সিনহা আবুল মনসুর : পর্ব: নয়
অয়নের ডায়েরি
শনিবার
১৬ই জুন ১৯৮৪।
মিশন স্কুলে আমাদের অনেক নতুন বন্ধুবান্ধব জুটল। এর মধ্যে ছিল টিপু, কাশেম, জাকিউল, দিলীপ ও কামরুল। টিপু ছিল আমাদের ফার্স্ট বয়। ওকে সবাই ডাকত পুটি। টিপুকে উল্টো করে পুটি। আবুল কাশেম মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ডাকনাম ছিল কাশেম। বয়সের তুলনায় ও ছিল ছোটখাটো। কিছুটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলাফেরা করত। কামরুল ওর নাম দিল ‘ছোট ব্যাং’।
জাকিউল পুরো লেন্সের চশমা পরত। ওর মধ্যে একটা আঁতেল-আঁতেল ভাব ছিল। দিলীপ ছিল শান্ত স্বভাবের। ওর অন্য দুই ভাই নরেশ ও পরেশও আমাদের স্কুলে পড়ত। নরেশ আমাদের এক ক্লাস ওপরে আর পরেশ আমাদের এক ক্লাস নিচে। ওরা তিন ভাই-ই পড়াশোনায় ভালো ছিল।
বেশি ভালো ছিল পরেশ। পরেশ ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করল, ইন্টারমিডিয়েটে স্ট্যান্ড করল। ডাক্তারি পড়তে গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এরই মধ্যে দিলীপ আর নরেশও ডাক্তারি পড়া শুরু করেছে। ওরা ভালোই করছিল। কিন্তু সমস্যায় পড়ল পরেশ!
ডিসেকশন হলে ছেলেমেয়েরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে লাশ কাটাছেঁড়া করে এনাটমি শিখত। পরেশও ওই রকম একটা দলে ছিল। কিন্তু লাশের ওপর যতবারই ছুরি চালাত পরেশ, ততবারই ওর মনে হতো, ও যেন ছুরি চালাচ্ছে জীবন্ত মানুষের ওপর! মানুষটা যেন এখনই ওর গলা চেপে ধরবে!
গ্যালারিতে লেকচার দিচ্ছেন এনাটমির প্রফেসর। পড়াচ্ছেন শরীরের গুরুত্ব! কিন্তু পরেশের চোখ গ্যালারির বাইরে। ওখানে কারা যেন ঘোরাঘুরি করে!
ছায়ার মতো!
কায়ার মতো!
মায়ার মতো!
ফিসফিস করে ওরা যেন বলে, ‘পরেশ, তুমি বসে আছ কেন? কী সব ছাইপাঁশ শুনছ? ওই সব লেকচার শুনে তোমার কোনো লাভ নেই। পরেশ, তুমি বাইরে চলে এসো। আমরা তোমাকে নিয়ে যাব পরির দেশে। ওই দেশে অনেক আলো। অনেক রং। অনেক মজা’!
বিভ্রান্ত হয়ে যেত পরেশ।
মাথা থেকে উবে যেত শারীরবিদ্যা।
উবে যেত এনাটমির ডিসেকশন।
মাথায় ঢুকে পড়ত পরির দেশের বিচিত্র সব দৃশ্য!
লেকচারের পরও গ্যালারিতে উদাস হয়ে বসে থাকত পরেশ। দুয়েক দিন হোস্টেলের ছাদেও দেখা গেল ওকে। অদৃশ্য কার সঙ্গে যেন বিড়বিড় করে কথা বলছে। ওর কথার কিছুই বোঝা যেত না!
এরপর পরেশের আর কোনো খোঁজ পাইনি। জানি না ও ডাক্তারি পড়া শেষ করতে পেরেছিল কি না। জানি না ও পরির দেশে গিয়েছিল কি না।
আচ্ছা, পরির দেশ কি আসলেই আছে?
যদি থাকে, তাহলে কেমন ওই জগৎটা?
ওই জগৎটা কি রঙিন?
আলো-ঝলমলে?
মানুষ কি ওই জগতে যেতে পারে?
গেলে কি আবার ফিরে আসতে পারে?
কামরুল ছিল বোহেমিয়ান স্বভাবের ছেলে। বাংলায় যাকে বলে উড়নচণ্ডি। খেলাধুলায় যতটা মনোযোগী ছিল, পড়াশোনায় ঠিক ততটাই অমনোযোগী। কামরুলের মনোযোগের প্রধান বিষয় ছিল বাংলা ছায়াছবি। আমাদের বাড়ির দুই মাইলের মধ্যে ছিল ঢাকা শহরের দুটো অভিজাত সিনেমা হল। মধুমিতা ও অভিসার।
প্রতি শুক্রবার ওখানে নতুন নতুন ছবি মুক্তি পেত। বৃহস্পতিবার এলেই কামরুলের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ত। স্কুল থেকে ফেরার পথে ও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নতুন ছবির পোস্টার দেখত। আমাদেরও দেখাত। একসময় ওর হাত ধরেই আমাদের সিনেমা দেখা শুরু।
এক দুপুরের কথা আমার বেশ মনে পড়ে। সেটি ছিল ছুটির দিন। দুপুরের খাবারের পর কেউ পত্রিকা পড়ছে, কেউ গল্পের বই পড়ছে আবার কেউ-বা দুপুরের ঘুমে মগ্ন। পড়ার ঘরে বসে আমি একা একা অঙ্ক করছি আর গান শুনছি। পড়ার টেবিলের ওপর ছোট্ট রেডিও।
অনুষ্ঠানের নাম ‘গানের ডালি’।
ঘোষিকা বললেন, ‘এবারের গানটি শুনতে অনুরোধ জানিয়েছেন রাজশাহী থেকে অনু, মনু, পনু ও ঝুনু। ঢাকা থেকে অনুরোধ জানিয়েছেন স্বর্ণা, বর্ণা ও অপর্ণা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে অনুরোধ জানিয়েছেন আমান, জামান, হেলাল ও বেলাল। গানটি গেয়েছেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ। ছবির নাম “পিচ ঢালা পথ।”
রেডিওর ভেতরে বেজে উঠল গান:
‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে
চুপি চুপি বলে যায়
তোমার আমার সারাটি জীবন
নীরবে জড়াতে চায়’!
কী অদ্ভুত সুন্দর গান!
যেমন গানের বাণী, তেমন সুর আর ততোধিক সুরেলা কণ্ঠ!
আমি অঙ্ক ছেড়ে কখন যে গানের জগতে ডুবে গেছি, তা জানি না।
আমার ঘোর কাটল কামরুলের কথায়। এরই মধ্যে কখন যে কামরুল আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতেই পারিনি।
কামরুল ফিসফিস করে বলল, ‘অয়ন, তৈরি হয়ে নে। আমরা তিনজন এক জায়গায় যাব।’
আমি বললাম, ‘আমরা কোথায় যাব? আর আরেকজন কে?’
কামরুল বলল, ‘তুই, আমি আর অপু- এই তিনজন মিলে সিনেমা দেখতে যাব। অপু কমিউনিটি সেন্টারের সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’
সিনেমার কথা শুনে আমি উত্তেজিত হলাম। তাড়াহুড়া করে রেডি হয়ে কামরুলের সাথে বেরিয়ে এলাম। বাসার দুয়েকজন আমাদের দেখেছে, কিন্তু ওরা ভেবেছে আমরা ফুটবল খেলতে যাচ্ছি। কিছু বলেনি! দুপুরের রোদে দশ-পনেরো মিনিট হাঁটার পর আমরা এসে পৌঁছালাম মধুমিতা সিনেমা হলে।
তখন ওটাই ছিল ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুন্দর ও অভিজাত হল। হলের সামনে বিশাল ভিড়। ওই ভিড় পেরিয়ে টিকিট কাউন্টারে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। টিকিট কাউন্টারে যাওয়ার দরকারও হলো না। কারণ কিছুদূর এগোতেই দেখলাম হলের প্রবেশপথে বিরাট ডিসপ্লে। ওখানে বড় বড় করে লেখা ‘প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ’।
আমরা হতাশ হলাম। হতাশ হলো না কামরুল।
ও বলল, ‘এটা কোনো ব্যাপার না। নতুন ছবি হাউসফুল হবে, এটাই স্বাভাবিক। তার ওপর ছবির নায়ক নায়করাজ রাজ্জাক। তোরা আমার সাথে আয়’!
আমরা নিঃশব্দে কামরুলকে অনুসরণ করলাম। কামরুল চলে এল হলের পেছনে। এখানেও দেখি বিশাল ভিড়।
ওই ভিড়ের মধ্যেই একজন কামরুলকে বলল, ‘কামরুল ভাই, আপনার টিকিট লাগবো?’
আমি আর অপু তো অবাক।
কামরুল বলল, ‘মিজান ভাই, রিয়ার স্টলের তিনটা টিকিট লাগবে। দুই বন্ধুকে নিয়ে এসেছি।’
মিজান ভাই বললেন, ‘কোন সমস্যা নাই’?
কামরুল বলল, ‘কত দিতে হবে, মিজান ভাই?’
মিজান ভাই বলল, ‘কামরুল ভাই, তিন টিকিটের দাম পাবলিকের লিগা পনরো টাকা, আপনার লিগা দশ টাকা’!
আমাদের তিনজনের পকেট হাতড়ে সাকুল্যে পাওয়া গেল চৌদ্দ টাকা।
দশ টাকায় তিন টিকিট নিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম হলে। চার টাকা রইল ইন্টারভ্যালে চানাচুর খাওয়ার জন্য।
যে ছবিটা আমরা দেখলাম, তার নাম ‘আলোর মিছিল’। স্বাধীনতা-উত্তরকালের সামাজিক অস্থিরতা ও বিবেকের অবক্ষয়ের চালচিত্র!
ছবিটা আমাদের ভালো লাগল। খুব বেশি ভালো লাগল ছবির একটি গান। গানটি হচ্ছে:
‘এই পৃথিবী ’পরে
কত ফুল ফোটে আর ঝরে
সে কথা কি কোনো দিন
কখনো কারো মনে পড়ে’!
কামরুলের মতো আমি আর অপুও বাংলা ছবির প্রেমে পড়ে গেলাম।
এ এক নিষিদ্ধ প্রেম!
নদীর সাথে পরিচয়ের পর আমার সেই প্রেম কেটে গেছে!
মিশন স্কুলে পড়ার সময় আমরা থাকতাম স্বামীবাগে। মিশন স্কুল ছিল গোপীবাগে। স্বামীবাগ আর গোপীবাগ পাশাপাশি এলাকা। গোপীবাগ ছিল ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা। সেই তুলনায় স্বামীবাগ ছিল কম ঘন বসতিপূর্ণ। স্বামীবাগের রাস্তাঘাটগুলোও ছিল চওড়া। সময়টা ছিল সত্তর দশকের মাঝামাঝি। ওই সময়ে ওই এলাকায় দোতলা বা তিনতলা বাড়িঘর ছিল না বললেই চলে।
আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল স্বামীবাগ কমিউনিটি সেন্টার। ওই কমিউনিটি সেন্টারের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল নিবিড় ও মধুর। কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে টেবিল টেনিসের টেবিল ছিল। একটামাত্র টেবিল। ওখানে খেলার জন্য আমরা লাইন দিতাম বিশ-পঁচিশ জন। ওখানেই আমাদের টেবিল টেনিসের হাতেখড়ি।
কমিউনিটি সেন্টারের পাশেই সবুজ মাঠ। মাঠের শেষ প্রান্তে বিশাল এক পুকুর। ওই পুকুরে ছিল শানবাঁধানো এক ঘাট। সবুজ মাঠে আমরা ফুটবল খেলতাম। মাঝে মাঝে আড্ডা দিতাম ওই শানবাঁধানো ঘাটে বসে। মাঝে মাঝে দল বেঁধে নেমে পড়তাম পুকুরে। সাঁতারের প্রতিযোগিতায়। অপু খুব ভালো সাঁতার জানত। ওর সাথে আমরা পারতাম না কেউই!
ছুটির দিনগুলোতে আরো বেশি মজা হতো। কোনো কোনো দিন অন্য পাড়া থেকে ফুটবল টিম আসত। আবার কোনো কোনো দিন আমরা যেতাম অন্য পাড়ায়। প্রীতি ম্যাচ খেলতে। যখন আমাদের পাড়ায় খেলা হতো, তখন পাড়ার সবাই আসত খেলা দেখতে। খেলায় আমরা জিতলে কী যে আনন্দ হতো! সবাই পিঠ চাপড়ে বাহবা দিত।
নিজেদের ‘নায়ক নায়ক’ মনে হতো।
আহা! কী অদ্ভুত রকমের সুন্দরই না ছিল সেই সব দিন!
ঠিক যেন ছবির মতো!
গল্পের মতো!
মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, আবার কি ফেরা যায় না সেই দিনগুলোতে?
এই জন্মে না পারি, পুনর্জন্মে আমি ঠিক ঠিক ফিরে যাব সেই দিনগুলোতে।
আমাদের স্কুলের পাশেই ছিল ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব। ব্রাদার্স ইউনিয়ন তখন খেলত সেকেন্ড ডিভিশনে। খেলোয়াড়দের অধিকাংশই ছিল আমাদের পরিচিত। আমাদের বন্ধুবান্ধবদের বড় ভাই অথবা ওনাদের বন্ধুবান্ধব। বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনির মাঠে ওরা প্র্যাকটিস করত। আমরা প্রায়ই যেতাম প্র্যাকটিস দেখতে।
একদিনের কথা আমার খুব মনে আছে। ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের পিকআপ ভ্যানে চড়ে আমরা গেলাম খেলা দেখতে। আউটার স্টেডিয়ামে সেদিন ব্রাদার্সের খেলা ছিল টিটি সেন্টার নামে একটা দলের সাথে। ওই দলটিকে ব্রাদার্স হারাল ১৯-০ গোলে।
ওই খেলায় জিতে ব্রাদার্স দ্বিতীয় বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠল প্রথম বিভাগে। সেই বছর প্রথম বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আবাহনী।
প্রথম বিভাগের চ্যাম্পিয়ন আবাহনী আর দ্বিতীয় বিভাগের চ্যাম্পিয়ন ব্রাদার্স ইউনিয়নের মধ্যে খেলা দিয়ে শুরু হলো প্রথম বিভাগের লিগের খেলা। সবাইকে বিস্মিত করে ওই খেলায় ১-০ গোলে জিতল ব্রাদার্স ইউনিয়ন!
অপু আর আমি স্টেডিয়ামে বসে ওই খেলা দেখলাম। অনেকের মতো আমরাও একটি অনন্য ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গেলাম।
এই রকম কত ইতিহাসের সাক্ষী আমাদের এই জীবন!
দিন যায়, মাস যায়!
বছর যায়!
জীবনের ঘটনা বাড়ে,জটিলতা বাড়ে। বাড়ে স্মৃতি!
কমে শুধু জীবনের জীবনকাল! চলবে….