মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিত্সু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।

আট.
১৯৩১ সালে রেনোয়া তাঁর জীবনের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘অঁ পার্জ বে বে’ নির্মাণ করেন। ছবিটি ছিল হাল্কা কমিডি ধাঁচের। তবে চলচ্চিত্রের আঙ্গিকে শব্দ ও ধ্বনি ব্যবহারের ক্ষেত্রে রেনোয়া তাঁর প্রথম সবাক চলচ্চিত্রে খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারেননি। তবে রেনোয়ার প্রথম জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবি ‘লা শিয়েন’ তৈরি হয় ১৯৩১ সালে। শিল্পগুণান্বিত এবং জটিল গঠনরীতির এই ছবিটি কেবল একটি সার্থক চলচ্চিত্রই নয়, ব্যক্তিগতভাবে রেনোয়ার কাছে ছবিটি ছিল খুবই বেশি প্রিয়। কারণ তাঁর শেষ জীবনে তাঁকে তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলোর নাম বলতে বলা হলে তিনি প্রথমেই ‘লা শিয়েন’ এর কথা উচ্চারণ করতেন। ছবিটির কাহিনীতে দেখা যায় মরিশ লেগ্রাঁদ নামে একজন মধ্যবয়সী ব্যাংকের কেরাণী তার দাম্পত্য জীবনে অত্যন্ত অসুখী। তার দজ্জাল স্ত্রী তাকে কেবলই তার প্রাক্তন নাবিক স্বামীর কথা বলে যে ডুবে মারা যাবার পর মহিলাটি লেগ্রাঁদকে বিয়ে করেছিল। লেগ্রাঁদ স্ত্রীর গঞ্জনার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তার অবসর সময়ে ছবি আঁকত। স্বামীর ছবি আঁকানো তার স্ত্রী সহজভাবে নিতে পারতো না। ফলে স্বামীটি স্ত্রীর কাছ থেকে প্রাণপণে মুক্তি চাইছিল। হঠাত একদিন একটি রাতে সে বাড়ি ফিরছিল, তখন রাস্তায় দেখতে পেল একজন মহিলাকে এক পুরুষ মারধর ও অপমান করছে। লেগ্রাঁদ মহিলাটিকে উদ্ধার করে তার ফ্যাটে পৌঁছে দেয়। লুলু নামের সেই মেয়েটির সাথে ধীরে ধীরে লেগ্রাঁদের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে জানত না যে লুলু হচেছ একজন পেশাদার বারবনিতা আর সেদিন রাতে পথের ওপর লুলুকে যে মারছিল সে ছিল লুলুরই সাগরেদ। খদ্দের ধরার সেটা ছিল এক কৌশল। সাগরেদ এর নাম ছিল দেদে। লেগ্রাঁদ ধীরে ধীরে লুলুর প্রেমে এত বেশি মজে যায় যে, তার আঁকা সব সুন্দর ছবিগুলো একটা একটা করে সে লুলুকে উপহার দিতে থাকে এবং সেগুলো দেদে বিক্রি করে ভালো পয়সা কামাতে থাকে। দেদে শিল্পী মহলে লুলুকেই ছবিগুলোর চিত্রকর হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং লুলু লেগ্রাঁদকে বেশি বেশি করে ছবি আঁকিয়ে নিতে থাকে।

১৯৩১ সালে নির্মিত ‘লা শিয়েন’ হচ্ছে রেনোয়ার প্রথম জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবি

ইতোমধ্যে একদিন ক্যাফতে লেগ্রাঁদের সঙ্গে একজন নাবিকের পরিচয় হয়। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং দজ্জাল স্ত্রী থাকলে একজন জীবনে যে কত বেশি অসহায় হয়ে পড়ে সে বিষয়টি তাদের গল্পের অন্যতম বিষয়বস্তুতে পরিণত হতে থাকে। এক সময় নাবিকটি বলে ফেলে অতীতে সে তার দজ্জাল স্ত্রীর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য সে রটিয়ে দেয় সে জলে ডুবে মারা গেছে। কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলার পর লেগ্রাঁদ বুঝতে পারে এই নাবিকটিই হচ্ছে তার দজ্জাল স্ত্রীর প্রাক্তন স্বামী। লেগ্রাঁদ তখন মনে মনে পরিকল্পনা করে তার স্ত্রীর সাথে তার প্রাক্তন স্বামীর পরিচয় করিয়ে দিয়ে সে তার দজ্জাল স্ত্রীর হাত থেকে নিস্কৃতি নিবে এবং তার নতুন প্রেমিকা লুলুর সঙ্গে সে সংসার করবে। এ উদ্দেশ্যে লেগ্রাঁদ একদিন নাবিককে তার বাসায় তার সব ছবি দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। নাবিকের যেদিন আসার কথা সেদিন খোশ মেজাজে লেগ্রাঁদ স্ত্রীর অগোচরে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটি সুটকেসে গুছিয়ে রাখে। নাবিক যখন লেগ্রাঁদের ফাটে ঢুকে তখনই তার এক সময়ের বউকে দেখে আঁতকে ওঠে। আর লেগ্রাঁদ তখনই মুক্তি পাওয়ার আনন্দে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে পালিয়ে যায়। ইচ্ছে ছিল একেবারে লুলুর কাছে হাজির হয়ে লুলুকে বিয়ের প্রস্তাব দিবে। কিন্তু লুলুর ফাটে গিয়ে সে বিস্মিত হয়ে পড়ে, দেখে লুলু দেদের শয্যাসঙ্গিনী। অপ্রত্যাশিত আঘাতে সে স্তম্ভিত হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে পথে বেরিয়ে আসে। কিছুক্ষণ পর সে আবার লুলুর বাসায় ফিরে আসে। ইচ্ছে ছিল লুলুর অপরাধ মার্জনা করে সে তার সাথে পূর্বের সম্পর্ক চালিয়ে যাবে। কিন্তু লুলুর সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সামনে কুড়িয়ে পাওয়া একটি কাঁচি তুলে নিয়ে লুলুর গলায় বসিয়ে দেয়।

লুলুকে খুন করে সে ধীরে ধীরে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সবার অলক্ষ্যে সেখানে থেকে পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর দেদে ফাটে ফিরে এসে দেখে লুলু খুন হয়ে পড়ে আছে। অপ্রত্যাশিত এই খুন দেখে সে ভয়ে সেখান থেকে সটকে পড়তে যায় কিন্তু লোকজন তাকে দেখে ফেলে এবং ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। অবশেষে বিচারে দেদের ফাঁসি হয়।

১৯৩৫ সালে নির্মিত ‘তোনি’ চলচ্চিত্রকে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালীয় চলচ্চিত্রের নব্য বাস্তবতা বা ‘নিও রিয়ালিজম’-এর অগ্রদূত

নিরাপরাধ দেদের বিচার চলার সময় লেগ্রাঁদ বিচরালয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে নিস্পৃহ ভঙ্গীতে বিচারের দৃশ্য দেখতে থাকে। দেদের ফাঁসি হয়ে যাবার পর লেগ্রাঁদ পথে পথে বাউন্ডুলের মত জীবন কাটাতে থাকে। একদিন দেখা গেল, এক ছবির দোকানের জানালার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে সে নিজেরই আঁকা একটি ছবি দেখছে। লেগ্রাঁদ দেখতে পেল তারই আঁকা একটি ছবি চড়া দামে বিক্রী হল। কিন্তু সে তখন একবোরে নিরাসক্ত। ছবির ক্রেতাটি বের হয়ে আসার পর লেগ্রাঁদ সেই ভদ্রলোকের গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে সামান্য কয়েক টাকা বকশিস পেল। তারপর গাড়িটি ধীরে ধীরে তার চোখের সামনে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পরে আর একটি ভবঘুরে প্রকৃতির লোকের সাথে লেগ্রাঁদের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল। দু’জনের কথাবার্তায় বোঝা গেল যে দু’জনেই অতীতে কিছু না কিছু ভয়াবহ কাজ করেছে। লেগ্রাঁদ এক সময় তার কাছে স্বীকার করে ফেলল, সে একটি খুন করেছে। অপর ভবঘুরেটি জবাবে শুধু বলল, সব রকমের মানুষকে নিয়েই তো আমাদের জগত-এই কথাটি উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই ছবির সমাপ্তি ঘটে।

যুগপথ বিষন্ন ও কৌতুকরসে মিশ্রিত এই ছবিটির ওপরে চার্লি চ্যাপলিন এবং এরথি স্টোনহাইম দুজনেরই বেশ কিছুটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। স্বয়ং রেনোয়া নিজে তাঁর এই ছবিটির জন্য তাঁর এই দু’জন পূর্বসূরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এবং ঋণ স্বীকার করেছেন। ফরাসী মধ্যবিত্ত সমাজের ভন্ডামী ও কপট আচরণ ছবিটিতে খুবই তী²ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘লা শিয়েন’ সব দিক একটি সফল ছবি হওয়ায় পরবর্তীকালে হলিউডের পরিচালক ফ্রিজ ল্যাঙ্গকে দিয়ে এই ছবিটির আরেকটি ভার্সন করানো হয়। নতুন রূপে শ্যুটিং করা এই ছবিটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘স্কার্লেট স্ট্রিট’। কিন্তু হলিউডে তোলা এই ছবিটি দেখে জ্যঁ রেনোয়া নিজে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হয়েছিলেন।

ফরাসী বামপন্থী মতধারার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ‘ল ক্রাম দ মঁসিয়ে ল্যাঙ’ (১৯৩৬)

জ্যঁ রেনোয়া পরিচালিত আরেকটি বিখ্যাত ছবি হচ্ছে ‘তোনি’। এ ছবিটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালীয় চলচ্চিত্রের নব্য বাস্তবতা বা ‘নিও রিয়ালিজম’-এর অগ্রদূত বলা হয়। দেড় ঘন্টার এই ছবিটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৩৫ সালে। এর ক্যামেরায় কাজ করেছিলেন রেনোয়ার ভ্রাতুষ্পুত্র কঁদ রেনোয়া যিনি ১৯৫০ সলে বাংলায় তৈরি ‘দি রিভার’ ছবিতেও কাজ করেছিলেন। ইতালী থেকে ফ্রান্সে আগত একজন শ্রমিকের দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতার বিবরণ খবরের কাগজে পড়ে জ্যঁ রেনোয়া এবং তাঁর বন্ধু কার্ল আইনস্টাইন দুজনে মিলে এই ছবিটির চিত্রনাট্য রচনা করেন। কাহিনীর ঢিলে ঢালা গাঁথুনি, বাস্তব পরিবেশ, স্বাভাবিক পোশাক এবং একেবারে সাবলীল অভিনয়ের জন্য এই ছবিটি ফরাসী চলচ্চিত্রের ধারায় এক উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম। সেই সাথে রেনোয়ার পিতার ইম্প্রেশনিষ্ট চিত্রশিল্পের প্রভাব এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

১৯৩৬ সালে রেনোয়া তৈরি করলেন ‘ল ক্রাম দ মঁসিয়ে ল্যাঙ’ ছবিটি। এই ছবিটি তাঁর আগের ছবিগুলোর চেয়ে একেবারে ভিন্ন ধরনের। এই সময় থেকেই রেনোয়া ফরাসী বামপন্থীদের রাজনৈতিক সংগঠন পপুলার ফ্রন্টের উত্সাহী সমর্থক হয়ে পড়েন এবং ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট মতদর্শের প্রতি আস্থাবান হতে থাকেন। ছবির কাহিনীতে দেখা যায়, একজন শঠ এবং ধূর্ত পুস্তক প্রকাশক তার কর্মচারীদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাবার পর শ্রমিকরা নিজেরাই প্রকাশনা সংস্থাটি চালাবার দায়িত্ব নেন। ধীরে ধীরে সেটি লাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে থাকে। এমন অবস্থায় মালিকটি ফিরে এসে প্রতিষ্ঠানটির দখল নিতে চায়। কিন্তু কর্মচারীরা তাতে বাধা দেন এবং একজন সত স্বভাবের কর্মচারী মঁসিয়ে ল্যাঙ ধূর্ত মালিককে শেষ পর্যন্ত হত্যা করেন। সেই সময় সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে এই ছবিটির মধ্যে একটি বলিষ্ঠ আশাবাদী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছিল এবং ধারণা করা হচ্ছিল, শ্রমিকদের ঐক্য শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত ও ফলপ্রসু হবেই। এই ছবির বেশির ভাগ চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন ফরাসী বামপন্থী নাট্য সংস্থা গ্রুপ ‘অক্টোবর’-এর অভিনেতারা।

‘লা গ্রাঁদ ইলিউসঁ’ (১৯৩৭) ছবিটি যুদ্ধবিরোধী ও মানবমৈত্রীর বাণী প্রচার করেছিল

১৯৩৬ সালেই ফরাসী কমিউনিস্ট পার্টির প্রযোজনায় এবং জ্যঁ রেনোয়র পরিচলানায় তৈরি হয় ‘লা ভি এতা নু’ ছবিটি। যদিও রেনোয়া কমিউনিস্ট পার্টির হয়েই ছবিটি তুলেছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে কোনদিনই পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেননি। ঐ বছরেই রেনোয়া মোঁপাসার একটি ছোট গল্পকে কেন্দ্র করে তৈরি করেন পঁয়ত্রিশ মিনিটের একটি প্রেমের কাহিনী ‘ইউন পারতি দ কাঁপন’। ছোটগল্পের চিত্ররূপ দিলে কেমন হয় রেনোয়া তাই নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে চেয়েছিলেন। এ ছবিতে সাহিত্য ও চিত্রকলার প্রতি রেনোয়ার গভীর প্রীতির বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। ছবির পুরো শ্যুটিংই হয়েছিল বহির্দৃশ্যে। জুলাই মাসের মধ্যেভাগে ভরা বর্ষার সময় ছবিটির শ্যুটিং করা হয়েছিল বলে এই ছবির সর্বত্র বর্ষার বিষন্ন ও মেঘলা আবহাওয়া লক্ষ্য করা যায়। নদীর পাড় এবং নদীর আলোকচিত্র যেভাবে কদ রেনোয়া তুলেছিলেন তাতে গোটা ছবিতে এক অপূর্ব কাব্যিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।

১৯৩৭ সালে জ্যঁ রেনোয়া তাঁর পরিচালক জীবনের একটি উল্লেখ্যযোগ্য ছবি পরিচালনা করেন। ছবিটি হচ্ছে ‘লা গ্রাঁদ ইলিউসঁ’। ১৯১৪ সালের প্রথম মহাযুদ্ধের পটভূমিতে মানবিক আবেদন সমৃদ্ধ এই ছবিটি পৃথিবীর বহুদেশে ব্যাপক সফলতা অর্জন করে। যুদ্ধবিরোধী একটি বলিষ্ঠ বক্তব্য থাকার জন্য জার্মানী, ইতালী ও জাপানের মত ফ্যাসিস্ট দেশগুলোতে ছবিটির প্রদর্শনের ওপর একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এই ছবির একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে জ্যঁ রেনোয়া তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের গুরু এরিথ ফন স্টোহাইমকে দিয়ে এই ছবির এক জার্মান সেনাধক্ষ্যরের ভূমিকায় অভিনয় করান। স্টোহাইমের অভিনয় ছবিটির মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দেয়। ‘লা গ্রাঁদ ইলিউসঁ’ ছবিটি যুদ্ধবিরোধী ও মানবমৈত্রীর বাণী প্রচার করেছিল। ছবিটিতে ফরাসী, জার্মানী এবং ইংরেজি-তিনটি ভাষার ব্যবহার করা হয়েছিল এবং জাতি ও ভাষাগত বন্ধনের উর্ধ্বে পৃথিবীর সব দেশের মানুষের চরিত্রের মধ্যে ঐক্যের দিকটা তুলে ধরা হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈন্যবাহিনীতে কাজ করার অভিজ্ঞতা রেনোয়া এই ছবিতে লাগিয়েছিলেন। এই ছবির বিষয়বস্তু হিটলার ও তার প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলস-এর অপছন্দ হওয়ায় নাতসীদের কালো তালিকায় জ্যঁ রেনোয়ার নাম উঠে যায়। ১৯৪৬ সালে ছবিটি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে প্রদর্শিত হয়।

১৯৩৮ সালে জাঁ রেনোয়া তৈরি করলেন ‘লা মার্সাই’ ছবিটি। সম্পূর্ণ জনগণের অর্থে ছবিটির নির্মাণ ব্যয় চালানো হয়। সম্ভবত ‘লা মার্সাই’ই পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্র যার তৈরির অর্থ আসে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে। জনগণের কাছ থেকে অর্থ তোলার জন্য ফ্রান্সের বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন এবং ফিল্ম সোসাইটিগুলো কাজ করে। সমাজ পরিবর্তন এবং পুঁজিবাজদের বিরুদ্ধে বক্তব্য থাকবে এমন এক ছবির স্বপ্নে সাধারণ জনগণ সেদিন রেনোয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ছবিটির শুরুতে বিপ্লবী সৈন্যবাহিনীর দৃশ্যগুলো ছিল অত্যন্ত সজীব এবং নতুন স্টাইলের, কিন্তু যথেষ্ঠ প্রগতিশীল বক্তব্য থাকা সত্তে¡ও ছবিটি সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি।

১৯৪০ সালের প্রথম দিকে ফরাসী সরকার রেনোয়াকে ইতালীতে পাঠালেন দুই দেশের যুগ্ম প্রযোজনায় ‘লা তোসকা’ নামে একটি ছবি করার জন্য। ছবিটির কাজ যখন কেবল শুরু হয়েছে সেই সময় ফ্যাসিস্ট মুসোলিনীর নেতেৃত্বে ইতালী জার্মানীর সঙ্গে অবাহিনীতে যোগ দেয়। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে রেনোয়া হিটলারের নাতসী বাহিনীর কালো তালিকায় ছিলেন। ফলে তাঁকে ছবির কাজ বন্ধ করে ইতালী ছেড়ে ফ্রান্সে ফিরে আসতে হয়। ইউরোপে যখন বিশ্বযুদ্ধের প্রকোপ বাড়তে থাকে সেই সময় রবার্ট ফাহার্টি এবং আরো কয়েকজন আমেরিকান পরিচালকের অনুরোধে তিনি ইউরোপ ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি জমান। আমেরিকায় পাড়ি জমানোর পূর্বে ১৯৩৯ সালে রেনোয়া তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি ‘লা রেইল দ্যু জ্য’র কাজ শেষ করেন। এই ছবির কাহিনীর জন্য তিনি বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচিত হন। সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা কিছু কিছু রক্ষণশীল সমালোচক এবং সরকারি তরফ থেকে কিছু কিছু আমলা ছবিটিতে নীতিহীনতা ও ভ্রষ্টাচারের অভিযোগ অভিযুক্ত করেন। তবে চলচ্চিত্র সামলোচকদের মতে ফরাসী চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসে ‘লা রেইল দ্যু জ্য’ শ্রেষ্ঠ ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম। নবতরঙ্গ (New Wave) রীতির চলচ্চিত্রের উপরেও এই ছবির প্রভাব যে অপরিসীম তা সহজেই বোঝা যায়। (চলবে)