Home কলাম টিভিটা অন করতেই দেখতে পেলাম দ্বিতীয় প্লেনটা টাওয়ারে গিয়ে আছড়ে পড়লো

টিভিটা অন করতেই দেখতে পেলাম দ্বিতীয় প্লেনটা টাওয়ারে গিয়ে আছড়ে পড়লো

মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

আঠাশ.
আমার শিক্ষকতা জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় ও উল্লেখ করার মত মূহূর্তটা এসেছিল ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে। সেদিন সকাল ছয়টায় আমার রুমমেটদের দরজায় ধাক্কায় আমার ঘুম ভেংগে গিয়েছিল। তারা আমার দিকে তাকিয়েই বলে উঠেছিল, ‘তাড়াতাড়ি টিভি’টা অন করে দেখো কি সাংঘাতিক ঘটনা ঘটছে।’ আমি টিভি’টা অন করতেই দেখতে পেলাম দ্বিতীয় প্লেনটা টাওয়ারে গিয়ে আছড়ে পড়লো। সেই বিভিষীকাময় দৃশ্যটা দেখার পর আমি তাড়াতাড়ি পোষাক পড়ে স্কুলে গেলাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আমি যা দেখলাম তা স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীই তাদের নিজের চোখে দেখেছে।

সেদিন গ্রেড নাইন আর টেন এর ক্লাসে ঢুকেই আমি বলেছিলাম, ‘আজকে আমরা আর ফরাসী ব্যাকরণ নিয়ে কথা বলবো না। কয়েক ঘন্টা আগে যা ঘটে গেছে আজ আমরা সেটা নিয়ে কথা বলবো।’

তখনই একজন ছাত্র বলে উঠলো, ‘স্যার, তাহলে কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাচ্ছে?’ যেহেতু সবাই বলাবলি করছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই হামলা করেছে মুসলিম মৌলবাদীরা, সেজন্য তাদের ভাবনায় এসেছিল মুসলমানদের সাথে এ যুদ্ধ লাগতে পারে। কয়েকজন ছাত্র তারপর বলে উঠলো, নিউইয়র্কের এই ঘটনায় কানাডা’র তেমন কিছু করা আছে বলে তারা মনে করে না। এর মধ্যে একজন জানতে চেয়েছিলো, ‘এই ঘটনাটা সত্যি সত্যি কিভাবে আমাদের জীবনে প্রভার ফেলবে?’ ভাবতেই কেমন লাগে যে একটা উড়োজাহাজ একেবারে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেলো, এমনটি আগে কখনো শুনিনি। নিশ্চয় সেটা মিলিটারী প্লেন হবে। তারপর ক্লাসটা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলো। চারিদিকের নিশ্তব্ধতা ভেংগে আমি বলে উঠলাম, ‘তোমরা এইমাত্র যে ভয় দ্বারা তাড়িত হচ্ছো আর যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সময় পার করছো, তা কিন্তু একেবারে নতুন।’ তারপর আমরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেক কথা বললাম। আমরা কিভাবে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারি তা নিয়েও অনেক কথা বলেছিলাম। সেই সাথে এ ব্যাপারেও আমরা কথা চালিয়ে গিয়েছিলাম, আমাদের সব সময় সজাগ থাকতে হবে যাতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে কোনোভাবেই যেন একতরফাভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দোষ চাপানো না হয় বা মুসলীম বিদ্বেষী কোনো প্রচারণা চালানো না হয়। ঐ ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলো টুইন টাওয়ার এর ঘটনায় খুবই আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল এবং সেই সময় আমাদের শিক্ষকদের সামনে খুব বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল কিভাবে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেই আতংক কাটিয়ে দিয়ে আবার তাদেরকে প্রতিদিনের স্বাভাবিক ক্লাসে ফিরিয়ে আনা যায়। সত্যিই বড় কঠিন সময় ছিল সেটা।

ঐ ঘটনার পরের দিন আমি গ্যারী বাটস এর কাছ থেকে একটা ফোন পেলাম। সে সেই সময় তার স্ত্রী যডি’র সাথে ক্যালিফোর্নিয়ায় ছিল আর চেষ্টা করছিল কিভাবে তাড়াতাড়ি কানাডায় ফিরে আসা যায়। সে সময় আমেরিকায় সাধারণ মানুষের প্লেনে যাতায়াত বন্ধ ছিল আর যে কয়েকটা প্লেন যাতায়াত করছিল সেগুলোর টিকিট পাওয়াও দুষ্কর ছিল, সে কারণে গ্যারী আর যডি একটা কার ভাড়া নিয়ে উত্তরে চালিয়ে আসছিল। কথা ছিল, তারা সীমান্তের এক শহরে কারটা রেখে সীমান্ত পার হবে আর আমি গিয়ে তাদেরকে নিয়ে আসবো।

আমি যখন পীস আর্চ এ পৌছলাম, তখন দেখলাম মার্কিন সীমান্তে অসংখ্য মানুষের ভীড়, গাড়ী ভর্তি হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তারা অপেক্ষা করে আছে। সেই হাইওয়ে ধরে গ্যারী আর যডি তাদের সুটকেস ঠেলতে ঠেলতে কোনো রকমে মার্কিন সীমান্ত পার হয়ে আমার গাড়ীর দিকে এগিয়ে আসলো। তাদেরকে স্বাগত জানানোর পর পরই গ্যারী আমাকে বলে উঠলো, ‘আচ্ছা, আমরা যে এখানে ঢুকলাম, এর জন্য কি কাস্টমস এর লোকদেরকে এই তথ্য দেয়া উচিৎ নয়?’ তখন কার থেকে বের হয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে আমরা একজনকে খুঁজে পেলাম যিনি হেঁটে সীমান্ত পার হওয়া মানুষদের বিষয়টা দেখভাল করছিলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি তার কাজটা শেষ করে দিলেন আর আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। আমি যখন গাড়ী চালাচ্ছিলাম তখন আমার গাড়ীর আয়না দিয়ে দেখচ্ছিলাম অসংখ্য সব গাড়ীর লম্বা লাইন। আমার মনে হলো, বাচ্চাদের নিয়ে পরিবারের সব সদস্যরা গাড়ীর পেছনের সিটে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা এমনকি দিনের পর দিন ধরে অপেক্ষা করছে। আর আমার বন্ধুর ভাগ্য ভালো সে কোনো অপেক্ষা ছাড়াই সীমান্ত পার হতে গেলো। নাইন এলেভেন এর মত একটা ঘটনা সামলানোর জন্য তড়িৎ গতিতে সুশৃংখলভাবে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন ছিল সেটা না হয়ে, এক বিশৃংখল অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে সেটা সামলানোর চেষ্টা চলছিল।

ভ্যাংকুভার জায়গাটা সত্যিই সুন্দর, আর এই জায়গাটা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া সব সহিংসতা থেকে বরাবরই বাইরে থাকে। কানাডার প্রায় যে কোনো জায়গাতেই বসবাস করলে যে বিশেষ অনুভূতি সবার মধ্যে কাজ করে, তা হচ্ছে, সব জায়গাই হচ্ছে সুরক্ষিত আর ঐ সব সহিংসতা থেকে অনেক দূরে। আমি বুঝতে পারছিলাম, নাইন এলেভেন এর ঘটনার পর পৃথিবীর আর কোনো জায়গাই সহিংস আক্রমণের বাইরে থাকবে না। সেই দিনের পর থেকে কানাডাসহ পৃথিবীর অনেক দেশই আল কায়দা বা এমন সব দলের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সফল হয়েছে। কিন্তু সেই সহিংস আক্রমণের হুমকি এখনো রয়েছে, সেই কারণে আমি সব সময় আমার ছাত্র ছাত্রীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ২০১১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের সেই বিভীষিকাময় আক্রমণের সময় তারা কোথায় ছিল সেটা যেন তারা কোনো দিন ভুলে না যায়। আর আমাদের জীবনের সেই কঠিন খারাপ সময়ের স্মৃতিটা যেনো সব সময় যে কোনো সহিংস কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সদা জাগ্রত থাকার এক বড় অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। (চলবে)

Exit mobile version