ফরিদ আহমেদ : জেমস হ্যাডলি চেজের একটা থ্রিলার বই আছে। বইটার নাম ‘স্ট্রিক্টলি ফর ক্যাশ’। এটা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৫১ সালে। ‘স্ট্রিক্টলি ফর ক্যাশ’ বইটার ছায়া অবলম্বনে কাজী আনোয়ার হোসেন মাসুদ রানা সিরিজে একটা বই লিখেছিলেন। সেটার নাম ‘বিস্মরণ’। এর পটভ‚মিকাতে পরিবর্তন এনেছিলেন। মাসুদ রানাকে ছুটিতে নিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীলংকায়। সেখানেই ঘটেছিলো রুদ্ধশ্বাস সব ঘটনা। ‘বিস্মরণ’ মাসুদ রানা সিরিজের খুবই জনপ্রিয় একটা বই। এটার কাহিনি অবলম্বনে বাংলাদেশে ‘মাসুদ রানা’ নামে একটা চলচ্চিত্রও হয়েছে। সেই চলচ্চিত্রে মাসুদ রানা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নায়ক সোহেল রানা। ‘বিস্মরণ’ বইয়ের শেষ দৃশ্যে দেখা যায় মাসুদ রানা পালাচ্ছে। সাথে রয়েছে ক্যাসিনো থেকে চুরি করা বিশ লাখ টাকা। পিছনে ধাওয়া করছে গলের পুলিশ। পুলিশকে এড়াতে বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে হাট-বাজার বা জনারণ্যে টাকা ছিটিয়ে দিতে থাকে সে। উন্মত্ত জনতা টাকার লোভে নেমে আসে রাস্তায়, গণ-ব্যারিকেড গড়ে তোলে তারা পুলিশের জীপ আর রানার গাড়ির মধ্যে।

জেমস হ্যাডলি চেজের গল্পের এই প্লটের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব পাশ্চাত্যে আছে কিনা, এটা জানা যায় না। হয়তো পুরো ঘটনাটাই এসেছে লেখকের কল্পনা থেকে। কিন্তু, ঠিক একই ধরনের একটা ঘটনা ঘটেছিলো এই বঙ্গদেশে। ঘটেছিলো আমাদের চট্টগ্রামে, ১৯২৩ সালে। জেমস হ্যাডলি চেজের স্ট্রিক্টলি ফর ক্যাশ লেখারও প্রায় তিন দশক আগে।

চট্টগ্রামে তখন বিপ্লবীরা সংগঠিত হচ্ছে সূর্যসেনের নেতৃত্বে। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব করতে গেলে অস্ত্র লাগে। আর এই অস্ত্র কিনতে গেলে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে টাকা। টাকা সংগ্রহের জন্য বিপ্লবীরা তখন এখানে ওখানে ডাকাতি করছে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে তখন আসাম বেঙ্গল রেলের বড় কারখানা। এখানকার শ্রমিক এবং কর্মচারীদের মাসিক বেতনের টাকা নিয়ে যাওয়া হতো ঘোড়ার গাড়িতে করে। ট্রেজারার সাহেব এই কাজটা করতেন। টাকার নিরাপত্তার জন্য দুজন পুলিশও থাকতো সাথে। এই টাকাই ডাকাতি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সূর্যসেনের দল। এই ডাকাতিতে অংশ নেন অনন্ত সিংহ, নির্মল সেন, উপেন ভট্টাচার্য, দেবেন দে এবং রাজেশ দাস। এরা এর মাস খানেক আগে থেকেই বহাদ্দার হাটে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলো। বাড়িটার নাম সুলুকবাহার। বহাদ্দারহাট এলাকা মুসলমান প্রধান এলাকা ছিলো।

অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে এলেও ডাকাতিটা তাঁরা করেছিলেন বিনা রক্তপাতে। অস্ত্র দেখিয়ে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন তাঁরা। দেবেন দে গাড়ির কোচোয়ান হয়ে সেটাকে চালিয়ে নিয়ে চলে যান শহরে। গাড়িতে সতেরো হাজার টাকা ছিলো। সেই সময়ের জন্য বিশাল অংকের টাকা। এর একটা বড় অংশ ভাগে ভাগে করে চালান করে দেওয়া হয় কোলকাতায় অস্ত্র কেনার উদ্দেশ্যে।

ডাকাতির পরেই পুলিশের টনক নড়ে। কোলকাতা থেকে নিয়ে আসা হয় গোয়েন্দা পুলিশের দলকে। ডাকাতদের ধরিয়ে দেবার জন্য এক হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়।

ডাকাতির প্রায় দশ দিন পরে একদিন এই আস্তানায় হাজির হয়েছেন সূর্যসেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তীও। ঠিক এমন সময়ে বাড়ির সামনে পুলিশে জীপ নিয়ে হাজির হয়েছে পাঁচলাইশ থানার ওসি আবদুল মজিদ। সুলুকবাহার যে সন্দেহজনক বাড়ি, এটা পুলিশ গত কয়েকদিনেই ধারণা করে নিয়েছে। আবদুল মজিদ চোখ রাখতেই এখানে এসেছে। বাড়ির লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তার সন্দেহ বেশ শক্তপোক্তই হয় যে এটা বিপ্লবীদের আস্তানা। কিন্তু, যথেষ্ট জনবল না থাকায় সে কিছু না বলে চলে যায়। এলাকায় গিয়ে মুসলমান জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে সে। তাদের নিয়ে বাড়ি ঘেরাও করার পরিকল্পনা করে। পুলিশের উপস্থিতি দেখে বিপ্লবীরাও এখানে থাকা নিরাপদ না ভেবে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পালাতে গিয়ে দেখে জনতা ঘিরে ধরেছে তাদের। পিস্তলের ফাঁকা গুলি করে তাদেরকে ভয় দেখিয়ে এগিয়ে চলতে থাকে তারা। কিন্তু , জনতা পিছু ছাড়ে না। ধরতে পারলেই এক হাজার টাকা পুরস্কার, এই লোভ সামলানো কঠিন। তাদের সাথে পুলিশও রয়েছে।

জনতার ধাওয়া খেতে খেতে বিপ্লবীরা এসে পড়ে বহাদ্দার হাট বাজারের কাছে। এখানেও প্রচুর লোক। পিস্তল উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে পথ করে নিয়ে এগোতে থাকে তারা। কিন্তু, ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে থাকে তাদের পালানো। গুলি গায়ে লাগছে না, ফলে জনতা ক্রমেই সাহসী হচ্ছে। ঢিল পাটকেল তারাও ছুড়ে মারছে বিপ্লবীদের দিকে। এই সময়ে বিপ্লবীরা অদ্ভুত একটা সিদ্ধান্ত নেন। সাথে থাকা দুই হাজার টাকা ছড়িয়ে দিতে থাকেন তারা হাটের মাঝে। টাকা কুড়নোর জন্য বিপুল যে হট্টগোল তৈরি হয়, সেটাই সুযোগ করে দেয় বিপ্লবীদের। তাঁরা উঠে যান নাগরখানা পাহাড়ে। সেখানে পরবর্তীতে ঘটেছিলো পুলিশের সাথে এক যুদ্ধ। যেটা নাগরখানা যুদ্ধ নামে পরিচিত।