সিনহা আবুল মনসুর : পর্ব: একুশ
অয়নের ডায়েরি
শনিবার
৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৪।
মা,
আমার মৃত্যুর পর এই ডায়েরিটা অপুকে দিয়ো। এটা ওরই প্রাপ্য। এটা অপুই আগলে রাখবে, যেভাবে গত ষোলো বছর ও আগলে রেখেছিল আমাকে। অপু ডাক্তারি পড়ে। একদিন ডাক্তার হবে। অনেক বড় ডাক্তার। যে রোগে আমি মারা যাচ্ছি, সেই রোগের ওষুধ অপু একদিন আবিষ্কার করবে। হয়তো সেদিন আমার মতো আর কোনো অয়নকে অকালে মরে যেতে হবে না। এ আমার একান্ত বিশ্বাস!
ভুবনখ্যাত স্থপতি এফ আর খানের দেশে আমার জন্ম। মনের সুপ্ত ইচ্ছে ছিল একদিন স্থপতি হব। অনেক বড় স্থপতি। বড় বড় ইমারত বানাব। আকাশটাকে ছুঁয়ে ফেলব!
মা, আমার আকাশ ছোঁয়া হলো না! সবাই কি সবকিছু পারে!
স্পষ্টই টের পাচ্ছি, আমার এই টিমটিমে জীবনটা যেকোনো সময় দপ করে নিভে যাবে।
তা যাক, আফসোস কিসের!
তোমার মতো মা পেয়েছি, বাবার মতো বাবা পেয়েছি।
আরো পেয়েছি অপুর মতো বন্ধু।
তোমাদের অয়ন।
সুধী পাঠক, আমি অপু। অয়ন ওর ডায়েরিতে যে অপুর কথা বলেছে, আমি সেই অপু। ৮ই সেপ্টেম্বরের পর অয়ন আর ডায়েরি লেখেনি। লিখতে পারেনি!
মাথাব্যথা, জ্বর আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে অয়ন হাসপাতালে ভর্তি হলো সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখে। মৃত্যুর সাথে টানা সাত দিন লড়াই করে ও বিদায় নিল সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে, শরতের এক ভোরে!
প্রফেসর হুদা রাউন্ডে এলেন সকাল আটটায়। আমি স্যারকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লাম।
অশ্রসিক্ত কণ্ঠে স্যারকে বললাম, ‘স্যার, অয়ন হেরে গেল। তার চেয়ে বেশি হারলাম আমরা। আমরা ওকে বাঁচাতে পারলাম না’!
হুদা স্যার আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘অপু, মৃত্যু মানে হেরে যাওয়া নয়। মৃত্যু হচ্ছে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। স্বাভাবিক সমাপ্তি। আমার কি মনে হয়, জানো?’
আমি বললাম, ‘কী মনে হয়, স্যার?’
হুদা স্যার বললেন, ‘আমার মনে হয়, Death is the golden key that opens the door to the eternity. মৃত্যু হচ্ছে সেই সোনালি চাবি, যা অনন্তের দরজা খুলে দেয়!
তবে তেইশ বছরের যুবক অয়নের মৃত্যুটাকে মেনে নেওয়া কঠিন’!
অয়ন বড়ুয়া আমার ছেলেবেলার বন্ধু।
কৌশরের বন্ধু।
প্রথম যৌবনের বন্ধু।
ওর সাথে পথ চলেছি এক যুগেরও বেশি। তারপর একদিন হঠাৎ পথটা আলাদা হয়ে গেল! ওরটা থেমে গেল মৃত্যুতে। অথবা চলে গেল অনন্তের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে আমি নামলাম জীবনের পথে। ওই পথটা কখনো সোজা, কখনো বাঁকা!
ওই পথে ফুল ছিল, কাঁটাও ছিল!
এইসব তো দুই যুগ আগের কথা!
অথচ মনে হয় এইতো সেদিন।
মাঝে মাঝে এও মনে হয়, অয়নের সাথে আমার এই যে বেডে উঠা, এই যে একসাথে পথ চলা তা কি আমার এই জীবনের ঘটনা না অন্য জীবনের? তা কি এই পৃথিবীর ঘটনা না অন্য পৃথিবীর?
অয়ন বলতো ‘জানিস অপু কর্মই জীবন! এই জীবনে তুই যদি ভাল কিছু করিস, তাহলে পরের জন্মে তুই ভাল কিছু হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসবি’!
আমার আশেপাশের জন সমুদ্রে লক্ষ কোটি মানুষ। হঠাৎ হঠাৎ দু’য়েকটা ভাল মানুষ চোখে পড়ে।
আমার মনে হয় ওই মানুষটি কি অয়ন!
সমাপ্ত।
‘জীবন এতো ছোট কেন’ গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক ও প্রকাশক
মঈনুল আহসান সাবের লিখেছেন:
এক গভীর জিজ্ঞাসা, এক চিরকালের প্রশ্ন, আবার নতুন করে সামনে এসে দাঁড়ায় সিনহা আবুল মনসুরের ‘জীবন এতো ছোট কেন’ গ্রন্থে। এই প্রশ্ন, এই অনাদিকালের মৌলিক প্রশ্ন বারংবার ফিরে এসেছে আমাদের কাছে। আমরা এই প্রশ্ন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হতে হতে পাশ কাটিয়ে ব্যস্ত হয়েছি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে, কিন্তু এই প্রশ্ন অনায়াসে থেকে গেছে তার প্রবল ও অমীমাংসিত অস্তিত্ব নিয়ে, আমাদের জীবনে।
উপন্যাসের নায়ক, কিংবা মূল চরিত্র অয়নের মাত্র ২৩ বছর বয়সে ক্যান্সার হয়েছে। এক সময় অয়ন জেনে যায়, জেনে যায় চারপাশে তার সতীর্থরা তার সময় ফুরিয়েছে।… কিন্তু সময় কেন ফুরোয়? কিন্তু শুধু কি এই প্রশ্ন? অয়নের মৃত্যুর পর অয়নের ডায়েরি অপুর হাতে এসে পৌঁছায়। এই অপু অয়নের বন্ধু। এই অপুর বয়ানেই জীবন এতো ছোট কেন’-র কাহিনি এগোতে থাকে। আচ্ছা, এই যে আমরা বললাম, কাহিনি এগোতে থাকে-এখানে ‘কাহিনি’ শব্দটিই কি আমরা ব্যবহার করব? আমরা বিকল্প কোনো শব্দ তন্ন তন্ন করে খুঁজতে আরম্ভ করতে পারি। দেখি, একটি একটি নতুন শব্দ আসে, বাতিল হয়ে যায়, টিকে থাকে-কাহিনি। আর, সিনহা আবুল মনসুর আমাদের সেই কাহিনি শোনান। সেই কাহিনিতে ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, নৈতিকতা, বিজ্ঞান ক্রমশ একটি মালায় গাঁথা হতে হতে বিকশিত হয়। বিকশিত হয় এবং আমাদের সামনে একটির পর একটি দরজা খুলে যেতে থাকে। এ সবই মানুষের জীবনের দরজা, এ সব দরজা মানুষ তার সমগ্র জীবনে চেতনে-অবচেতনে বহুবার পার হয়। হয়তো সে সেটা সেভাবে টের পায় না। কিন্তু ‘জীবন এতো ছোট কেন’ টের না পাওয়ার অবকাশটুকু রাখে না। সিনহা আবুল মনসুর, যদিও লিখছেন মনোরম ভাষায়, সে ভাষা সত্যের কর্কশ হাত হয়ে বারবার আমাদের টেনে আনছে, একের পর এক জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। না, এই সব জিজ্ঞাসার উত্তর নেই আমাদের কাছে। আমরা শুধু এর মুখোমুখিই হতে পারি, কোথাও পৌঁছাতে পারি না।
বলেছি, সিনহা আবুল মনসুর লিখেছেন মনোরম ভাষায়। তবে, এভাবে বলা বুঝি আরো ভালো-তিনি লেখেন কাহিনি-উপযোগী ভাষায়। আরো বলি, সিনহা আবুল মনসুর মেধাবী লেখক। আমাদের কাহিনি-সর্বস্ব উপন্যাসের জগতে সিনহার মতো দার্শনিক দৃষ্টিসম্পন্ন লেখকের বড় প্রয়োজন। জীবন এক কাহিনিই বটে, তবে সেই কাহিনির সামনে-পেছনে থাকে আরো কাহিনি, একটি জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে জীবনের বাঁক বিস্তর জিজ্ঞাসা ও রহস্য। এই সবগুলোকে একই সুতোয় গাঁথতে পারেন যে লেখক, তিনিই লেখক, তিনিই সিনহা আবুল মনসুর। রুচিবান, পরিণত পাঠক সাদরে গ্রহণ করুক এ উপন্যাস। সিনহা আবুল মনসুরকে বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসের জগতে স্বাগত জানাই।
মঈনুল আহসান সাবের
ফেব্রি ২০১৬, ঢাকা।
আমি বইয়ের লেখক সিনহা মনসুর আমার বিনীত অনুরোধ আপনি পাঠক হিসেবে কি ভাবছেন তা বলবেন কি?
ধন্যবাদ।