ভজন সরকার : প্রায় দুই বছর পর শহর থেকে দূরে গেলাম। বিশ্ব মানচিত্রের সর্ব- উত্তরের ভৌগলিক সীমানায় অবস্থিত দেশ কানাডা। বিশাল দেশ; উত্তরে উত্তরমেরু থেকে দক্ষিণে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, পুবে আটলান্টিক মহাসাগর থেকে পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ছিল তখন আয়তনের দিক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তো বড় ছিলই। এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো হয়ে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পুবে অর্থাৎ এশিয়া মহাদেশের প্রান্ত ঘেষে অবস্থিত প্রদেশগুলো অনেক দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। বাকীটুকুর নাম হয়েছে রাশিয়া। রূপান্তরিত রাশিয়াতে এখনো সাইবেরিয়া। তাই আয়তনের দিক থেকে এখনো রাশিয়া প্রথম আর দ্বিতীয় স্থানে কানাডা।

রাশিয়ার যেমন সাইবেরিয়া আছে, কানাডার আছে উত্তর মেরুর বিশাল এলাকা। তিনটি টেরিটোরি মিলিয়ে সে এক বিশাল বিরাণ ভূমি এবং জলাধার, যা সারা বছর জুড়েই থাকে বরফাচ্ছাদিত। ঠিক সাইবেরিয়ার মতোই। উত্তর মেরুর দু’দিকের বিশাল অঞ্চল কানাডা আর রাশিয়ার আয়তন বৃদ্ধি করেছে।

কানাডার অবশিষ্টাংশে ১০টি প্রদেশ। বড় কিংবা মাঝারি এক একটি প্রদেশের ভিতর বাংলাদেশের মতো অনেকগুলো দেশ প্রতিস্থাপন করা যাবে। এই বিশাল ভূখন্ডের সাথে আছে অসংখ্য লেক। বড় বড় পাঁচটি লেককে একত্রে বলা হয় “গ্রেইট লেকস”। সবচেয়ে বড় লেকের নাম লেক সুপিরিয়র আর গ্রেইট লেকের মধ্যে ছোট লেকের নাম “লেক ওন্টারিও”। সব চেয়ে ছোট লেকের আকার দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার আর প্রস্থে প্রায় ১০০ কিলিমিটারের মতো। গভীরতা সর্বোচ্চ ৮০০ ফুট। এটাই যদি ছোট হয় তবে সবচেয়ে বড় লেক সুপিরিয়রের আয়তন কত হবে সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।

লেক সুপিরিয়রের একেবারে পেটের মাঝখানে ঢুকে থাকা একটা ছোট্ট শহরে অনেক দিন চাকুরী সূত্রে ছিলাম। কানাডার ওন্টারিও প্রদেশের উত্তর দিকের শহর ‘স্যু সেন্ট মেরি’ থেকে হাইওয়ে ১৭ ধরে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরের শহর ‘থ্যাণ্ডার ব্যে’। এই উত্তর পারের মাঝামাঝি সোনার খনির শহর ‘ম্যারাথন’। ওখানেই ছিলাম বছর তিনেক। তখন দেখেছি আমাদের পদ্মা কিংবা বঙ্গোপসাগরের অসংখ্য উপকথার মতো লেক সুপিরিয়রেরর দুই পারের জনবসতিতেও ছড়িয়ে আছে এ রকম উপকথা। অসংখ্য জেলে লেক সুপিরিয়রে হারিয়ে গেছে। তখন মনে হচ্ছিল এ যেন পদ্মা নদীর মাঝি কিংবা সাগর উপক‚লের কোনো উপকথা শুনছি। আসলে মানুষের হারিয়ে যাওয়ার বেদনা কিংবা গল্পগুলো সারা পৃথিবী ব্যাপি এক এবং অভিন্নই।

দুই বছর পরে শহর থেকে দূরের অবকাশের কথা বলতে গিয়ে এতক্ষণ শিবের গীত গাইলাম। এবার ধান ভানার কথায় আসি। আগেও গিয়েছি কিন্তু এবারে দুই বছর করোনাবন্দী সময়ে ভাবলাম একটু শরীরের স্থবিরতা ছাড়িয়ে আসি। জল এবং পাহাড়ের যুগলবন্দী বরাবরের আকর্ষণ। সে সব কথা চিন্তা করেই টরন্টো থেকে শ’ দুই কিলোমিটার দূরে “বøু মাউন্টেইন্”-কে বেছে নিলাম।

ওন্টারিওর উত্তরের শহরে বাস করে একটা জিনিস দেখেছি, মানুষ যে কোনো পরিবেশকে জীবনধারণের উপযোগী করে গড়ে নেবেই নেবে। তাই তো কানাডার প্রায় সব লোকালয়েই বরফে খেলাধুলা করার রমরমা আয়োজন। তেমনি একটি বিখ্যাত স্কি রিসোর্ট হলো এই “বøু মাউন্টেইন্”। কিন্তু পাহাড় এবং জলের সমন্বয়ের জন্য গরমের দিনেও সেই স্কি রিসোর্টকে অন্যান্য বিনোদনের আয়োজনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পাহাড়ের উপরে ওঠার জন্য রোপওয়ে -যার পোশাকি নাম গন্ডোলা এবং আরও নানান রকমের আয়োজনের গরমের দিনে সেজে ওঠে এই “বøæ মাউন্টেইন্”।

‘দ্য বøæ মাউন্টেইন্স নিয়ে বলতে গিয়ে কানাডার লেক নিয়ে এতক্ষণ যে প্যাচাল পারলাম তার আসল কারণ “বøু মাউন্টেইন্”-এর পাশে অবস্থিত “জর্জিয়ান ব্যে”। চারিদিকের তটরেখায় বেষ্টিত জলাধারকে ব্যে বলা হবে কেন? এ প্রশ্ন আমার বরাবরই ছিল। এবার গোন্ডলা বেয়ে পাহাড়ের চূরায় উঠে সে কারণটি জেনে বিস্মিতই হলাম।

সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে এক ফ্রান্স পর্যটক স্যামুয়েল দ্য চাপলান এতো বড় জলাশয় দেখে মনে করেছিলেন আসলে এটি সাগর। নামও দিয়েছিলেন শান্ত সাগর। দুই শ’বছর পরে রাজা পঞ্চম জর্জের নামানুসারের এই জলাধারের নামকরণ করা হয় ‘জর্জিয়ান ব্যে’। যদিও আয়তন প্রায় লেক ওন্টারিওর সমান তবুও দু শ বছর আগের সেই ফ্রান্স পর্যটকের ভুলের প্রতি সম্মান দেখিয়েও এর নাম লেক না রেখে ব্যে বা সাগর রাখা হয়।

ভূগোল কিংবা ইতিহাস কিছুই শেখানোর ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু এত কিছুর আসল কারণ ওই পাহাড় এবং জলের যুগলবন্দী উপত্যকায় বসে বসে আমার কিছু ভাবনার কথা বলা। এখনো করোনা মুছে যায়নি কানাডার মতো উন্নত দেশেও। এখনো ধর্মান্ধ কিংবা কুসংস্কারান্ধ অসংখ্য মানুষ (জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগ তো হবেই) টিকা না নিয়ে প্রতিদিন করোনা আক্রান্তের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবুও মানুষ বেড়িয়েছে বাড়ি থেকে। কানাডার বিচ এবং বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। মানুষ ছুটছে। সামনে শীতকাল। সময় কম। তাড়া আরও বেশি। তাই তো এ সব এলাকায় ভোর ২টা পর্যন্ত মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে মুক্ত বিহংগের মতো। “ব্লু মাউন্টেইন্”-ও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে অসংখ্য মেয়ে কিংবা মহিলা একা কিংবা দলবদ্ধভাবে নির্ভয়ে, নির্ভাবনায় এবং নির্ভারে ঘুরছে সকাল সন্ধ্যা মধ্য-রাতেও।

কানাডা এসে প্রথম প্রথম অসংখ্য না -পাওয়ার কথা মনে হতো। আমরা যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বেড়ে উঠেছি, তারা দেখেছি জীবন কত কঠিন। আধুনিক জীবনের কিছুই ছিল না ৭০ এবং ৮০ দশকের বাংলাদেশে। তাই কানাডা এসে অনেক কিছু দেখে বিস্মিত হতাম। কিন্তু যে বিস্ময়টি আমাকে ভাবিয়ে তুলতো তা হলো মেয়েদের স্বাধীনতা। তখন তো মনে হতোই এখনো মনে হয়, বাংলাদেশে মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়াটা একটা অভিশাপ। যতবার এই রিসোর্ট কিংবা বিনোদিন কেন্দ্রগুলোতে যাই ততবার এ কথাটি বেশী বেশী মনে বাজে।

তবুও ৭০ কিংবা ৮০ দশকে মেয়েদের পোশাকের স্বাধীনতা ছিল বাংলাদেশে। দিনে দিনে সে স্বাধীনতাটুকুও ধর্মান্ধরা কেড়ে নিচ্ছে। তার সাথে যোগ হয়েছে মেয়েদের প্রতি যৌন নির্যাতন। সুক্ষ্ণভাবে এটি সমাজে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, স্বল্প পোশাকই নাকি মেয়েদের প্রতি যৌন নির্যাতনে পুরুষদের উদ্বুদ্ধ করে। কী এক জঘণ্য যুক্তি! অথচ উন্নত দেশগুলোতে সমুদ্র সৈকতে মেয়েরা বিকিনি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি কোনদিন দেখিনি কোনো পুরুষকে যৌন নির্যাতনে প্রলুব্ধ হতে।

এ লেখাটি লিখতে লিখতেই খবর পেলাম তালেবান প্রায় পুরা আফগানিস্তান দখল করে রাজধানী কাবুল দখলের পথে। আফগানিস্তানে মেয়েদের ইস্কুল -কলেজ বন্ধ করা হয়েছে। সকল কর্মক্ষেত্র থেকে মেয়েদের ছাঁটাই করা হয়েছে। পুরুষ ছাড়া মেয়েদের বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। কাবুলের বিল-বোর্ড এবং দেয়াল থেকে মেয়েদের ছবি মুছে ফেলা হচ্ছে। শুধু পাতলা জালের মতো কাপড় দিয়ে দু’চোখে দেখার ব্যবস্থা করে সারা শরীর ঢেকে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জানি না, আফগানিস্তান থেকে এই তালেবানি ব্যবস্থা বাংলাদেশসহ অন্যত্র ছড়িয়ে পড়বে কিনা। তবে বাংলাদেশের ধর্মান্ধরা যে আফগানিস্তানের এ পরিবর্তনে খুশী হয়েছে সেটি বলাই যায়।

করোনাকালের এই অবকাশ যাপনের অবসরে বারবার মনে হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের সেই গানটি “জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো”। বিশ্বব্যাপি অসংখ্য মানুষ এখনো আধুনিক এবং মানবিক জীবনযাপনের স্বাধীনতা এবং অধিকারটুকু থেকে বঞ্চিত রয়েছে। ধর্মের বেড়াজালে আটকে রেখে কত মানুষ বিশেষকরে নারীদের শৃংখলিত করে রাখা হয়েছে। কে এই মানুষগুলোকে রুদ্র আলোক- শিখা জ্বালিয়ে বঞ্চনা-লাঞ্ছনা থেকে বাঁচাবে?
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা )