ভজন সরকার : প্রচলিত যে কোন ধর্ম কিংবা ধর্ম বিশ্বাসীদের নিয়ে লেখা ভয়ঙ্কর রকমের ঝুঁকিপূর্ণই শুধু নয় ভয়াবহ বিপজ্জনকও। এ ভয়াবহ ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা শুধু ইদানিং কালের বললে ভুল বলা হবে। এটা তো নির্মম ও কঠিন সত্য যে, ধর্ম প্রচার ও ধর্মীয় প্রভাব বিস্তারের জন্য এ পৃথিবী যতোবার রক্তাক্ত হয়েছে আর কোন কিছুর জন্য এতো রক্ত ঝরেনি।
বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়ের অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্রের মধ্যে অন্যতম ‘আগন্তুক’ চলচ্চিত্রটি। ‘আগন্তুক’-কের মূলচরিত্র মনমোহন মিত্রকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “আপনি ধর্ম বিশ্বাস করেন?” মনমোহন মিত্রের উত্তর ছিল এ রকম, “যা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, আমি তা বিশ্বাস করি না। আর প্রচলিত ধর্ম তা করেই, ফলে আমি ধর্মও বিশ্বাস করি না।” পরক্ষণেই তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “আর ঈশ্বর?”
মনমোহন মিত্র যা বলেছিলেন তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায় এ রকম যে, “এই পৃথিবীতে এতো বিভেদ, এতো বৈষম্য; একদিকে প্রযুক্তির এতো অভাবনীয় উন্নতি, অন্যদিকে অসংখ্য মানুষের এতো কষ্টকর জীবন। এইসব দেখে দেখে পরম করুণাময় ঈশ্বরের প্রতিও বিশ্বাস রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
যদি মনমোহন মিত্রের মাধ্যমে আমরা সত্যজিৎ রায়ের ঈশ্বরভাবনাকে মেলাতে চেষ্টা করি তবে সত্যজিৎ রায় যে ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন সেটা বলা যায়। সেই সাথে এটাও বলা যায় যে, তিনি প্রচলিত কোনো ধর্মকেই বিশ্বাস করতেন না। ধর্ম অবিশ্বাসী অথচ ঈশ্বরে বিশ্বাস- কথাটা একটু খটকা লাগে।
অনেকে বলেন, সত্যজিতের এ ভাবনা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে পাওয়া। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরে বিশ্বাসের প্রমান তাঁর সাহিত্যের প্রতিটি শাখায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত কোনো ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না। আরও সহজ ক’রে বললে, ধর্মবিশ্বাসের যে প্রচলিত রীতিনীতি, রবীন্দ্রনাথ তার ঘোরবিরোধী ছিলেন।
এ প্রসংগে, ইংরেজ ধর্মযাজক রেভারেন্ড সি, এফ, এন্ড্রুজ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন,
“গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটি আলোচনার বিবরণ জানা যায়। আলোচনার প্রথম বিষয় ছিল মূর্তি; গান্ধী তার সপক্ষে ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেন, সাধারণ মানুষ বলামাত্রই নিজেকে বিমূর্ত চিন্তার স্তরে তুলতে পারে না। আর অনন্তকাল বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের সংগে শিশুর মতো আচরণ করাটা রবীন্দ্রনাথ সহ্য করতে পারেন না।”
মহাত্মা গান্ধী যেটা বলেছেন, সেটা সাধারণ মানুষের সহজ ও সরল উপায়ে প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের মাধ্যমে ঈশ্বরের বিমূর্ত চিন্তা – অন্যকথায় বিমূর্ত ঈশ্বরের মূর্ত চিন্তা। আর রবীন্দ্রনাথ যেটা বলেছেন, সেটা ঠিক তার বিপরীত; বিমূর্ত চিন্তার মাধ্যমেই বিমূর্ত ঈশ্বরের চিন্তা। মহাত্মা গান্ধী ও মনীষী রবীন্দ্রনাথের এ বিপরীতমুখী মতই প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের সাথে অলৌকিক ঈশ্বর বিশ্বাসের পার্থক্য। যদিও প্রচলিত সব ধর্ম বিশ্বাসের মূলই কিন্তু অলৌকিক ঈশ্বরের সান্নিধ্য কৃপা কিংবা সন্তুষ্টি লাভ।
তাই যদি ঈশ্বরে বিশ্বাসটা না থাকে, তবে সব প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের বা ধর্মের আচার-রীতিনীতিরও প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ কিংবা সত্যজিতের মতো মানুষেরা ঈশ্বরে বিশ্বাসের উর্ধ্বে উঠতে পারেননি। তাই সাধারণ মানুষ অলৌকিক ঈশ্বরে বিশ্বাসের বিমূর্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসবেন সেটা আশা করা খুব কঠিন।
মানুষ নিজে যেটা সমাধান করতে পারছেন না কিংবা মানুষ নানা ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত হয়ে যখন নিতান্ত অসহায়, তখন অলৌকিক কেউ তাঁকে সাহায্য করবে, এটা ভাবতে কার না ভালো লাগে! ঈশ্বর কিংবা অলৌকিক শক্তির প্রতি মানুষের বিশ্বাসের মূল কথাই হয়ত এটা। আর এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, মানুষের অসহায়ত্বের প্রতি তথাকথিত সহায়ক ঈশ্বরের এ ধারণাকে পূঁজি ক’রেই প্রচলিত সব ধর্ম বিশ্বাস দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মধ্যে। যদিও কালেকালে এক ঈশ্বর থেকে অন্য ঈশ্বরে বিশ্বাসের প্রতি জোরজবরদস্তি হয়েছে কিন্তু মানুষের দৈবিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস কিন্তু সহজাত।
একথা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এখনো পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই ভিন্ন ভিন্ন রূপে অলৌকিক শক্তিধর ঈশ্বরে বিশ্বাস করে থাকেন। শুধু ঈশ্বরে বিশ্বাসই নয়, জাগতিক সুখ-সমৃদ্ধি-সমাধান-সমর্থনের জন্যে ঈশ্বরের কৃপা লাভ করতে চান। এ জগতে তো বটেই মৃত্যুর পরে আরও বেশি সুখী হতে চান। এ পৃথিবীর অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চান মৃত্যুর পরে। এক কথায় সুখের সাগরে অনন্তকাল ভাসতে চান। আর তার জন্যে উপায় যার যার ঈশ্বরের কৃপা পাওয়া। ঈশ্বরের কৃপা লাভের জন্যে যুক্তি-তর্ক এমনকি কান্ডজ্ঞান বিসর্জন দিতেও মানুষের কমতি নেই।
আগেই বলেছি, কিছু মানুষ নিজের কিংবা নিজেদের মতো ক’রে ঈশ্বর তুষ্টির উপায় বাতলে দিয়ে গেছেন সাধারণের কাছে; যার অন্য নাম প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস। কেউ কেউ বা কোনো কোনো ধর্ম বিশ্বাসীরা হয়ত সেই অতীতের ঈশ্বর তুষ্টির উপায় একটু সংস্কার ক’রেছেন। ঈশ্বরের বিমূর্ত ধারণাকে দর্শন কিংবা যুক্তির প্রলেপে মুড়ে দেয়ার চেষ্টা করে ধর্ম বিশ্বাসের বিধিনিষেধের বাতাবরণকে একটু আলগা করেছেন। আর কেউ এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন, আদিম বা মধ্যযুগের সেই বাতলে দেয়া ঈশ্বরতুষ্টির রীতি-নীতি বা বিধিবিধানকে।
আমরা চাই বা না-চাই, বিশ্বাস করি বা না-করি এ পৃথিবী থেকে অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস, যাকে আমরা ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবান, গড- যা বলি না কেন, সেখানে থেকে এতো সহজে মুক্তি নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-যুক্তির উৎকর্ষ সত্বেও মানুষের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকবে, থাকবে কিছু অজানা-অচেনা অসহায়ত্ব। সেই সাথে রাজনীতি, বৈষম্য, বিভাজন কিংবা অন্যকে শোষণ করার ইচ্ছে তো আছেই। আর এ সবের জন্য ঈশ্বরে বিশ্বাস কখনো আসবে সহজাত হিসেবে আবার কখনো ধর্ম বিশ্বাসকে নিজ নিজ স্বার্থে ব্যবহারের মাধ্যমে।
তবে একথাও সত্য যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে মানুষের মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা যতো বাড়বে, অলৌকিক শক্তিধর ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবান, গড-এর প্রতি মানুষের বিশ্বাসও ততো কমবে। আর ঈশ্বরের অস্তিত্বে আস্থাহীন মানুষের ঈশ্বর তুষ্টির সাধনা,যার প্রচলিত নাম ধর্ম বিশ্বাস, সে সবের প্রয়োজনও আস্তে আস্তে ফুরিয়ে যাবে।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা )