে বিদায় জানায় তাও আমি খেয়াল করি। শুনতে চেস্টা করি ক্রুরা নিজেরা কোন ভাষায় কথা বলে।

আমি খেয়াল করেছি একটা রেস্টুরেন্টের ক্রুদের টিমটি সাধারণত গঠিত হয় রেস্টুরেন্টেটি যে এলাকায় সে এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ কমিউনিটি থেকে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে। সেইজন্য তামিল অধ্যুসিত এলাকার রেস্টুরেন্টের ক্রুদের বেশির ভাগ সদস্য তামিল; অনুরুপভাবে চীনা এলাকার বেশিরভাগ ক্রু চীনা, বাঙালি এলাকার বেশিরভাগ বাঙালি, এই রকম।

ক্রুদের পুরো টিমের সবাই একটা কমিউনিটির এ রকম টিম হরটন্সও আমি অনেক দেখেছি। আমার মনে হয় ক্রু নিয়োগের সময় স্থানীয় অধিবাসিদের অধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়। বা হতে পারে টিম ম্যানেজার নিজস্ব কমিউনিটির প্রতি দায়বোধ থেকে এভাবে ক্রু নির্বাচন করে থাকেন।

আমি কিন্তু একই টিম হরটন্সে থিতু হই না। একটাতে পরপর কবার গিয়ে আমি অন্য একটাতে পা ফেলি। ওটার পর আরেকটাতে এরকমই চলছে। এভাবে এ ক’বছরে টরন্টোর বহু টিম হরটন্সে আমার যাওয়া হয়েছে এবং বহু টিম হরটন্স আমার নিবিড়ভাবে দেখা হয়েছে। টিম হরটন্সে গিয়ে আমি যে শুধু ক্রু আর ফ্লোর-আসবাব-গ্লাস দেখি তা নয়, আমি কাস্টমারদেরকেও খুব ভালোভাবে দেখি। দেখি তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ, দাঁড়ানো-বসা, খাওয়া-দাওয়া, ভাব-ভঙ্গি, কথা-বার্তা ইত্যাদি সব। এসব দেখে আমি টিম হরটন্সটি যে এলাকায় সে এলাকার মানুষদের আয়-ইনকাম, রুচিবোধ, সামাজিক অবস্থা, ইত্যাদি সম্মন্ধে মোটামোটি একটা ধারণা পাই।

আমি কয়েকটি টিম হরটন্স দেখেছি খুবই অপরিচ্ছন্ন। অবাক হয়ে দেখলাম ভিতরে যারা বসে আছে তারা ততোধিক অপরিষ্কার জামা কাপড় পরা। তাকিয়ে দেখি ফ্লোরে পড়ে আছে খাদ্য কণা, ইউজ করা পেপার নেপকিন; এমনকি কোন কোন টিম হরটন্সে দেখেছি ফ্লোরে কফি, কফি কাপ আর পানিয়ের খালি বোতল গড়াগড়ি খাচ্ছে। কর্তব্যরত ক্রুদের ভাবসাব এমন যে যারা এখানে আসে তাদের জন্য ডাইনিং রুম অত পরিষ্কার না রাখলেও চলবে। ক্রুদের উদ্দেস্যে মনে মনে বললাম- কাস্টমার যেমনই হোক তোমাদের দায়িত্বতো হলো রেস্টুরেন্ট পরিষ্কার রাখা; রাখতেছ কোথায়?

একদিন নতুন এক জায়গায় টিম হরটন্সে ঢুকলাম। ঢুকেই বুঝলাম সি গ্রেডের। ময়লা কাপড় চোপড় পরা অধিকাংশ কাস্টমার। সামনের দিকে চোখ ফেলতেই চোখ পড়লো একজনের দিকে। তার কানের উপর আটকানো আছে আধখান খাওয়া একশলা সিগারেট। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সে ডান হাতের আঙুল দিয়ে তার নাকের লম্বা চুল হেঁচকা টান দিয়ে ছিঁড়ে আনছে এবং তা ঝেড়ে ফ্লোরে ফেলছে। এবার দেখি সে তার বাম হাতটা পেছনে এনে তার পেন্টের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল; তারপরই শুরু করলো সে হাত দিয়ে তার পশ্চাতদেশ ভারি চুলকানি। চুলকানি দেখে মনের মধ্যে আমার খোঁচা খুঁচি করতে থাকলো। কেন এমন করে চুলকালো? একজিমা বা গনেরিয়া নয়তো? চুলকানি শেষ হলে সে হাতটা বের করে আনলো পেন্টের ভিতর থেকে এবং সে হাত দিয়েই ভালো করে ধরলো টেবিলের উপর এতক্ষণ পড়ে থাকা ডোনাটটি। ডোনাটটি খেতে শুরু করলো। দেখে আমার ভারি খারাপ লাগলো। হাপুস-হুপোস করে খাচ্ছে। ক্রিম-চকোলেট আঙুলে লেপটে যাচ্ছে। খাওয়া শেষ হলে ন্যাপকিন দিয়ে আঙুল পরিষ্কার না করে পশ্চাতদেশ চুলকানিতে ব্যবহ্রত ক্রিম-চকোলেট লাগা আঙুলগুলি সে মুখে পুরে চুষতে শুরু করলো। দেখে আমার বমি আসার উপক্রম হলো। মুহুর্ত বিলম্ব না করে কফি রেখে দৌড়ে আমি টিম হরটন্স ত্যাগ করলাম। সেদিনই আমার প্রথম সে রেসটুরেন্টে যাওয়া। দ্বিতীয় বার কোনদিন সে রেসটুরেন্টে ঢুকিনি।

এখন আপনারা হয়তো ভাববেন-এইলোক এতকিছু দেখে কেন? ভাবতেই পারেন। কিন্তু আমার কথা হলো- এই যে এভাবে দেখা এর কারণ এই নয় যে আমি বিপুল তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করছি; পরবর্তিতে সেগুলির উপর ভিত্তি করে একটা ঢাউস প্রবন্ধ লিখবো এবং কোন গবেষণা জার্নালে প্রকাশ করবো। তা নয়। আসলে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা আমার স্বভাব বা হবি। আমি কোন কিছুই হালকাভাবে দেখি না।

টরন্টোর বহু টিম হরটন্স দেখে আমি বুঝেছি ফিলিপিনো ক্রূদের দ্বারা গঠিত টিমের হাতে টিম হরটন্স থাকে সবচেয়ে সুন্দর অবস্থায়। ফিলিপিনো ক্রূদের দ্বারা পরিচালিত একটা টিম হরটন্সে এখন আমি থিতু হয়েছি। ওটা আমার বাসা থেকে কিছুটা দূরে। তবুও আমি সেখানেই নিয়মিত যাই। সেখানে কাস্টমারের ভিড়ভাট্টা কম। যারা আসে সবাই মোটামুটি সুরুচি সম্পন্ন। ওটা খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। যখনই যাই দেখি ঝকঝকে তকতকে অবস্থা। চারিদিকের গ্লাস দেখলে মনে হয় একটু আগে পরিষ্কার করা হয়েছে। রেসটুরেন্টটির ফিলিপিনো ক্রূগুলির হাসিমুখ, পরিপাটিতা, একাগ্রতা, নিষ্ঠা, ম্যানার, এটিক্যাট আমাকে সব সময় মুগ্ধ করে।

ম্যানেজারের কাছে একদিন জানতে চাইলাম-আচ্ছা, সব টিম হরটন্সে দেখি ক্রূদের প্রায় সবাই ফিমেল। তোমার এখানে দেখছি ব্যতিক্রম; যতজন ফিমেল ঠিক ততজনই মেল ক্রূ। এর কারণ কি? উচ্চ মধ্য বয়সি ম্যানেজার হেসে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো- জব কি শুধু মেয়েদের দরকার, ছেলেদের জবের দরকার নেই? আমি তার গুড সেন্সের জন্য তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালাম। ভালো কথা, প্রত্যেকটি টিম হরটন্স রেষ্টুরেন্টে একজন ম্যানেজার আছে; আবার এই ম্যানেজারের উপরে আছেন রিজিওনাল ম্যানেজার। একজন রিজিওনাল ম্যানেজার একটা রিজিঅনের প্রধান। একটা রিজিঅনের আট / দশটা টিম হরটন্স রেষ্টুরেন্টের তিনি সক্রিয় তদারক। তার রিজিঅনের সব টিম হরটন্স রেষ্টুরেন্টের সব ম্যানেজার তাদের কাজের জন্য তার কাছে দায়বদ্ধ। স¤প্রতি জানলাম এই রিজিঅনের রিজিওনাল ম্যানেজার একজন বাংলাদেশী। ভাবছি তার সাথে একদিন কথা বলবো। আমার অভিজ্ঞাতার কথা তাকে জানাবো।