জ্য লুক গদার

গত ১১ই নভেম্বর, শুক্রবার, টরন্টো ফিল্ম ফোরামের ৩০০০ ড্যানফোর্থ এভিনিউ’র মাল্টিকালচারাল ফিল্ম স্ক্রীনিং সেন্টারে বিশ্বখ্যাত ফরাসী-সুইস চলচ্চিত্র নির্মাতা জ্য লুক গদার রেট্রোস্পেক্টিভ এর শেষ দিনে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে ২০১৮ সালে নির্মিত গদারের শেষ চলচ্চিত্র ‘দ্য ইমেজ বুক’ প্রদর্শিত হয়। গদারের জীবন ও কর্ম এবং ‘দ্য ইমেজ বুক’ চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন টরন্টো ফিল্ম ফোরামের সভাপতি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা এনায়েত করিম বাবুল।
‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য এনায়েত করিম বাবুলের মূল আলোচনাটি প্রকাশিত হলো ।

আজ আমাদের নির্বাচিত জা লুক গদারের চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর শেষ দিন। শুরতেই মাস্টার চলচ্চিত্র নির্মাতা জা লুক গদারের প্রতি টরন্টো ফিল্ম ফোরামের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।
এই বরেণ্য নির্মাতার নাম প্রথমে শুনেছিলাম আমার চলচ্চিত্র শিক্ষক ও পরিচালক আলমগীর কবিররের কাছে সেই আশির দশকের শুরুর দিকে।
সিনেমার ইতিহাস পরাতেন তিনি।

ফ্রান্সের বিখ্যাত ক্যায়েদু সিনেমার সিনেমার সম্পাদক আন্দ্রে বাঁজা। এই পত্রিকায় সিনেমা নিয়ে লিখতেন তরুণ গদার ও তার বন্ধুরা। আন্দ্রে বাঁজার খুব ভক্ত ছিলেন কবির ভাই। ছাত্র থেকে কবির ভাইয়ের সহকারী পরিচালক এবং সিনেমার বিভিন্ন কাজের সাথে জড়িত ছিলাম।
গদার, ত্রুফু, শ্যাবলরাদের মত আমরারও ৮০র দশকে বাংলাদেশে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করে ছিলাম।

গদার ও তার বন্ধুরা প্রথমে শর্ট ফিল্ম দিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলেন। নির্মাণ করতে করতে প্রটি মুহূর্তে নিজেকে ভেঙ্গেছেন, গড়েছেন, বাক বদল করছেন।
পরিবর্তন করতে করতে প্রশ্ন করেছেন নিজেকে দর্শককে। সিনামার ভাষা তৈরি করেছেন। চিত্রগ্রহণে এনেছেন নতুন প্লাবন। ক্যামেরা হাতে তুলে নিয়েছেন।
কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সম্পাদনার ট্রেডিশনাল ধারার বৈপ্লবিক পরিবর্তন করেছে। গ্রামার ভেঙ্গে গ্রামার তৈরি করেছে। বিখ্যাত জাম কাট।
চালু করেছে অতর সিনেমার থিউরি।
একটার পর একটা সিনেমা নির্মাণ করে পরিচালকদের পরিচালক হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। মৃত্যু ও ছিল তার পরিকল্পনার মধ্যে। তিনি মনে করেছেন তার আর সৃষ্টিশীল কাজ শেষ হয়েছে। আর দেবার কিছু নেই।

এনায়েত করিম বাবুল

৯১ বছর বয়সে গত সেপ্টেম্বর ১৩ ২০২২ সুইজারলেন্ড এর রোল শহরে স্বেচ্ছা মৃত্যু বরণ করেন তিনি। একটি অদ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।
জীবনের শেষ সায়াহ্নে, জা লুক গদার ৮৮ বছর বয়সে দি ইমেজ বুক সিনেমাটি নির্মাণ করেন। ২০১৮-তে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে প্রিমিয়ার শো হয়। উত্সবের সেরা পুরস্কার পাম ডু এওয়ার্ড লাভ করেন।
কানের জুরি কমেন্ট করেছিলো – ইট ইজ বম শিল্ড, ডিফারেন্ট, ইউনিক এবং চ্যালেঞ্জিং। টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিবলের সিও পিয়ার হ্যান্ডেলিঙ্গ ২০১৮ ইমেজ বুকের শোতে সূচনা বক্তব্যে বলেছিলেন, আমার বয়স তখন ১৯ আমি তখন গর্বিত ইতিহাসের ছাত্র। যা লুক গদারের উইকেন্ড এবং পিয়ারে লাফো আমার জীবন পাল্টে দিয়েছিলো,
সেই থেকে ফিল্মের ছাত্র হয়ে গেলাম। আজ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিন আমার লং জার্নির শেষ সময়। টিফের সিও থেকে অবসরে যাবার প্রাক্কালে প্রিয় যা লুক গদারের নূতন সিনেমা দি ইমেজ বুক দেখাতে পেরে আনন্দিত।

হল ভর্তি দর্শকদের সামনে ইমেজ বুকের চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক ও প্রডিউসার সুইডিস পরিচালক ফেব্রিস আরেগনোকে মঞ্চে আমন্ত্রণ জানান।
আমি এই প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলাম। ফেব্রিস আরেগনোর ইংরেজিতে মনের ভাব শিল্প ভাবনা সঠিকভাবে প্রকাশ করতে কষ্ট হচ্ছিলো।
২০০২ সাল থেকে গদারের সিনেমার সাথে কাজ কছিলেন। কখনো চিত্রগ্রহণ বা সম্পাদনা বা সাউন্ড। ইমেজ বুক সম্পাদনা টেবিলে মাঝ পথে থেমে যায়। প্রযোজক অর্থ দিচ্ছে না। সেই সময়ে ফেব্রিস আরেনগো নিজেই প্রডিউসারের দায়িত্ব কাঁধে নেন।
“আমরা প্রতি মঙ্গলবারে মিলিত হতাম। গদার নিজেই ৮০র দশকের ম্যানুয়াল ভিডিও মেশিন দিয়ে এডিটিং শুরু করে। প্লে এবং রেকর্ড ম্যানুয়ালি ব্যাবহার করতাম। সে ইচ্ছে করে সাবটাইটেলে সব বাক্য অনুবাদ করেনি।

সম্পাদনা টেবিলে জ্য লুক গদার

পরের দিকে আমরা একটানা শুটিং করেছি।
কানের সিনেমা হলে বড় স্পিকার লাগিয়ে ২০০ বছরের ইতিহাস, সিনেমার ইতিহাস এবং পুরনো সিনেমা ভিডিওতে রেকর্ড করেছি।
ভি এইচ এস ইমেজ, ইন্সট্যাঁলেশন। ফাইনালি ৭.১ সাউন্ড।
তারপর কয়েকটি টিভিতে একসাথে চলছে নিউজ, সিনেমা, বিনোদন ও প্রামাণ্য চিত্র। ফিল্ম ম্যাকারের ধারা বর্ণনা। অনেক ইমেজ কোয়ালিটি ভালো নয়, কিন্তু গদার ইচ্ছে করে রেখে দিয়েছে।
এইভাবে ফিল্মটি নির্মিত হয়।
দি ইমেজ বুক…..
আমাদের চির চেনা মুষ্টিবদ্ধ হাতের ঊর্ধ্বমুখী আঙ্গুল।
যে আঙ্গুলের নিশানা একটি দেশকে, একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো।
স্বাধীনতা পেয়েছিলাম।
সেই ছবিটি ইমেজটি সিনেমাটি দেখতে গিয়ে মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে।
এ যেন গদারের মুষ্টিবদ্ধ হাত। ক্লোজআপে ঊর্ধ্বমুখী আঙ্গুল। নিস্তব্দ লেখা। দুটি হাত ফিল্ম জোরা দিচ্ছে।

সিনেমার সর্বশেষ এডিটিং বা সম্পাদনার টেবিলে স্টিনব্যাক। পাঁচটি আঙ্গুল ব্যাবহার করে সুনিপুণভাবে বুনে তুলে একটার পর একটা ফিল্মের ফ্রেম।
নির্মাণ হয় দৃশ্য মালা। তারপর পাঁচটি আঙ্গুলের ক্লোজআপ। হাত থেকে লেখা, লেখা থেকে পেইন্টিং এবং ইমেজ। ফিল্ম স্ট্রিপ থেকে রঙের খেলায় ঘর বাড়ি সড়ক। ইমেজ এবং শব্দের মিলনে গদারের ইমেজ বুক এগিয়ে চলে। ইমেজ বুক জা লুক গদারের আত্মকথন। ইমেজ, সিনেমা, সাউন্ড, ধারা বর্ণনার সংমিশ্রণ। বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যত এই সিনেমার মুখ্য বিষয়। পাচ আঙ্গুলের পাঁচটি পর্বে ইমেজ বুক নির্মিত।
ক্যামেরা লাইট সাউন্ড এবং কথায় প্রথম চ্যাপ্টার শুরু হয় সুস্বপ্ন দিয়ে।
সিনেমার ইতিহাস, সমসাময়িক বিশ্বের রাজনীতি, হত্যা, লুণ্ঠন, যুদ্ধ, সকল বিষয়ে গদার ইঙ্গিত করে গেছে। প্রশ্ন করেছে। খুঁজে বেরিয়েছে।
হলকাস্ট, বোমা হামলা, প্যালেস্টাইন-ইসরাইল লড়াই এবং আরবের কু-রাজনীতি ইমেজ বুকে গদারের দৃষ্টিতে বিদ্যমান।

ফেব্রিস আরেনগো এবং পিয়ার হেন্ডেলিঙ্গ

ইজিপ্ট এঁর একটি উপন্যাস থেকে একটি অংশ নিয়েছেন। ডোফা এবং তারেক দুটি আরব এলাকার ঘটনা ব্যাবহার করেছেন।
সেই সময় অন্য লাইন খবর বেরিছিলো, গদার তিউনিসিয়া এবং আরব এলাকায় গদার শুটিং করছেন। নায়ক-নায়িকা বা চরিত্র নেই। কৌতূহলি সেই সিনেমাটি ইমেজ বুক।
বর্তমান ও পরের শতাব্দীর দুঃস্বপ্ন সিনেমার স্মৃতি বিচ্ছিন্ন চিত্রমালা ও বিশ্ব নিয়ে গদারের ভাবনা এই সিনেমার বিষয়।
রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের সমলোচনা করেছেন। আবার আশার কথা বলেছে।
নির্মাণ শৈলী খুবই নিরিক্ষাদরমী, উচ্চ মার্গের এবং কঠিন কাঠামো। বুঝতে কষ্ট লাগলেও গদারের সিনেমা দেখে অভ্যস্ত থাকলে হৃদয়ে অনুভব করা যায়। সমুদ্রের জল কখনো হয়ে ওঠে পিকাসোর পেইন্টিং। ফিল্মের নেগেটিভ, পজেতিভ ইমেজ ব্যাবহার করেছে। কোথাও মেটাফোর এসেছে।

গদারের দৃষ্টিতে প্রকৃতি দেখেছি। সুরিয়াল শট দেখেছি। সুনিপন আলোর ব্যাবহার দেখেছি। মানুষের স্বপ্নের কথা বলেছে। মানুষের কল্যাণে বিপ্লবের ডাক দিয়ে সিনেমা সমাপ্ত করেছেন। জা কুক গদারের সর্বশেষ কাজ। তার আত্ম কথন। ভাবনা। আশাকরি আমাদের ও ভাবিয়ে তুলবেন। মনে প্রশ্ন আসবে।
গদার উত্তর খোজার চেষ্টা করেছেন আমরাও করবো।