Home কলাম জ্যাক লেটন এর নেতৃত্বে এনডিপি নির্বাচন ইতিহাসে সবচেয়ে ভাল ফল করেছিল

জ্যাক লেটন এর নেতৃত্বে এনডিপি নির্বাচন ইতিহাসে সবচেয়ে ভাল ফল করেছিল

মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

পঁয়ষট্টি.
আমাদের পার্টির সফল কনভেনশনের পর এনডিপি’রা তাদের পার্টির সঠিক দিক নির্দেশনা ঠিক করার জন্য টরন্টোতে জমায়েত হয়েছিল। সে সময় সবচেয়ে কঠিন যে কাজ তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, তা হচ্ছে জ্যাক লেটন এর একজন যোগ্য উত্তরসূরী খুঁজে বের করা। ২০০৩ সালে এনডিপি’র নেতৃত্বে আসা জ্যাক লেটন ২০১১ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন। ২০০৪ সালে তাঁর নেতৃত্বে এনডিপি দ্বিগুণ ভোট পেয়েছিল। তারপর, পরের নির্বাচনগুলোতে তাঁর নেতৃত্বে এনডিপি বেশি থেকে আরও বেশি ভোট পেতে শুরু করে। ২০০৬ সালের ফেডারেল নির্বাচনে এনডিপি পায় ২৯টি আসন, আর ২০১৮ সালে পায় ৩৭টি। এনডিপি’র এই অগ্রগতি চরমে গিয়ে পৌঁছে ২০১১ সালের ফেডারেল নির্বাচনে, যখন এনডিপি ১০৩টি আসন পেয়ে পার্লামেন্ট এ বিরোধী দলের আসনে বসে। জ্যাক লেটন এনডিপি পার্টিকে এমন এক জায়গায় দাঁড় করিয়েছিলেন যে, তাঁর নেতৃত্বে এনডিপি নিজের নির্বাচন ইতিহাসে সবচেয়ে ভাল ফল করেছিল। অনেক পরিশ্রম আর দক্ষতায় পার্টিকে এমন এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে আকস্মিকভাবে জ্যাক লেটন মারা যান। তাঁর এই আকস্মিক মৃত্যুর পর এনডিপি’র কাঁধে প্রথম কাজটি এসে পড়ে তাদের পক্ষ থেকে পার্লামেন্টে এমন এক বিরোধী দলীয় নেতা মনোনীত করা যিনি পরবর্তীতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সব ক্ষমতা রাখেন। আমি কিন্তু সব সময়ই পার্টির ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি চিন্তা আর পরিকল্পনা করতে ভালবাসি। সেখানে ব্যক্তি বিষয়টা খুব বেশি একটা প্রাধাণ্য পায় না, তবে আমি এমন এক ব্যক্তিকে সব সময় প্রত্যাশা করি যিনি সমষ্টির শক্তি হিসেবে কাজ করেন।

সেই সময় বেশ কিছু অতি উৎসূক মহল আলোচনা শুরু করেছিল, আমাদের লিবারেল পার্টির উচিৎ হবে এনডিপি’র সাথে এক হয়ে যাওয়া। এমনকি উভয় দলেরই কিছু প্রাক্তন নেতা গণমাধ্যমে খোলাখুলিভাবেই এ ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেছিল। বেশ কিছু কারণে, আমি এই বিষয়টা নিয়ে পরবর্তীতে বিশদভাবে আলোচনা করব। এ ব্যাপারটা যে সম্ভব নয় তা আমি জানতাম, কিন্তু তারপরও সেই সময় এ ব্যাপারটা নিয়ে আমি চোখ কান খোলা রেখে সব কিছুর ওপর লক্ষ্য রেখে যাচ্ছিলাম। এ বিষয়টা নিয়ে বেশ কয়েক জন এনডিপি নেতা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল, এদের মধ্য বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে নাথান কুলেন এর নাম। সে লিবারেল পার্টির সাথে যৌথভাবে নির্বাচন করার জন্য সবাইকে জানিয়ে শুনিয়েই প্রচারণায় নেমেছিল। আমি নাথান’কে পছন্দ ও শ্রদ্ধা দুটোই করি, এবং সে সময় তার এই প্রচারণা কোন দিকে যায়, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষাও করেছিলাম।

আমার অনেক বন্ধু ছিল, যারা এক সময় এনডিপি’র পক্ষে ভোট দিয়েছিল। পার্টি’টা যেভাবে গড়ে উঠেছে এবং ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে, সেটাকে আমি সব সময় শ্রদ্ধার চোখে দেখি, সেই সাথে বিগত বছরগুলোতে এনডিপি কানাডার জন জীবনে যে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে, সেটাকেও আমি শ্রদ্ধা করি। তবে সেই সময় এনডিপি’র সদস্যদের সামনে এক চরম সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসেছিল, তারা কি তাদের শিকড়ের সাথে থাকবে, না সেটা থেকে সরে গিয়ে ক্ষমতার স্বাদ নেবার জন্য অন্য আরেকটি দলের সাথে মিলেমিশে একেকার হয়ে যাবে। সহজ কথায় বলতে গেলে বলতে হয়ে, দ্রæত ক্ষমতায় যাবার জন্য তারা কি তাদের আদর্শকে বিসর্জন দিবে, না ধীরে ধীরে নিজেদেরকে আরো শক্তিশালী করে নিজেদের আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সামনে এগিয়ে যাবে? আমার তখন মনে হয়েছিল, তাদের জন্য সেই সময় প্রধান করণীয় বিষয় ছিল, তাদের মধ্য থেকে এমন এক নেতাকে খুঁজে বের করা যিনি স্টিফেন হার্পারে সামনে দাঁড়ানোর সব যোগ্যতা ও ক্ষমতা রাখেন।

 

টরন্টোর ‘জ্যাক লেটন ফেরী টার্মিনাল’ এ সাইক্লিস্টরূপে জ্যাক লেটনের মূর্তি

তারা স্টিফেন হার্পার আর কনজারভেটিভদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে যে আগ্রহ আর যুক্তি নিয়ে এগুচ্ছিল, আমার মনে হয়েছিল, সেখানে তারা দেশের সার্বিক মঙ্গলের বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, কানাডার উন্নয়ন মূলত নির্ভর করে কিভাবে আমরা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগাচ্ছি এবং বাইরের বাজারে সেটা রপ্তানি করছি।
আমাদের দেশের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীই এটাকে সমর্থন করবেন। তাহলে বর্তমানে আমাদের মেনে নিতে হবে, পরিবেশকে ঠিক রেখেই আমাদেরকে এই কাজটা করতে হবে। কিন্তু কেউই এ ব্যাপারে কথা বলে না যে, পশ্চিম কানাডার প্রাকৃতিক সম্পদ হচ্ছে সহজ ভাষায় ‘ডাচ ডিজিজ’ যেটা অর্থনীতির অন্য সব ক্ষেত্রে এক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আমার বাবার নেতৃত্ব থেকে আমার পার্টি এক কঠিন বেদনাদায়ক শিক্ষা গ্রহণ করেছে। পশ্চিমের ধন সম্পদ দিয়ে পূর্বের ভোট পাওয়ার যে কৌশল নেয়া হয়, সেটা কিন্তু কানাডার জনগণকেই আরো দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়া হয়।

সেই সাথে আরেকটি ব্যাপারে এনডিপি’র প্রতি আমার প্রত্যাশাটা কিছুটা হতাশাজনক হয়েছিল, আর সেটা হচ্ছে, আমার নিজ প্রভিন্স কুইবেকের সার্বভৌমত্ববাদীদের সাথে তাদের মাখামাখি। এই ধরনের কৌশল কিন্তু কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী মুলরোনীর সময় বেশ বিভাজন ও একে অপরের প্রতি বিদ্বেষের পরিবেশ তৈরী করেছিল, এবং সেটা দেশকে কোন এক বিপর্যয়ের মধ্য ঠেলে দিচ্ছিল সেটা আমি আর উল্লেখ করছি না। কানাডার সংবিধান কিন্তু ছেলের হাতের মোয়া নয়, এমনকি এর ‘ক্লারিটি এক্ট’কেও কোনভাবে হালকাভাবে নেয়া যাবে না। প্রথমটি আমাদের জন্য এমন এক ক্ষেত্র তৈরী করে দিয়েছে যার ওপর ভিত্তি করে আমরা সবাই মিলে একটি দেশ গড়ে তুলেছি, আর কানাডার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারা প্রবর্তিত দ্বিতীয়টি কিছু শর্ত বেঁধে দিয়েছে যার সাহায্যে আমরা কিছু রদ করতে পারি। এই বিষয়গুলো কিন্তু খুবই গুরুত্ব বহন করে। এগুলো একেবারে মৌলিক প্রশ্ন, এবং কোনভাবেই এগুলোকে খাটো করার কিছু নেই। সংবিধান ও ‘ক্লারিটি এক্ট’ নিয়ে এনডিপি যে সাংঘর্ষিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেড়াচ্ছিল, সেটা কিন্তু ছিল খুবই বিপদজনক একটা ব্যাপার। তাদের প্রতিশ্রুতিটা সেই সব রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতির সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যারা সব সময় অজস্র প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান, কিন্তু কখনও সেই সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করার চিন্তা করে না।
রাজনীতিতে একটা প্রবাদ আছে, তুমি যদি সত্যিই কোন নতুন সরকার গঠনের কথা বল, তবে নিশ্চয় তোমাকে তার পূর্ণ রূপরেখা দিতে হবে, শুধু মাত্র অস্পষ্ট বক্তব্য আর লম্ফঝম্ফ করলে কিছু হবে না। আমি যেহেতু দেখেছিলাম, তাদের কনভেনশন কোন রকম ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে, তখন আমি আর না ভেবে পারছিলাম না যে, মি. হার্পার নিউ ডেমোক্র্যাটদের গরু বানিয়ে ছেড়েছে। আর সেটা তারা তেমনভাবে ধরতেই পারেনি, বরং কিছু না বুঝে নিজেদের কর্মপ্রক্রিয়াকে সফল ভেবে তারা তখন তৃপ্তির ঠেকুর তুলছিল। আমার মনে হয়েছিল, কনজারভেটিভদেরকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করার জন্য তারা তাদের ছায়া-ইমেজ তৈরীতেই ব্যস্ত ছিল, বস্তুনিষ্ঠভাবে লড়াইয়ের ধারে কাছে তারা ছিল না।

২০০৬ সালে টরন্টোতে নির্বাচনী প্রচারণায় জ্যাক লেটন

আমার হয়তো ভুল হতে পারে, কিন্তু আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, কানাডার মানুষ কখনও এ ধরনের রাজনীতি চায় না। আর আমি সত্যিই অনুভব করি, কানাডার জনগণের এ ধরনের রাজনীতির কোন প্রয়োজনও নেই।
তখনকার এমন সব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমার মনেই হয়েছিল, ভবিষ্যতে আমাকে নেতৃত্বের দিকে যেতে হবে এবং আমার এই নেতৃত্বের দিকে যাওয়ার অনেকগুলো ইতিবাচক কারণও ছিল। আমার একটা উপলব্ধিবোধ ছিল, আমি দেশের সেবা করবো। আমার বেড়ে উঠাতে আমি যে জ্ঞান ও মূল্যবোধ অর্জন করেছি, তাতে ছোটবেলা থেকে আমার ভিতরে সেই চিন্তাটা ঢুকে গেছে, আমাকে দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে হবে। আমি বাবা হবার পর আমার মধ্যে এই চিন্তাটা আরো তীব্রতর হচ্ছিল এবং এমন এক অনুভূতিবোধ কাজ করছিল যে, যেভাবেই হোক বা যত কষ্ট করেই হোক আমার সন্তানদের জন্য আমার এই ভূমিকে আরো বেশী সুন্দর ও বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। আমাদের বাবা-মা’দের কাছ থেকে আমরা যে দেশ পেয়েছি, সেই দেশকে আমাদের আগামী প্রজন্ম’র জন্য আরো বেশী শক্তিশালী করে তুলতে হবে। আস্তে আস্তে আমি অনুভব করতে লাগলাম, লিবারেল পার্টি শেষ পর্যন্ত আবার সেই পথে এগুচ্ছে, যা আমরা সব সময় প্রত্যাশা করে এসেছি। আমার তখন এটাও মনে হয়েছিল, লিবারেল পার্টি এবার কানাডার জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হবে। আমি নিজেই দুটো সফল নির্বাচনে অংশ নিয়েছি, এবং দুইবারই আমার বিপক্ষে ছিল খুবই শক্তিশালী দুই প্রতিদ্ব›িদ্ব। কিন্তু দুবারই আমি মানুষের ভালবাসা আর আস্থায় জিতেছি। আমার এই দুইবারের বিজয় আমার ভিতর প্রতক্ষ্যভাবে দেশ সেবা করার এক ক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল। সেই সাথে এই দুটো নির্বাচন করতে গিয়ে রাজনীতির অনেক সু² সু² বিষয় আমি শিখেছি। আমার চলার পথে এই সমস্ত বিষয় আমকে বারবার অনুপ্রাণিত করেছে। এই সব বিষয়গুলো ভেবে আর আগাগোড়া বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছিল, এবার আমি নেতৃত্বের পথে এগুতে পারি। আমার তখন প্রবলভাবেই মনে হচ্ছিল, আমি যেমন কানাডা দেখতে চাই, সে কানাডার জন্য আমার নেতৃত্বে যাওয়া খুবই বেশী প্রয়োজন। তবে সেই সময়, এত সব বিষয়ের পরও আরেকটি বিষয় আমার এই চিন্তাকে আরও বেশি গতিময় করে তুলছিল। (চলবে)

Exit mobile version