টরন্টো ভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৩৫তম ভার্চুয়াল আসরটি এপ্রিল মাসের ৯ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে নিবেদিত পাঠশালার এ আসরে, সত্যজিৎ রায়ের লেখা প্রথম প্রবন্ধ সংকলন ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ নিয়ে আলোচনা করেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায় যাঁকে বলতেন ‘আমার কাজের কম্পেন্ডিয়াম’, সত্যজিৎ বিশেষজ্ঞ দেবাশিস মুখোপাধ্যায়।

সত্যজিৎ রায় চিত্র পরিচালনা না, প্রথম জীবনে চেয়েছিলেন ভালো চলচ্চিত্র-দর্শক গড়ে তুলতে। সেই কারণেই ফিল্ম সোসাইটি তৈরি করে উৎকৃষ্ট চলচ্চিত্র দেখানোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। প্রথমে ইংরেজি, পরে বাংলা প্রবন্ধ। চলচ্চিত্র করার পর, নিজের চলচ্চিত্রের টুকরো দৃশ্যের বর্ণনাও ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর নিজের ভাষায় তাঁর শিল্পের কথা নিয়ে প্রথম প্রবন্ধ সংকলন — ‘বিষয় চলচ্চিত্র’।

বহুমুখী প্রতিভাধর সত্যজিৎ রায়ের নানান কাজে বাঙালি ও বিশ্ব মুগ্ধ ছিল বরাবরই। রায়পরিবারের অনন্য মানিক সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে তাঁর ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ নিয়েই ছিল পাঠশালার এবারের আয়োজন।

দেবাশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, “‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বইটা শুধু বাংলা না, এর ইংরেজি অনুবাদও হয়েছে। এটা বিশ্ব চলচ্চিত্র প্রেমিক, চলচ্চিত্রে আগ্রহী দর্শক, পাঠক, সমালোচক এবং পরিচালক সবারই অবশ্যপাঠ্য বই বলে আমার মনে হয়। বইটা প্রথম বেরিয়েছিল ১৯৭৬ সালে। এই বইয়ে মোট ১৩টা প্রবন্ধ ছিল। এই বইটা যখন প্রকাশ হয় তখন সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র পরিচালনায় এতটাই ব্যস্ত যে তিনি বইটার ব্যাপারে খুব একটা সময় দিতে পারেননি। বইটা অন্য একজন শিল্পী করেছিলেন। কিন্তু বইটা তাঁর খুব একটা পছন্দ হয়নি। পরে কিছু সংশোধন করেন। সাধারণ বইয়ের চেয়ে সেই বইয়ের আকার ছিল বড়ো। সত্যজিৎ রায় নিজেই ১৩টা প্রবন্ধ সাজিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন, কীভাবে সাজিয়েছিলেন তার ব্যাখ্যা তিনি করেননি। কারণ প্রবন্ধগুলো বিষয় এবং প্রকাশকাল অনুযায়ী সাজানো ছিল না। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে কলেজে চলচ্চিত্র সিলেবাসের মধ্যে এলে এই বইয়ের চাহিদা খুব বাড়ে। তখন সত্যজিৎ রায়কে অনেকেই বলেছিলেন এই বইটা সাশ্রয়ী মূল্যে প্রকাশ করতে। ১৯৮২ সালে এই বইয়ের নতুন সংস্করণ বের হয়। কিন্তু ছাপার পরে সত্যজিতের বইয়ের আকার পছন্দ না হওয়ায় তাঁর পছন্দে পকেট বুক সাইজে দ্বিতীয় সংস্করণ নতুন করে ছাপা হয়। এই নতুন ছাপার সময় আমার সঙ্গে আনন্দ পাবলিশার্সের যোগাযোগ হয়েছিল। তখন আমি নতুন সংস্করণে আরো কিছু প্রবন্ধ যোগ করার এবং প্রত্যেকটা প্রবন্ধ প্রকাশের সময়কাল উল্লেখ করার প্রস্তাব দিই। আনন্দ পাবলিশার্সের প্রকাশক বাদল বসু আমার কাছ থেকে সেই প্রবন্ধগুলো সংগ্রহ করেন। সত্যজিৎ রায় তা থেকে কিছু সংযোজন বিয়োজন করে আগের ‘হলিউডের হালচাল’ বাদ দিয়ে ৬টা নতুন প্রবন্ধ যোগ করেন। অর্থাৎ মোট ১৮টা প্রবন্ধ নিয়ে ‘বিষয় চলচ্চিত্রে’র দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৮২ সালে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশ পায়।”

“আমরা যদি বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাস দেখি এবং বিভিন্ন দেশের পরিচালকদের কাজ দেখি, তাহলে দেখা যায় চলচ্চিত্রকাররা বিশেষ করে ইউরোপীয় ও আমেরিকান চলচ্চিত্রকাররা নিজেদের চলচ্চিত্র নিয়ে খুব একটা বেশি লিখতে রাজি ছিলেন না, অভ্যস্ত ছিলেন না। তাঁরা শুধু ছবি পরিচালনা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে দেখা যায়, ইউরোপীয় ও আমেরিকান চলচ্চিত্রকাররা আত্মজীবনী লিখেছেন কিন্তু নিজের চলচ্চিত্র নিয়ে কখনো সেভাবে বিশ্লেষণ করেননি। একমাত্র ব্যতিক্রম হিচকক। হিচককও নিজে থেকে লিখেননি। বিশ্বখ্যাত ফরাসি পরিচালক ফ্রাঁসোয়া ত্রæফো হিচককের সাক্ষাৎকার নেন এবং সেই সাক্ষাৎকারে হিচকক তাঁর নিজের চলচ্চিত্র নিয়ে প্রচুর বিশ্লেষণ করেন। সেটা পৃথিবীর একটা অন্যতম সেরা বই। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। কারণ তিনি প্রথম জীবনে কখনোই পরিচালক হতে চাননি। চেয়েছিলেন ভালো চলচ্চিত্র দর্শক তৈরি হোক। তাঁর প্রথম লেখা ১৯৪৮ সালে, ইংরেজিতে। তিনি তখন ইংরেজিতে লিখতেই অভ্যস্ত ছিলেন।

ইংরেজিতে তিনি বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেন। তারও আগে লন্ডনের সিকোয়েন্স পত্রিকাতে, সেমিনার পত্রিকাতে রেনোয়াকে নিয়ে লিখেছিলেন। তাই দেখা যায় সত্যজিৎ প্রথম জীবনে চলচ্চিত্র নিয়ে লেখাতেই অভ্যস্ত ছিলেন। ১৯৪৮ ১৯৪৯ ১৯৫০ ১৯৫১ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি ইংরেজিতেই লিখে গিয়েছেন। ১৯৫৫ সালের পর পথের পাঁচালী মুক্তি পাবার পর তিনি বাংলা লেখায় অভ্যস্ত হন। সত্যজিতের প্রথম বাংলা লেখা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। তখন থেকেই তিনি বাংলায় লিখতে শুরু করেন। লেখার বিষয়ের মধ্যে ছিল নিজের কাজের অভিজ্ঞতা এবং নিজের চলচ্চিত্রের বিশ্লেষণ। এই ধরনের প্রবন্ধ তিনি একের পর এক লিখে গিয়েছেন। তবে সত্যজিৎ নিজেই বলেছেন, ইংরেজি প্রবন্ধ ছাড়া নিজে থেকে বাংলা প্রবন্ধ লিখেননি, যা লিখেছেন তার সবই ফরমায়েশি। দুটি লেখা ছিল ব্যতিক্রম। পত্রিকায় প্রকাশিত সমালোচনার উত্তরে তিনি দুটো লেখা লিখেছিলেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে। এই হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের লেখার শুরু ও লেখার ইতিহাস।

“আমাদের আলোচনার সুবিধার্থে বিষয় চলচ্চিত্রের প্রবন্ধগুলোকে ৩ ভাগে ভাগ করে নিতে পারি। প্রথমভাগ সাধারণ চলচ্চিত্র বিষয়ক। এর মধ্যে আছে – চলচ্চিত্রের ভাষা: সেকাল ও একাল (দেশ, বিনোদন; ১৯৬৯), চলচ্চিত্র-রচনা: আঙ্গিক, ভাষা ও ভঙ্গি (চলচ্চিত্র, বার্ষিকী; ১৯৫৯), ডিটেল সম্পর্কে দু’চার কথা (দেশ, বিনোদন; ১৯৬৮), চলচ্চিত্রের সংলাপ প্রসঙ্গে (আনন্দবাজার পত্রিকা, শারদীয়; ১৯৬৩), আবহসঙ্গীত প্রসঙ্গে (দেশ, বিনোদন; ১৯৬৪) এবং রঙীন ছবি (দেশ, বিনোদন; ১৯৭২)। এই ৬টি প্রবন্ধে বিশ্ব চলচ্চিত্রের গঠন, ভঙ্গি, আঙ্গিক নিয়ে লিখেছেন সত্যজিৎ। তার মধ্যে ‘চলচ্চিত্র-রচনা: আঙ্গিক, ভাষা ও ভঙ্গি’ শুরু করেছিলেন বিশ্ব চলচ্চিত্র দিয়ে। তারপর চলচ্চিত্র নির্মাণের পর্যায়ক্রমিক স্তরের বিস্তারিত বোঝাতে গিয়ে তিনি নিজের চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’র একটা দৃশ্যের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দেন। দ্বিতীয়ভাবে আছে দেশ, কাল, ভাষা সম্পৃক্ত চলচ্চিত্র। এই ভাগের প্রবন্ধের মধ্যে আছে – সোভিয়েত চলচ্চিত্র (সোভিয়েত বিপ্লব পরিচয়, শারদীয়; ১৯৬৭), অতীতের বাংলা ছবি (আনন্দলোক, শারদীয় ১৯৭৮), বাংলার চলচ্চিত্রের আর্টের দিক (আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত। বেতার জগত, শারদীয়; ১৯৬০)। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে বিশ্লেষণ ও তার ইতিহাস বলা। যেমন ‘সোভিয়েত চলচ্চিত্র।’ আর বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে তিনি উল্লেখিত দুটি বিশেষ প্রবন্ধ লিখেন। এতে বাংলা ছবির গঠন প্রক্রিয়া, ভুলত্রæটি, ইতিবাচক দিক, শৈলী, গুরুত্ব এবং কোন কোন চলচ্চিত্র বিশেষভাবে উৎরেছে সেসব নিয়ে লিখেছেন। তৃতীয় ভাগে আছে নিজের চলচ্চিত্র প্রসঙ্গ। অর্থাৎ নিজে চলচ্চিত্র তৈরির অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। এই ভাগে রয়েছে ৯টা প্রবন্ধ – দু’টি সমস্যা (দেশ; ১৯৬৭), পরিচালকের দৃষ্টিতে সমালোচক (দেশ, শারদীয়; ১৯৬৫), ‘অপুর সংসার’ প্রসঙ্গে (দেশ; ১৯৫৯), চারুলতা প্রসঙ্গে (পরিচয়; ১৯৬৪), ওরফে ইন্দির ঠাকুরণ (মধ্যবিত্ত, শারদীয়; ১৯৫৫), দুই চরিত্র (দেশ, শারদীয়; ১৯৬২), একথা সেকথা (দেশ, বিনোদন; ১৯৭০), বিনোদ-দা (দেশ, বিনোদন; ১৯৭১) ও শতাব্দীর সিকি ভাগ (আনন্দলোক, পূজাবার্ষিকী; ১৯৮০)। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ১৯৫৫ সালে প্রথম লেখা ও ১৯৮০ সালে শেষ লেখা। এই সময়কালের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের লেখা মোট ১৮টা প্রবন্ধ নিয়ে এই ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বইটার গঠন।
“সত্যজিতের এই লেখায় বারবার সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের তুলনা উঠে আসছে। এবং সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র হবার সময়কার পর্যায় যা দর্শক দেখতে পায় না কিন্তু পরিচালক দেখতে পান সেসবের বর্ণনা করছেন সত্যজিৎ।”

‘চলচ্চিত্রের ভাষা: সেকাল ও একাল’, ৫টি অনুচ্ছেদের দীর্ঘ এই প্রবন্ধে সত্যজিৎ রায় সিনেমার ভাষা ও ব্যাকরণের উদ্ভব এবং এর বিবর্তনের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। সিনেমার সঙ্গে অন্য শিল্প মাধ্যম যেমন – স্থিরচিত্র, চিত্রকলা ও মঞ্চ নাটকের পার্থক্য তুলে ধরেছেন। সিনেমার ভাষা নির্মাণে অগ্রণী পরিচালক ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ, সের্গেই আইজেনস্টাইন, জাঁ রেনোয়া, ফ্রাঁসোয়া ক্রুফো, জাঁ লুক গদার প্রমুখের ভাষা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। এছাড়াও তিনি তুলে ধরেছেন চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগ থেকে সবাক যুগে উত্তরণ ও সাদা-কালো থেকে রঙিন সিনেমার আবির্ভাবের কথা।

নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগ লুমিয়ের থেকে শুরু। কিন্তু সিনেমার ভাষা নির্মাণের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন মার্কিন পরিচালক ডি ডবিøউ গ্রিফিথ। সিনেমার ভাষা যে প্রধানত ক্যামেরার ভাষা এটির চল গ্রিফিথের সময় থেকেই হয়।
হলিউডে স্ল্যাপস্টিক কমেডির চলচ্চিত্র ব্যাকরণ রচনাকারী ছিলেন ম্যাক সেনেট এবং সেনেটের সূত্র ধরে আসেন সমাজ-সচেতন দরদী শিল্পী চার্লি চ্যাপলিন ও বাস্টার কিটন। চার্লি চ্যাপলিন এর চলচ্চিত্র City Lights এর বিখ্যাত শেষ ক্লোজ-আপ শট এবং Gold Rush Qwei superimposition এর কথা উল্লেখ আছে। আছে তাঁদের Mime, superimposition, fast motion, tracking shot এর কথা। Tracking shot এর গতির সঙ্গে খেয়াল সঙ্গীতের জলদের অংশের তুলনা করেন সত্যজিৎ।

রাশিয়ায় লেনিনের নির্দেশে তরুণ উৎসাহী চলচ্চিত্র পরিচালক আইজেনস্টাইন, পুদোভকিন ও দোভজেঙ্কো চলচ্চিত্র নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন। দোভজেঙ্কোর চলচ্চিত্র Earth, পুদোভকিনের চলচ্চিত্রে মনস্তত্ত¡ বা behaviorism এবং আইজেনস্টাইন প্রবর্তিত চলচ্চিত্রের ভাষার অবিচ্ছেদ্য অংশ montage সম্পর্কে বিবরণ আছে।

ইউরোপীয় চলচ্চিত্রে ডেনমার্কের কার্ল ড্রায়ার, সুইডেনের শিলার ও শোস্ট্রম, জার্মানির মুর্নাউ, পাবস্ট, লাং, লুবিচের নাম উল্লেখযোগ্য। গল্পের দিকে এঁদের ঝোঁক ছিল বেশি। ড্রায়ারের চলচ্চিত্র The Passion of Joan of Arc আজও পুরোনো হয়নি।
১৯২৮ সালে আমেরিকায় প্রথম সবাক ছবি তোলা হয়। জাঁ রেনোয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি La Regle du eu (Rules of the Game 1939) এ কেন্দ্রস্থ চরিত্র বলে কিছু নেই। Deep focus এর ব্যবহার আছে ছবিটিতে। রেনোয়ার আরেকটি ছবি Southerner। দুটি ছবির একটিও এখনো ওল্ড-ফ্যাশনড না। রেনোয়ার সবচে বড়ো গুণ মানবিকতা। রেনোয়া সৃষ্ট চরিত্রগুলো শুধু সজীব নয়, তারা দোষে গুণে মিলিয়ে এক একটি সম্পূর্ণ মানুষ।

rules of game এর ৩ বছর পর অরসন ওয়েলস এর তৈরি চলচ্চিত্র ‘সিটিজেন কেইন’ চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যুগান্তকারী সৃষ্টি। এটি ছিল বিপ্লবাত্মক ব্যতিক্রম। দর্শকদের অতিরিক্ত পীড়া না-দেওয়া অর্থাৎ দর্শকদের চোখ, কান ও মন এই তিনটে সম্পর্কে সজাগ সাবধানতা থাকত পরিচালকদের। ওয়েলস এই তিনটেকেই আঘাত করলেন।

১৯৫০-৫১ সালে জাপানী পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার Rasho Mon ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের অদ্ভুত সংমিশ্রণ আছে চলচ্চিত্রটিতে। আরেকজন উল্লেখযোগ্য জাপানী পরিচালক ছিলেন ইয়াসুজিরো ওজু।

ফরাসী পরিচালক ফ্রাঁসোয়া ত্রæফো তাঁর ৪০০ Blows চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যের শেষ শট এ প্রথম freeze ব্যবহার করেন। ছবির প্রধান চরিত্র একটি দুরন্ত ডানপিটে ছেলে। Jules et ঔরস ত্রুফোর আরেকটি ছবি। আনকনভেনশনাল কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র ছবিটিতে। ত্রুফো বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক Andre Bazin এর সংস্পর্শে আসেন। গোদার, শাব্রল, রিভেৎ এঁরাও। এঁদের নেতৃত্বেই নিউ ওয়েভের সূচনা।

চিত্রভাষার ব্যাপারে বিপ্লবের পুরোধা হলেন জাঁ লুক গোদার। তবে গোদার বা নিউওয়েভ আবির্ভাবের কিছু আগে থেকেই ইতালির নিও-রিয়ালিস্ট যুগের শুরু। যার পুরোভাগে ছিলেন ডি সিকা, রসেলিনি, ডি সান্তিস। Bicycle Thieves, Open City ছিল উল্লখযোগ্য কাজ। নিও রিয়ালিজমের কিছু পরে ৫০ শতকের গোড়ার দিকের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ছিল আন্তোনিওনির II Grido, বুনুয়েলের Nazarin ও ব্রেঁসর The Diary of a Country Priest।

গোদারের কনভেনশন সম্বন্ধে অবজ্ঞা ছিল। তিনি ছিলেন বিদগ্ধ ও বামপন্থী। তাঁর বহু প্রশংসিত ছবি Breathless। কম খরচে ছবি প্রথম বানিয়ে দেখান গোদার। কম্পন ও jump cut যে স্টাইলের একটি অঙ্গ সেটিও গোদার প্রতিষ্ঠিত করেন। গোদারের মত উগ্র-আধুনিক না হয়েও ভালো ছবি করেছেন ইউরোপের বার্গম্যান, আন্তোনিওনি, বেলোকিও, ওলমি, প্যাসোলিনি, বুনুয়েল, ফরম্যান, জাঙ্কশো এঁরা। সত্যজিৎ বলেন, সবদেশে সবকালেই দর্শক চায় নিটোল প্লট সম্বলিত কাহিনি। এর ব্যতিক্রম করতে গেলেই অনেক প্রতিবন্ধকতার সামনে পড়তে হয়েছে চলচ্চিত্র পরিচালকদের। হলিউডে গোদারের অন্ধ অনুকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিয়ম ভাঙতে হলে নিয়ম জানা দরকার।

‘চলচ্চিত্র-রচনা: আঙ্গিক, ভাষা ও ভঙ্গি’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র তৈরির সব পর্যায়ের বর্ণনা দেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য-পর্যায়ের বর্ণনা করেন। দুর্গা মারা যাবার পর হরিহর বাড়ি ফিরলে হরিহর, অপু ও সর্বজয়া আছে সেই দৃশ্যে।
‘ডিটেল সম্পর্কে দু’চার কথা’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ বলেন, চলচ্চিত্রকে একান্তভাবে বিংশ শতাব্দীর শিল্পকলা বলা হলেও তার রচনারীতি যে আংশিকভাবে প্রাচীন শিল্প-সাহিত্যে অন্তর্নিহিত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। প্রাক চলচ্চিত্র যুগের আগে সা¤প্রতিক সাহিত্যিকদের মধ্যে বিশেষ করে দুজনের ডিটেল-সচেতনতার কথা উল্লেখ করতে হয় – বঙ্কিমচন্দ্র ও অবনীন্দ্রনাথ। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে নগেন্দ্র দত্তের বাড়ির উঠোনের প্রায় এক পৃষ্ঠার বর্ণনা দেখা যায়। আর অবনীন্দ্রনাথকে প্রধানত যে শিল্পরীতি প্রভাবিত করেছিল তার মূলে ছিল আমাদের বাংলার রূপকথা। রূপকথায় ডিটেলের প্রয়োজন সবচে বেশি। সত্যজিৎ লিখেন, লেখক কথক কবিয়াল পাঁচালিকার – সকলেই ভাব প্রকাশে বারবার ছবির আশ্রয় নিয়েছেন। অথচ চিত্র রচনাই যাঁদের কাজ, তাঁরা ছবির কথা ভুলে যাবেন, ডিটেলের কথা ভুলে যাবেন, এর চেয়ে আক্ষেপের বিষয় আর কী হতে পারে?

‘চলচ্চিত্রের সংলাপ প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ বলেন, ছবি দিয়ে যা বলা সম্ভব হলো না, সংলাপে কেবল সেটুকুই বলার চেষ্টা করা উচিত। না হয় হয়ে যাবে অতিকথন। বাংলা ছবিতে নাটকের মতো চটকদারি সংলাপ দেখা যায়। অথচ সংলাপ স্বাভাবিক না হলে অভিনয় স্বাভাবিক হওয়া মুশকিল। চিত্রনাট্যের সংলাপ রচনার গুরু হিসেবে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের কথা উল্লেখ করেন সত্যজিৎ।

‘আবহসঙ্গীত প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ রায় সিনেমায় আবহসঙ্গীতের বিবর্তনের ইতিহাসসহ নিজের চলচ্চিত্রের আবহসঙ্গীত নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেন। সিনেমায় আবহসঙ্গীতের শুরু গ্রিফিথ থেকে। নির্বাক যুগের উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল আইজেন্সটাইনের ‘পোটেমকিন’ ছবির জন্য রচিত জার্মান সুরকার এডমুন্ড মাইজেলের স্বরলিপি। সবাক যুগে আবহসঙ্গীতে অর্কেস্ট্রার ব্যবহার দেখা যায়। আবার প্রয়োজনে দেখা যায় আবহসঙ্গীত বর্জনও। সত্যজিৎ বলেন, চলচ্চিত্রের আবহসঙ্গীত ব্যঞ্জকের ভূমিকা গ্রহণ করে, যদি তা সুপ্রযুক্ত হয়। করুণ দৃশ্যে যদি পরিচালকের দোষে কারুণ্যের অভাব ঘটে থাকে তাহলে বেহালা বা তারসানাই বাদকের করুণতম স্বরোচ্ছ¡াসও সে অভাব পুরণ করতে অক্ষম। ভালো ছবিকে নষ্ট করার একটি উপায় হলো বেমানান আবহসঙ্গীত। সত্যজিৎ নিজের চলচ্চিত্রে আবহসঙ্গীত নিয়ে কাজ করতে গিয়ে উপলব্ধি করেন, আবহসঙ্গীতের ব্যাপারে সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় ব্যকরণ নিয়ে গোঁড়ামি সম্পূর্ণ অর্থহীন। যেমন ‘পথের পাঁচালী’তে গ্রাম্য পরিবেশ হলেও লোকসাহিত্য নয়, ভাষায় মেজাজে আছে সফিস্টিকেশন। ‘পথের পাঁচালী’র সঙ্গীত পরিচালক রবিশঙ্কর বাঁশি, গুপীযন্ত্র, ঢোল ইত্যাদির সঙ্গে সেতার সরোদ পাখোয়াজ মেশাতে দ্বিধা করেননি। আবার ‘তিন কন্যা’ ‘পোস্টমাস্টারে’ গ্রাম্য পরিবেশ, সবকিছু খুব সরল। তাই তাতে ব্যবহার করা হয়েছে শুধু বাঁশি, দোতারা আর সারিন্দা। ‘জলসাঘরে’ বনেদি মেজাজ। তাই বিলায়েত খাঁ সেতার সুরবাহার সরোদ সারেঙ্গীতে খানদানী রাগরাগিনী বাজিয়েছেন। সত্যজিতের আরেকটি উপলব্ধি হলো, আবহসঙ্গীতে রাগাশ্রিত সুর ব্যবহার হলেও তবলা অচল এবং সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ অচল। দৃশ্যে ভাব থেকে ভাবান্তরে যাওয়ার মুহূর্তে রাগ থেকেও রাগান্তরে যেতে হয়। আচমকা বেপর্দার প্রয়োগ হতে পারে প্রয়োজনে। তাই সুরকারের আনুগত্য থাকতে হবে চলচ্চিত্রশিল্পের প্রতি, সঙ্গীতশাস্ত্রের প্রতি না। ‘মহানগর’ আর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় দেখা যায় সংমিশ্রণ। ‘কাঞ্চনজংঙ্ঘা’য় ইঙ্গবঙ্গ উচ্চমধ্যবিত্ত একদিকে অন্যদিকে পাহাড়। পাহাড়ি লোকসঙ্গীতের সুর ইচ্ছেমতো ভেঙে দেশি ও বিলাতি যন্ত্র একক ও সমবেতভাবে বাজিয়ে এর আবহসঙ্গীত করা হয়েছে। সত্যজিৎ বলেন, আজ অবধি যে ক’টা ছবিতে তিনি নিজে সঙ্গীত রচনার দায়িত্ব নিয়েছেন তার মধ্যে ‘চারুলতা’র সঙ্গীত তাঁর কাছে অপেক্ষাকৃত সাবলীল ও সুপ্রযুক্ত বলে মনে হয়েছে। তবে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে, পোশাকে, কথাবার্তায়, বাড়িঘরদোরের চেহারার কোনো স্পষ্ট চরিত্র নেই, সবই খিচুড়ি, সেদেশের পটভূমিকায় আধুনিক ছবির আবহসঙ্গীত রচনা এক দুরূহ ব্যাপার। আরো একটা কথা বেশ জোর দিয়েই বলা চলে যে, ভারতবর্ষে আবহসঙ্গীত রচয়িতার সমস্যা দৈন্যের সমস্যা নয়, সেটা হলো প্রাচুর্যের সমস্যা।

‘রঙীন ছবি’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ বলেন, ১৯৩৫ সালে প্রথম তিন-রঙা কমার্শিয়াল ছবি Becky Sharp আত্মপ্রকাশ করে। শক্তিমান পরিচালকের প্রধান গুণ হলো বাক্যের সাহায্য না নিয়েও দৃশ্যকে বাঙ্ময় করে তোলা। সাদা-কালোর অক্ষমতা বলতে গিয়ে ‘পথের পাঁচালী’তে রাণুর বিয়ের দৃশ্যে সিঁদুর ও আলতার রঙ বোঝা না-যাওয়ার কথা উল্লেখ করেন। আবার গ্রাম্য প্রকৃতিতে মেঘমুক্ত আকাশের রঙ বারবার বদলানোও সাদা কালো চলচ্চিত্রে বোঝানো যায় না?

চরিত্রের রূপ (শ্রেণিগত চরিত্র) ফুটিয়ে তুলতেও রঙ সাহায্য করে। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় ৮/৯টি চরিত্রের পোশাকের মাধ্যমে চরিত্রগুলোর সামজিক অবস্থান, মানসিক রুচির ইঙ্গিত ছিল। অর্থাৎ রঙের আছে তথ্যবহন ক্ষমতা, না হয় সংলাপের সাহায্যে বলতে হতো। নাট্যরস সৃষ্টিতেও রঙের ভূমিকা আছে। এসবের বিপরীতে আছে রঙের সংযত প্রয়োগ। এই রঙেরই অযাচিত প্রয়োগ সম্পর্কে সত্যজিৎ বলছেন, “রঙের অমিত প্রয়োগে যে কী বিভীষিকার সৃষ্টি করতে পারে, আজকের যে কোনো হিন্দি ছবিতেই তার প্রমাণ মিলবে। হিন্দি ছবিতে রঙের ব্যবহার গø্যামারের উদ্দেশ্যে। বিষয়বস্তুর দৈন্য গোপন করার জন্যই এই বহুবর্ণ মোড়কের প্রয়োজন। গø্যামারের কথা চিন্তা করেই হিন্দি ছবির প্রযোজক প্রাকৃতিক পরিবেশে দৃশ্য গ্রহণের কাজটা ঝলমলে রোদে ছাড়া করেন না। অথচ মেঘলা দিনের বিষণ্ণ গাম্ভীর্য চমৎকারভাবে রঙীন ছবিতে প্রকাশ করা যায়। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, দার্জিলিঙে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবির দৃশ্য গ্রহণকালে সেই একই সময়ে একই জায়গায় একটি হিন্দি ছবির শুটিং-এর কথা। নভেম্বর মাসের প্রাকৃতিক অবস্থার কথা চিন্তা করে কাঞ্চনজঙ্ঘার চিত্রনাট্যে মেঘ, রোদ, কুয়াশা সব রকম অবস্থার উপযোগী দৃশ্যের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। হিন্দি পরিচালক তুলছিলেন একটি গানের দৃশ্য। ছাব্বিশ দিন শুটিং-এ দ্রæত পরিবর্তনশীল প্রাকৃতিক অবস্থার সদ্ব্যবহার করে কাঞ্চনজঙ্ঘার কাজ শেষ হলো, আর এই ছাব্বিশ দিন ধরে কেবলমাত্র রোদের আশায় বসে থেকে এই একটিমাত্র গানের শুটিং-ও শেষ করতে পারলেন না হিন্দি ছবির পরিচালক।”

‘অশনি সংকেতে’ রঙ কেন? এই প্রসঙ্গে সত্যজিৎ লিখেন, বিষয়বস্তু দারিদ্র্য সংক্রান্ত না স্বচ্ছলতা সংক্রান্ত সেটা কোনো প্রশ্নই নয়, কারণ দারিদ্র্যেরও বিশেষ রঙ আছে, যেমন স্বচ্ছলতারও আছে। ‘অশনি সংকেতে’র পর সত্যজিতের উপলব্ধি হয়, রঙ জিনিসটা সব বিষয়বস্তুর পক্ষেই উপযোগী।

‘সোভিয়েত চলচ্চিত্র’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ রায় সেদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। তুলে ধরেছেন প্রাক-বিপ্লব যুগে রাশিয়ায় চলচ্চিত্র শিল্পের উদ্ভব এবং বিপ্লবোত্তর যুগে এর বিবর্তন। বিপ্ল­বে বলশেভিক দলের জয়, বহু চলচ্চিত্র শিল্পীর ইউরোপ-আমেরিকায় পলায়ন এবং চলচ্চিত্রের জাতীয়করণ প্রভৃতি ঘটনার পরম্পরা বিশ্লেষণ করেছেন। সোভিয়েত চলচ্চিত্রের তিন প্রতিভা সের্গেই আইজেনস্টাইন, পুদোভকিন ও আলেকজান্ডার দোভচেঙ্কোর এ শিল্পে জড়িত হওয়ার ঘটনা ও তাদের ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্র সম্পর্কে এখানে ধারণা পাওয়া যায়। সরকারি হস্তক্ষেপের ফলে সোভিয়েত চলচ্চিত্রের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সেটাও সত্যজিৎ রায় এ প্রবন্ধে ইঙ্গিত দিয়েছেন।

১৯০৭ সালের প্রথম রুশ ছবি থেকে শুরু করে বিপ্লবের আগ পর্যন্ত দ্রাঙ্কফ (তলস্তয়কে দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন) ও খানজঙ্কফ ছাড়া যাঁরা রুশ চলচ্চিত্রের ক্রমপরিবর্তনে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে পরিচালক গনচারফ, প্রোতাজানফ ও ইয়েভগেনি বাউয়ের, সাহিত্যিক ও নাট্যকার লিওনিদ আন্দ্রেইয়েফ, নাট্য প্রযোজক মায়ারহোল্ড (তাঁর আধুনিক মঞ্চরীতির অন্যতম পথিকৃৎ কাজ – ডোরিয়ান গ্রে) ও বিপ্লবী কবি মায়াকোভস্কি (চিত্রনাট্যকার ও অভিনেতা) উল্লেখযোগ্য।

জুরিখে নির্বাসনকালে লেনিন প্রায়ই সন্ধ্যাটা কাটাতেন সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে। তিনি ছায়াচিত্রের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন।
১৯১৭র ফেব্রæয়ারির বিপ্লবের পর শ্রমিক-শিল্প-সংঘ প্রোলেটকাল্ট তৈরি হয়। চলচ্চিত্রের জাতীয়করণ হয় আগস্ট ১৯১৯ সালে। ১৯১৮র জুনে তৈরি হয় প্রথম সোভিয়েত কাহিনীচিত্র ‘সিগন্যাল’। এর পরিচালক ছিলেন আলেকজান্দার আর্কাতফ। ১৯১৮তেই Agit-train এর সূচনা। এর গন্তব্য ছিল রাশিয়ার পূর্ব সীমান্ত, রেড আর্মিকে উদ্দীপ্ত করার জন্য। এর পুরোভাগে ছিলেন আইজেনস্টাইনের ক্যামেরাম্যান এদুয়ার্দ তিসে। ম্যাক্সিম গোর্কি চলচ্চিত্র ও নাটক সম্পর্কে প্রস্তাব করেন। কিন্তু তাঁর লেখা ২৫টি চিত্রনাট্যের আর বাস্তবায়ন হয়নি। তখন গ্রিফিথের ‘ইন্টলারেন্স’ সহ আরো অনেক ছবি রাশিয়ায় দেখানো হয়। সোভিয়েত চলচ্চিত্র শিল্পের ওপর গ্রিফিথের গভীর প্রভাব ছিল।

সোভিয়েত চলচ্চিত্রের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ছিলেন আইজেনস্টাইন, লেভ কুলেশভ, সেভোলোড পুদোভকিন ও আলেকজান্দার দোভচেঙ্কোসহ আরো কয়েকজন।

এই পর্যায়ে সোভিয়েত রাশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে স্বশাসিত চলচ্চিত্র বিভাগ চালু হয়। লেনিন বাস্তবভিত্তিক ছবি তোলার ওপর জোর দেন। এবং এরই প্রভাবে ১৯২২ সালে ‘কিনো-প্রাভদার’ (সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের চলচ্চিত্র সংস্করণ) সূচনা। যাকে আজকের দিনের সাপ্তাহিক নিউজরিলের জনক বলা হয়।

আইজেনস্টাইন প্রোলেটকাল্টের পক্ষ থেকে এই সময় অস্ত্রভস্কির Enough Simplicity in Every Wise Man নাটক মঞ্চস্থ করেন। এই নাটকের অংশ থেকে নির্মিত চলচ্চিত্র দিয়েই আইজেনস্টাইনের হাতেখড়ি।

১৯২৩ এ চলচ্চিত্রের জাতীয়করণ হয়। এর পরেই সোভিয়েত নির্বাক চলচ্চিত্রের সুবর্ণ যুগ। এর মধ্যে কুলেশভের The Extraordinary Adventures of Mr West in the Land of the Bolshevik, পুদোভকিনের Death Ray I Mechanics of the brain, জিগা ভের্তফের Kino-Eye ও আইজেনস্টাইনের Strike উল্লেখযোগ্য।

‘স্ট্রাইক’ চলচ্চিত্রটি সোভিয়েত চলচ্চিত্রে বিপ্লব আনে। আইজেনস্টাইনের বিখ্যাত সম্পাদনা রীতি ‘Montage of Attractions’ এর উদ্ভবও এই চলচ্চিত্রেই। ১৯০৫ এর ঘটনাবলীর ওপর ‘১৯৩৫’ই শেষে ‘পোটেমকিন’ এ রূপ নেয় যা বিশ্ববিশ্রæত ও বহুবিশ্লিষ্ট। এই বিপ্লবকে কেন্দ্র করেই পরে গোর্কির উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয় পুদোভকিনের ‘মাদার’, যা পোটেমকিনের মতই স্মরণীয়। আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্রের সঙ্গে বাখ আর পুদোভকিনের সঙ্গে বেটোফেনের তুলনা করেন সত্যজিৎ।

রাশিয়ায় সবাক চলচ্চিত্র আসার এক পর্যায়ে শুরু হয় সরকারী হস্তক্ষেপ।
ত্রিশ দশকের উল্লেখযোগ্য সোভিয়েত চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে – আইজেনস্টাইনের আলেকজান্দার নেভস্কি, ভ্যাসিলিয়েভ ভ্রাতৃদ্বয়ের চাপাইয়েফ, ভের্তফের থ্রি সংস অফ লেনিন, দনস্কইয়ের গোর্কি জীবনী ও দোভচেঙ্কোর আর্থ।

মহাযুদ্ধে দেশাত্মবোধের উন্মেষ ঘটে। আইজেনস্টাইনের শেষ ছবি ‘ইভান দি টেরিবল’ এই যুদ্ধের (২য় বিশ্বযুদ্ধ) সময়ের ছবি। চলচ্চিত্রের কোনো শিল্পকীর্তি যদি শেক্সপিয়রের পঙক্তিতে স্থান পাবার যোগ্যতা রাখে তবে তা আইজেনস্টাইন রচিত দুই খণ্ডে অসমাপ্ত ইভানের জীবনীচিত্র।

চলচ্চিত্র মূলত প্রযুক্তি নির্ভর শিল্প। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো বাংলা চলচ্চিত্র প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে রয়েছে। সত্যজিৎ রায় তাঁর ছেলেবেলার বাংলা সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন ‘অতীতের বাংলা ছবি’ প্রবন্ধে। এখনকার অনেকের মতো অল্প বয়সে তাঁরও মনে হয়েছিল হলিউডের তুলনায় বাংলা ছবি নিস্প্রভ। তবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে এসে সত্যজিৎ দেখলেন বাংলা চলচ্চিত্রের দুর্বলতা কেবল প্রযুক্তিতে নয়, বরং মূল কারণ হিসেবে তিনি চিত্রনাট্য, অভিনয় ও পরিচালনার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। সঙ্গে আরেকটি বিষয় দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, অতীতের সিনেমাগুলোতে বাঙ্গালি জীবনের স্বাভাবিক চেহারায় বিলেতি পালিশ দিয়ে উপস্থাপন। তবে ধর্মভিত্তিক ছবি ‘বিদ্যাপতী’ বা ‘চণ্ডীদাস’ অথবা বাংলা উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি চলচ্চিত্রে হলিউডের প্রভাব কম। এসব সিনেমায় আবার থিয়েটারের প্রভাব পড়েছে। সত্যজিৎ এর মতে, এসব কারণে চিত্র ভাষার দিক দিয়ে অতীতের বাংলা চলচ্চিত্র উৎকর্ষ লাভ করে নি।

বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক বিভুতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের সিনেমার জন্য লেখা উপন্যাস ‘দম্পতি’। বাংলা ছবির উপাদান কী হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে তখনকার সাহিত্যিকদের ধারণার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে এই উপন্যাসে।

হলিউডের অন্ধ অনুকরণে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল সবাক যুগের গোড়ার দিকে তোলা চারু রায়ের ‘বাঙালি।’

থিয়েটারের পথ ধরে বাংলা ছবিতে গানের প্রবেশ ঘটে। প্রমথেশ বড়ুয়ার সংযমী অভিনয়ের পাশাপাশি ৪০ এর দশকে কাহিনীকার জ্যোতির্ময় রায়, পরিচালক বিমল রায়ের নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর ছবি উদয়ের পথে, হেমেন গুপ্তর ভুলি নাই ও ‘৪২, সত্যেন বসুর বরযাত্রী, নির্মল দের বসু পরিবার, সাড়ে চুয়াত্তর, চাঁপাডাঙার বৌ এর কথা উল্লেখ করেন সত্যজিৎ। তিনি বলেন, চিত্রোপযোগী কাহিনী বা ভালো চিত্রনাট্যকারের অভাব এদেশে চিরকালই। তারওপর এখন চলচ্চিত্রের সব দিক জানা দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন পরিচালকের অভাব।

‘বাংলা চলচ্চিত্রের আর্টের দিক’ প্রবন্ধে জনপ্রিয়তা বনাম শিল্প-উৎকর্ষের আলোচনায় সত্যজিৎ বলেন, যে দেশে শিক্ষার প্রসার এতই সীমাবদ্ধ, সে দেশে শিল্পের সমঝদার যে সংখ্যায় কম হবে তাতে আর আশ্চর্যের কী? শিল্পের সঙ্গে জনপ্রিয়তার চমৎকার সমন্বয় দেখা যায় চার্লি চ্যাপলিনের ছবিগুলোতে।

‘দু’টি সমস্যা’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ রায় প্রথম সমস্যা হিসেবে কাহিনী নির্বাচনের পথে বাধা নিয়ে লিখেছেন। বলেছেন, সাবেক অভিনয়রীতি প্রায় লোপ পেয়ে যাচ্ছে, যার সূত্রপাত গিরিশ ঘোষের আমলে এবং পূর্ণবিকাশ শিশির ভাদুড়ির অভিনয়ে। সেই ধারার উল্লেখযোগ্য অভিনেতা ছিলেন শিশির ভাদুড়ি, নরেশ মিত্র, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, যোগেশ চৌধুরী। সেই ট্র্যাডিশনটাই উবে যেতে বসেছে। এ এক বিরাট ক্ষতি। জলসাঘরের বিশ্বম্ভর রায় বা দেবীর কালিকিঙ্কর শৌখিন অভিনেতা দিয়ে হয় না। ছবি বিশ্বাসকে চাই। জাঁদরেল জমিদার চরিত্র করার মতো অভিনেতা বাংলাদেশে আর নেই। তেমনি কমেডিতে তুলসী চক্রবর্তীর জায়গা নিতে পারে এমন কেউ বাংলায় নেই। তেমনি পথের পাঁচালিও সম্ভব না চুনিবালা ছাড়া।
দ্বিতীয় সমস্যা হিসেবে সত্যজিৎ চিত্রনির্মাণের পথে বাধার (সেইসঙ্গে কাহিনী নির্বাচনও) কথা বলেছেন। সত্যজিৎ রায় সমসাময়িক শহুরে সমস্যা নিয়ে ছবি তোলেন না এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, নাগরিক জীবনের ছবি তুলতে গেলে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে নগরের চেহারাটাকেও ছবিতে তুলে ধরতে হয়। কিন্তু তার পথে অনেক বাধা। চিড়িয়াখানা করতে গিয়ে যে ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়েছিল সেটির বিস্তারিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, আধুনিক নাগরিক জীবন নিয়ে সার্থক ছবি তোলা অসম্ভব। আবার বিপরীত চিত্র হিসেবে Champs-Elyseei শ্যুটিং এর উল্লেখ করেছেন তিনি।

‘পরিচালকের দৃষ্টিতে সমালোচক’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ লিখেন, পথের পাঁচালীই তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবি হলে সমালোচনার প্রভাব তাঁর শিল্পের পক্ষে কি কল্যাণকর হয়নি? তাঁর মতে, সমালোচনা তাঁর ছবির ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি বলেই তিনি মনে করেন। সমালোচক কাজের মতো কাজ করেন তখনই যখন তিনি পরিচালক ও দর্শকের মাঝখানে একটি সেতু স্থাপন করতে সক্ষম হন। শিল্প সৃষ্টির তাগিদে সাধারণ দর্শকের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে চলার অধিকার পরিচালকের আছে। তার বিচারের দায়িত্ব সমালোচকের। বিষয়বস্তুর পরিধি আজ এতই বিস্তৃত যে জয়েস এর ‘ফিনিগানস ওয়েক’ও আজ চিত্রে রূপায়িত। সমালোচকের দায়িত্ব তাই আজ দুরূহ।

‘অপুর সংসার’ প্রসঙ্গে প্রবন্ধে দেশ পত্রিকায় সমালোচক চন্দ্রশেখরের সমালোচনার জবাব দিয়েছেন সত্যজিৎ।
‘চারুলতা প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধে পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত রুদ্রমশাইয়ের সমালোচনার জবাব দিয়েছেন সত্যজিৎ। ‘চারুলতা’র অনুপুঙ্খ আলোচনার মাধ্যমে সাহিত্যের গল্প থেকে ছবি করার সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তিনি। এও বলেছেন, চিত্রনাট্য রচনাকালে মূল কাহিনীর নির্মম বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়।
‘ওরফে ইন্দির ঠাকুরণ’ প্রবন্ধে চুনীবালা দেবীর সন্ধান পাওয়া থেকে শুরু করে তাঁকে নিয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন সত্যজিৎ। বলেন, চুনীবালা দেবী কন্টিনিউইটির খুঁটিনাটি মনে রাখতেন। খুব আন্তরিক ছিলেন কাজে। বর্জনের সংকল্প হিসেবে সত্যজিৎ হরিধ্বনি বর্জন ও বুড়ির গানকে শবযাত্রার দৃশ্যে আবহসঙ্গীত হিসেবে ব্যবহার করার কথা উল্লেখ করেন।

‘দুই চরিত্র’ প্রবন্ধে বোড়ালের সুবোধ দা ও সর্বজয়ার জ্যাঠামশাই ভবতারণ চাটুজ্যের ভূমিকায় অপেশাদার অভিনেতা কাশীর রমণীরঞ্জন সেন মহাশয়কে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন সত্যজিৎ।

‘একথা সেকথা’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ আফসোস করে লিখেন, চুনীবালা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় বিভূতিভূষণের ছোটো গল্প ‘দ্রবময়ীর কাশীবাস’ আর করা হয়নি তাঁর। ‘অপরাজিত’ ছবির অপুর গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টারের ভূমিকায় অভিনেতা সুবোধ গাঙ্গুলী যুবা বয়সে নানান চিত্রগৃহে অপারেটরের কাজ করায় অভিজ্ঞ ছিলেন ও পরে নিউ থিয়েটার্সের রসায়নাগারের অধ্যক্ষ ছিলেন। ‘অপরাজিত’তেই আরেকটি ছোটো ভূমিকায়, পুরুতের ভূমিকায় অভিনয় করেন প্রৌঢ় কালী বন্দোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন কমিক অভিনেতা। সুবোধ গাঙুলী ও কাশীর শ্যুটিং এ কালী বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন সত্যজিৎ এ প্রবন্ধে। ‘অপরাজিত’র এক দৃশ্যে, পরে পোস্টমাস্টারে হারমোনিয়াম বেহালা তবলার সঙ্গে গ্রাম্যবৃদ্ধদের আড্ডায় গান গাইবেন এক চরিত্র। সেই অভিনেতা নিজেই বাঁধলেন গান আশাবরীতে কিন্তু কাহিনীর প্রয়োজনে করে নিলেন পূরবীতে এবং প্রায় পেশাদারী অভিনয় করলেন। সত্যজিৎ বলেন, আসলে যাকে দিয়ে যে কাজটি স্বাভাবিকভাবে হয়, ক্যামেরার সামনে তাকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারলেই সে কাজ উচ্চশ্রেণীর অভিনয়ের পর্যায়ে পড়ে যায়। আমাদের দেশের ছবিতে অনেক দুর্বল অভিনয়ের কারণ হচ্ছে এই যে, যাকে দিয়ে যে কাজ হয় না তাকে দিয়ে ঠিক সেইটেই করিয়ে নেবার চেষ্টা। ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে ‘জলসাঘরে’র শ্যুটিং চলাকালে মজার অভিজ্ঞতাও লিখেছেন সত্যজিৎ এই প্রবন্ধে।

‘বিনোদ-দা’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ লিখেন, কমার্শিয়াল আর্ট শিখতে গেলে ওরিয়েন্টাল আর্টও জানা চাই। তাই তিনি কলেজের পর শান্তিনিকেতনে পড়েন। আশ্রমে পৌঁছেই শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ছবি চোখে পড়ে তাঁর। আড়াই বছর শান্তিনিকেতনে থেকে বিনোদবিহারীর শিল্পকর্ম ও চিন্তাধারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সুযোগ হয় তাঁর। বিনোদবিহারীর আঁকা ভারতের মধ্যযুগের সাধুসন্তদের জীবনকে কেন্দ্র করে হিন্দি ভবনের তিনটি দেয়ালে মিউরাল সম্পর্কে সত্যজিৎ বলেন, “বর্তমান শতাব্দীতে আমাদের দেশে এর চেয়ে মহৎ ও সার্থক কোনো শিল্পকীর্তি রচিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই।” বিনোদবিহারী সত্যজিৎকে বলেন, “আলতামিরার ঘোড়া দেখো।

গুহার মানুষকে তো আর আজকের হিসেবে সোফিস্টিকেটেড বলা যায় না। কিন্তু বুনো লোকেরাও পাথরের এমন ঘোড়া এঁকেছে যার কাছে চীনে ঘোড়া হার মেনে যায়। মানুষের এই স্বাভাবিক ক্ষমতাটা ক্রমে লোপ পেয়ে যাচ্ছে। তোমার ফিল্মে খোয়াই দেখাবে তো? খোয়াই বাদ দিও না। খোয়াই, আর তাতে একটি সলিটারি তালগাছ। ব্যস। আমার স্পিরিট, আমার জীবনের মূল ব্যাপারটা যদি কোথাও পেতে হয়, ওতেই পাবে – ওটাই আমি।”
শেষ প্রবন্ধ ‘শতাব্দীর সিকি ভাগে’ আছে সত্যজিৎ রায় নির্মিত চলচ্চিত্রের রেট্রোস্পেক্টিভ। তিনি বলেন, পথের পাঁচালীর প্রধান গুণ ছিল সরলতা। সত্যি বলতে শুধু হৃদয়ের ওপর প্রভাব দিয়েই যদি ছবির উৎকর্ষের বিচার হতো, তাহলে পথের পাঁচালী অবশ্যই হতো এই ২৫ বছরে তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবি। কিন্তু ছবির বিচার শুধু এই একটি গুণের ওপর হয় না। পথের পাঁচালীর কিছু চিত্রভাষাগত দুর্বলতা সহ অনভিজ্ঞতার কথাও লিখেছেন সত্যজিৎ। তবে তিনি সচেতনভাবে চেষ্টা করেছেন ছবির সবচেয়ে স্মরণিয় মুহূর্তগুলিতে সংলাপ যথাসম্ভব কম ব্যবহার করতে।

সত্যজিৎ রায়ের স্বরচিত কাহিনী ও স্বরচিত সংলাপ প্রথম দেখা যায় ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য়। এই চলচ্চিত্রে কেন্দ্রস্থ চরিত্র হিসেবে একটি গোটা পরিবারকে দর্শক গ্রহণ করেনি। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘার কাঠামো ছিল একেবারেই চলচ্চিত্রের কাঠামো, যেটা এর আগের কোনো ছবি সম্বন্ধেই বলা চলে না।

সত্যজিৎ বলেন, ‘চারুলতা’তে তাঁর মতে তাঁর প্রথম ১০-১২ বছরের কাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে। ৪টি চরিত্র নিয়ে ৫/৭ মিনিটের একটি দৃশ্যে বিপরীত রসের সমাবেশ এর আগের বা পরের কোনো ছবিতেই নেই।

চলচ্চিত্রে সোজাসুজি বললে বক্তব্য অনেক সময় মোটেই জোরদার হয় না। তাই ‘চারুলতা’র শেষ দৃশ্যে ‘না থাক’ বলার বদলে স্বামী-স্ত্রী হাতে হাত না-মেলার ফ্রিজ শট ব্যবহার করা হয়েছে। বক্তব্য সরাসরি কথায় না বলে আকারে ইঙ্গিতে বলার উদাহরণ – ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র মেমোরি গেম খেলার দৃশ্য। খেলাচ্ছলে চরিত্র উদঘাটোনের দৃশ্য সত্যজিতের খুব প্রিয়। এটা বিনা অনুশীলনে লভ্য নয়। চিত্রভাষার দিক দিয়ে সত্যজিতের মতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি, যদিও এ ছবি এদেশে বিশেষ সমাদর পায়নি।
সত্যজিৎ সবশেষে বলেন, অন্য শিল্পের মতোই চলচ্চিত্রে শেখার কোনো শেষ নেই। নতুন জাতের কাহিনী হলেই তার জন্য নতুন আঙ্গিকের, নতুন চিত্রভাষার প্রয়োজন হবে। সে ভাষা যদি তৈরি না থাকে তো তাকে গড়ে নিতে হবে পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।
সত্যজিৎ রায়ের প্রথম প্রবন্ধ সংকলন ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ নিয়ে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বইটির প্রতিটি সংস্করণের প্রচ্ছদ, বইটিতে স্থান পাওয়া সত্যজিৎ রায়ের আঁকা স্কেচ, প্রবন্ধগুলোর প্রথম ছাপা কাগজ, প্রাসঙ্গিক চলচ্চিত্রের খণ্ডাংশের ভিডিওক্লিপ ও স্টিল ছবি আসরে প্রদর্শিত হয়।

আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল অধ্যায়ের নাম সত্যজিৎ রায়। তাঁর জন্মশতবর্ষে নিবেদিত পাঠশালার আসরে আলোচক দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের স্বতঃস্ফূর্ত ও গভীর আলোচনা দর্শক-শ্রোতারা উপভোগ করেন। এই আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।