অনলাইন ডেস্ক : ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার দুই সপ্তাহের কম সময়ে ১৫ লাখের বেশি মানুষ জীবন বাঁচাতে ইউক্রেন ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক দূত ফিলিপ্পো গ্রান্ডি। ১৯৪৫ সালে শেষ হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম ইউরোপে এত বেশি সংখ্যক শরণার্থীর ঘটনা ঘটলো। এই শরণার্থীদের অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছে সীমান্তবর্তী দেশ পোল্যান্ডে।
রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর পর থেকে জীবন বাঁচাতে ইউক্রেনের হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে সাবওয়ে বা পাতাল রেলস্টেশনে। তারা সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছে তারা। তাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে বেশ কয়েকটি সেবা সংগঠন। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, শুধু কিয়েভের মেট্রো স্টেশনেই ঠাঁই হয়েছে ১৫ হাজারের বেশি মানুষের। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাইকেই থাকতে হচ্ছে একসাথে গাদাগাদি করে। বাইরের জগত থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন সাবওয়েতে ফুরিয়ে আসছে খাবারের মজুদও। মূলত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন এসব পাতাল রেল নির্মাণ করা হয় তখনই স্টেশনের নকশা এমনভাবে করা হয়েছিলে, যাতে সংঘাতের সময় এখানে আশ্রয় নিতে পারে সাধারণ মানুষ। আর তাই সাধারণ মানুষের আশ্রয় এখন এই পাতাল রেলস্টেশন। কিয়েভজুড়ে সাবওয়ে স্টেশন রয়েছে মোট ৫২টি। কর্তৃপক্ষ বলছে, এরইমধ্যে এসব স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। সবমিলিয়ে ১ লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে রাজধানীর পাতাল রেল স্টেশনগুলোতে।
এদিকে হামলা আতঙ্কে লোকালয়ে বের না হতে পারায় চরম সংকট দেখা দিয়েছে খাদ্য এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থায়। সাবওয়ে স্টেশনে এসব বাসিন্দাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করছে সেখানকার অনেক রেস্তোরাঁ মালিকও। ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের অভিযোগ, রাশিয়া শুধু সামরিক স্থাপনায় হামলার কথা বললেও নির্বিচারে বোমা পড়ছে বাড়িঘর, হাসপাতাল, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। ইউক্রেনের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য লুলিয়া জিয়াছেনকো গণমাধ্যমকে জানান, কারফিউয়ের কারণে অনেকে আগেভাগে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। হামলার আতঙ্কে বাইরেও বের হতে পারছে না মানুষ। তাই আমরা এসব মানুষ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের খাবার সরবরাহ করছি। হয়তো দ্রুতই আমাদের কাছে থাকা খাবার শেষ হয়ে যাবে। তাই দ্রুতই আমাদের সহায়তা প্রয়োজন।
এদিকে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের মারিওপোল শহরে নতুন করে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে গতকালও শহরটিতে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছিল। স্থানীয় সময় রবিবার সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত শহরটিতে সাময়িক যুদ্ধবিরতি দেওয়া হয়েছে বলে শহর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। দুপুর ১২টা থেকে বেসামরিক নাগরিকদের নির্দিষ্ট রুটে মারিওপোল থেকে সরিয়ে নেওয়া যাবে। শনিবার সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হলেও নতুন করে বোমা হামলা শুরুর জেরে তা স্থগিত হয়ে যায়। মারিওপোল শহরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শহরটির বেসামরিক নাগরিকরা তিন স্থান থেকে বাসে করে জাপোরিঝিয়া শহরে যেতে পারবেন। মানবিক করিডর তৈরি করে এই রুটটি গতকালও ব্যবহার করার পরিকল্পনা ছিল। সিটি কাউন্সিল বলেছে, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েও মানবিক করিডর ব্যবহার করে জাপোরিঝিয়ায় যাওয়া যাবে। তবে রেড ক্রসের নেতৃত্বে কাফেলায় বাসের পেছনে ব্যক্তিগত গাড়ি চালাতে বলা হয়েছে। এ সময় চালকদের তাদের গাড়ির সব আসন পূরণ করার কথাও বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, রাশিয়ার টানা গোলা, বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিপর্যস্ত ইউক্রেনে সাময়িক স্বস্তির অবকাশও মিলছে না। গতকাল রবিবার দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর শহর মারিওপোল থেকে বেসামরিক লোকদের সরিয়ে নেওয়ার নতুন চেষ্টাও বিফলে গেছে। স্থানীয় নগর পরিষদ বলেছে, রাশিয়ার অব্যাহত গোলাগুলির কারণে তা সম্ভব হয়নি। দেশের অন্যান্য স্থানেও রাশিয়ার বাহিনী কম-বেশি সমানতালে গোলা, ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ বাসিন্দাদের মারিওপোলসহ দুটি শহর ছাড়ার জন্য শনিবার প্রথম সাময়িক যুদ্ধবিরতি ও ‘মানবিক করিডরের’ কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই পরিকল্পনাও শহর ছাড়ার আরেকটি পথে রাশিয়ার সেনাদের হামলার কারণে বাতিল করা হয়। আন্তর্জাতিক রেডক্রস বলেছে, দুই দিনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা সংঘাতের সংশ্লিষ্ট পক্ষ দুটির মধ্যে ‘একটি বিশদ ও কার্যকর মতৈক্যের অভাবকেই’ তুলে ধরেছে।
এদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, মস্কোর দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তার দেশের সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ হবে না। সর্বশেষ গত রাতে জানা যায়, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর সঙ্গে ফোনালাপে পুতিন বলেছেন, রাশিয়া ‘আলোচনা বা যুদ্ধের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন করবে। তাঁদের আলোচনা চলে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে। অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি জনগণকে রাশিয়ার ‘প্রথম ধাক্কা সামলানোর পর’ এবার রুখে দাঁড়ানোর জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি জেলেনস্কির সহায়তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র পোল্যান্ডের সঙ্গে মিলে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় সহায়তা করতে সোভিয়েত আমলের কিছু যুদ্ধবিমান সরবরাহ করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরইসি) গতকাল স্থানীয় সময় দুপুরে মারিওপোল থেকে দুই লাখ লোক সরিয়ে নেওয়া শুরু করার আশা করেছিল। রেডক্রস বলেছে, তাদের লোকগুলো যুদ্ধে সাময়িক বিরতির মধ্যে মারিওপোল থেকে জাপোরিঝিয়া পর্যন্ত পথ দিয়ে নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার পথ খোলা শুরু করেছিল। কিন্তু অচিরেই আবার লড়াই শুরু হয়ে যায়। আইসিআরইসি বলছে, রাশিয়া ও ইউক্রেন নীতিগতভাবে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু কিভাবে কাজটি করা হবে তার খুঁটিনাটি নিয়ে একমত হতে তারা ব্যর্থ হয়।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গতকাল রবিবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের সঙ্গে ফোনে আলাপকালে বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করলে এবং মস্কোর দাবি পূরণ হলেই কেবল রাশিয়া তার সামরিক অভিযান বন্ধ করবে। রুশ প্রেসিডেন্টের দপ্তর ক্রেমলিন এ কথা জানিয়েছে। ইউক্রেনে আক্রমণ পরিকল্পনা এবং সময়সূচি অনুযায়ী চলছে—এ দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন পুতিন। রাশিয়ার সামরিক অভিযান প্রত্যাশা মতো চলছে না—পশ্চিমা প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের এমন অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সা¤প্রতিক দিনগুলোতে অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। ক্রেমলিনের বিবৃতিতে বলা হয়, পুতিন বলেছেন, তাঁর প্রত্যাশা ইউক্রেনীয় আলোচকরা আরো ‘গঠনমূলক’ পন্থা অবলম্বন করবেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি শনিবার রাতে কিয়েভ থেকে দেওয়া আবেগপূর্ণ ভাষণে বলেন, ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ার আক্রমণের ‘ধাক্কা’ সহ্য করতে পেরেছে। এবার রুখে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের শহরগুলো থেকে এই অশুভ শক্তিকে তাড়াতে হবে। ’ পাশাপাশি জেলেনস্কি আরো যুদ্ধবিমান দেওয়ার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে অনুরোধ জানান। গতকাল তিনি জানান, রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কিয়েভের অদূরের একটি বিমানবন্দর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। রাশিয়া কৃষ্ণ সাগরের উপক‚লীয় ওডেসা বন্দরে হামলার পরিকল্পনা করছে বলেও এক ভিডিওতে তিনি সতর্ক করে দেন। তিনি বলেন, ‘এটি যুদ্ধাপরাধ হবে। হবে ঐতিহাসিক অপরাধ। ’ইউক্রেনের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, রাশিয়ার হামলার ভাবগতিক থেকে তাঁরা মনে করছেন, দেশটির সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ কমান্ড দক্ষিণ ফ্রন্টের দিকে নজর দিচ্ছে। এর লক্ষ্য ইউক্রেনকে গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণ সাগর থেকে বিচ্ছিন্ন করা।
রাশিয়ার প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা দিন দিন আরও বেড়ে চলেছে। এই নিষেধাজ্ঞা এবং ইউক্রেনের প্রতি তাদের সমর্থন রাশিয়া এবং ইউক্রেন সংকটকে কোন দিকে নিয়ে যাবে সেই ভাবনায় পৃথিবীর শান্তি প্রিয় মানুষ ইতোমধ্যে আতংকিত হয়ে পড়েছে। খুব দ্রুত রাশিয়া এবং ইউক্রেনের এই যুদ্ধাবস্থা শেষ না হলে সেটা তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারে বলে অনেকে মনে করছে। এমন কিছু হলে নিঃসন্দেহে পৃথিবীর মানুষকে মানব সভ্যতার সবচেয়ে ভয়ংকর এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে যা গোটা পৃথিবীকে এক কালো অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে কানাডার টরন্টোসহ বিভিন্ন শহরে শান্তিকামী মানুষেরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষোভ সমাবেশে সবাই ইউক্রেন থেকে অনতিবিলম্বে রাশিয়ার সব রকম আগ্রাসন বন্ধের দাবী জানায়।