মম কাজী: টরন্টোকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অভিবাসী ধারণ করা শহর। হেন রঙের মানুষ নেই যাদের এই শহরে পাওয়া যাবে না। বৃস্টির দিনের বঙ্গদেশীয় বনেদী যৌথ পরিবারের খিচুরীর হাঁড়ির মতোই নানা ধরনের উপকরণ মিলেমিশে একাকার হয়ে অত্যন্ত সুস্বাদু এক বিশেষ পদ তৈরি হয়েছে। যুগে যুগে এই শহর বুকে টেনে নিয়েছে নানা বর্ণের মানুষ এবং এইসব মানুষেরও বহু সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে যার যার জাতিসত্তা নিয়ে মাথা উঁচু করে রাজত্ব করছে যার যার ক্ষেত্রে। আতিথেয়তা এবং নাগরিক স্বাধীনতার এই রেওয়াজের একটি উজ্জ্বল প্রতিফলন হল টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভাল অফ অথার্স (টিআইএফএ=টিফা) তথা আন্তর্জাতিক লেখ উৎসব। ১৯৭৪ সাল থেকে আজ অবধি উদযাপিত হয়ে আসছে অক্ষরশ্রমিকদের এই মিলনমেলা। যদিও ২০২০ সাল পর্যন্ত এই উৎসব শুধু ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এরপর থেকে টিফা স্বাগত জানাতে শুরু করেছে অন্যান্য ভাষাভাষীদেরও। সেই সুবাদে এবারে তামিল, আরবি এবং আমাদের প্রিয় বাংলার সংযোজন হয়েছে আন্তর্জাতিক এই সাহিত্য উৎসবে।
শরতের আকাশের ঝকঝকে রোদ এবং অন্টারিও লেকের পানিতে তাঁর ঝকমকে প্রতিফলন এবং আকাশচুম্বী ক্যানাডার গর্ব সিএন টাওয়ারের কোল ঘেঁষে টরন্টোর বিখ্যাত হারবারফ্রন্টে অনুষ্ঠিত হচ্ছে টিফা। ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ শুরু হওয়া টিফার এবারের থিম হচ্ছে ‘Where imagination takes flight”’ অর্থাৎ কল্পনার উড্ডয়ন। নানান স্বাদ ও বর্ণের উপকরণ দিয়ে সাজানো হয়েছে ৪৪তম টিফার পূর্ণ সমাবেশ। এগারোদিন ব্যাপী ক্যানাডার বৃহত্তম এই বার্ষিক গ্রন্থকার সম্মেলনে এবছর তৃতীয়বারের মতো অংশ নিচ্ছেন বাংলাভাষী লেখকরা। অ্যামেরিকার গায়ত্রী গ্যামার্শ মেমোরিয়াল এ্যাওয়ার্ড ও ক্যানাডার দক্ষিণ এশীয় নালন্দা সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী ২৯ গ্রন্থের লেখক সুব্রত কুমার দাসের নেতৃত্বে এবার ১১জন লেখক টিফা মঞ্চে তিনটি পর্বে অংশ নিয়েছেন উৎসবের চতুর্থ দিন।
২৪ সেপ্টেম্বর সকাল ১১-৩০ শরু হয় প্রথম পর্ব ‘Writing as a passion’। এখানে কথা বলে ড. দিলীপ চক্রবর্তী, রোকসানা লেইস এবং সুধীর সাহা। তিনজনেই তাঁদের এক ঘন্টার সেগমেন্ট মাতিয়ে রেখেছিলেন লেখার প্রতি তাঁদের প্রেম এবং আনুগত্যের কথা বলে। দর্শক মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন ছিয়াশি বছরের ড. দিলীপ চক্রবর্তীর লেখালেখি এবং প্রথম বই ছাপানোর অভিজ্ঞতার সরেস গল্প, সুধীর সাহার নানা ধরনের সমাজ সংস্করণমূলক কাজ এবং রোকসানা লেইসের স্বপ্নের শহর খোঁজার গল্প। সুব্রত কুমার দাসের চপল উপস্থাপনায় বাঙালি লেখকদের নিয়ে প্রথম এই সেগমেন্টটি হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত।
দুপুর একটায় ছিল দ্বিতীয় পর্ব। ‘Bengalis in CanLit’ পর্বে সুব্রতর সাথে ছিলেন কে. গান্ধার চক্রবর্তী, আরিফ আনোয়ার এবং লাবণি ইসলাম। তারা তিনজনই ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন। কিন্তু তাঁদের রয়েছে বাংলার সাথে প্রাণের সংযোগ। গান্ধারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা মন্ট্রিয়লে হলেও সাহিত্যের বিষবস্তুর মাঝে কোলকাতা এবং হিন্দু মিথলজির আবির্ভাব প্রমাণ করে বাংলার সাথে তাঁর সম্পর্ক কতটা নিবিড়। কবি লাবনী ইসলামের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা দেখা যায়। যেখানে তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুর মাঝে বাংলাদেশের প্রকৃতি, সমাজ এবং সংস্কৃতি উঠে এসেছে বারে বারে। বাংলাদেশের ছেলে আরিফ আনোয়ার ইংরেজিতে লেখা তাঁর গ্রন্থে ছাপিয়েছেন বাংলা অক্ষর। এই তিন লেখকের তিনভাবে ইংরেজি মাধ্যমে বিশ্বদরবারে বাংলা সাহিত্যকে উপস্থাপন বাংলা সাহিত্যপ্রেমী এবং বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী সকলের জন্যই অত্যন্ত গর্বের বিষয়।
বিকেল সাড়ে চারটায় অনুষ্ঠিত হয় শেষ পর্ব। ‘Reading Bengali Poems’ এ যে চার বাঙালি কবি অংশ নেন তাঁরা হলেন শেখর গোমেজ, আন্জুমান রোজী, শিউলী জাহান এবং কাজী হেলাল। তাঁরা চারজনেরই স্বরচিত কবিতা এবং তাঁর ইংরেজি অনুবাদ পড়ে শোনান। শেখর গোমেজ বিধাতার কাছে লেখা কাব্যপত্র পাঠ করেন আর কাজী হেলাল ঈশ্বরের কন্ঠে পাঠ করেন মানব জাতির প্রতি বাণী। আন্জুমান রোজীর কন্ঠে জোরালো হয় নারীবাদের কথা আর বাংলাপ্রেমী শিউলী জাহান পাঠ করেন একুশের চেতনায় লেখা তাঁর কবিতা।
প্রতিটি পর্বই মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছেন হল ভর্তি নানা দেশের দর্শক। আলোচনার মাধ্যম যদিও ছিল ইংরেজি; কিন্তু বিষয় ছিল খাঁটি বাংলা। যে ভাষার জন্য আজ থেকে একাত্তর বছর আগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাণ দিয়েছিল ভাষাপ্রেমী সৈনিকেরা। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো সেই একুশে ফেব্রæয়ারিতেই ইন্টারন্যাশনাল মাদার্স ল্যাঙ্গুয়েজ ডে পালিত হয় সারা পৃথিবী জুড়ে। আজ টিফার মত একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছাতে দেখে অত্যন্ত গর্বিত ছিলেন উপস্থিত সকল বাংলাভাষী সাহিত্যপ্রেমীরা। দর্শকদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন টরন্টোর বাঙালি কমিউনিটির অনেক গুণীজন। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সুজিত কুসুম পাল, রুমানা চৌধুরী, সৈকত রুশদী, বাদল ঘোষ, তাসমিনা খান, শ্রেয়সী বোসদত্ত, দেবাঞ্জনা মুখার্জী ভৌমিক, সামিনা চৌধুরী, অমল দেব, রোকসানা পারভীন শিমূল, জান্নাতুল নাইম প্রমুখ। অনুষ্ঠান দেখতে সুদূর হ্যালিফ্যাক্স থেকে এসেছিলেন তরুণ লেখক অতনু দাশ গুপ্ত।
প্রতিটি সেশনের সময়কাল ছিল এক ঘন্টা। তিনটি সেশনেই মডারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিশিষ্ট গ্রন্থকার, টিভি উপস্থাপক, কিউরেটর, রাইটার্স ইউনিয়ন অফ ক্যানাডা এবং লিটারারি ট্রান্সলেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ক্যানাডার সম্মানিত সদস্য সুব্রত কুমার দাস।
উল্লেখ্য যে এবার টিফায় অংশ নেন দেশ-বিদেশের দুই শতাধিক লেখক, চিত্রকর, কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ও চিন্তক। জনপ্রিয় গ্রন্থকারদের মধ্যে যাঁরা এই উৎসবে যুক্ত হচ্ছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ক্যানাডিয়ান লিভিং লিজেন্ড মার্গারেট অ্যাটউড, অস্কার বিজয়ী চিত্রনাট্যকার সারা পোলি, আদিবাসী পন্ডিতজন বিলি রে বেলকোর্ট, পুলিৎজার বিজয়ী অ্যামেরিকান ঔপন্যাসিক কলসন হোয়াইটহেড, জেনি অফিল, রিচার্ড ফোর্ড, ব্রিট বেনেট, পোয়েট্রি ফাওন্ডেশন ফেলো কবি ও ঔপন্যাসিক ওশন ভং, ক্যাথরিন হার্নান্ডেজ ও আদিবাসী সাহিত্যিক মিশেল গুড, আইরিশ লেখক অ্যান এনরাইট, রাশিয়ান-অ্যামেরিকান লেখক মাশা গেচেন এবং জাপানী শিল্পী মাকাতো উইকমুরা।