সিনহা আবুল মনসুর : পর্ব: তিন
অয়ন মারা যাওয়ার সাতাশ দিনের মাথায় আমার ডাক পড়ল ওদের বাসায়। অয়নের মা চিঠি লিখেছেন আমার হোস্টেলের ঠিকানায়। ওই চিঠিতে তিনি লিখেছেন:
বাবা অপু,
আমার আশীর্বাদ নিয়ো। তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?
বিশেষ একটা কারণে তোমাকে এই চিঠি লিখছি। দুদিন আগে অয়নের ঘর পরিষ্কার করছিলাম। ওর পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে একটা ডায়েরি পেলাম। ডায়েরির শেষ পাতায় অয়ন লিখেছে:
‘মা, আমার মৃত্যুর পর এই ডায়েরিটা অপুকে দিয়ো। এটা ওরই প্রাপ্য। এটা অপুই আগলে রাখবে, যেভাবে গত ষোলো বছর ও আগলে রেখেছিল আমাকে। অপু ডাক্তারি পড়ে, একদিন ডাক্তার হবে। অনেক বড় ডাক্তার। যে রোগে আমি মারা যাচ্ছি, সেই রোগের ওষুধ অপু একদিন আবিষ্কার করবে। হয়তো সেদিন আমার মতো আর কোনো অয়নকে অকালে মরে যেতে হবে না। এ আমার একান্ত বিশ্বাস।
ভুবনখ্যাত স্থপতি এফ আর খানের দেশে আমার জন্ম। মনের সুপ্ত ইচ্ছে ছিল একদিন স্থপতি হব, অনেক বড় স্থপতি। বড় বড় ইমারত বানাব। আকাশটাকে ছুঁয়ে ফেলব!
… মা, আমার আকাশ ছোঁয়া হলো না। সবাই কি সবকিছু পারে!
স্পষ্টই টের পাচ্ছি, আমার এই টিমটিমে জীবনটা যেকোনো সময় দপ করে নিভে যাবে।
তা যাক, আফসোস কিসের! তোমার মতো মা পেয়েছি, বাবার মতো বাবা পেয়েছি।
আরো পেয়েছি অপুর মতো বন্ধু।
তোমাদের অয়ন’!
অপু, আগামী রবিবার বাসায় কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষু আসবেন। ওরা অয়নের জন্য প্রার্থনা করবেন। তোমার সময় ও সুযোগ হলে রবিবার বাসায় এসো, প্রার্থনায় অংশ নিয়ো। আর অয়নের ডায়েরিটাও নিয়ে যেয়ো।
অপু, নিজের প্রতি যত্ন নিয়ো।
ভালো থেকো।
ইতি
তোমার খালা।
অয়নের মায়ের চিঠিটা পড়ার পর আমার ভেতরটা যেন খালি হয়ে গেল। ধু ধু মরুভূমির মতো। আমার জগত্টা ওলট-পালট হয়ে গেল। প্রচণ্ড সাইক্লোনের ঠিক পরের দৃশ্যের মতো।
ভেতরে আর বাইরে শুনলাম কেবল বজ্রপাতের অবিরাম অমঙ্গল শব্দ।
নিজেই নিজেকে বললাম, অয়ন, তোকে আমরা বাঁচাতে পারিনি, এ আমাদেরই পরাজয়, এ আমাদেরই ব্যর্থতা!
রবিবার সকাল দশটার দিকে গেলাম অয়নদের বাসায়। অয়নের মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। ওর বাবাকে দেখলাম বিষন্ন। অয়নের বাবা অরূপ বড়ুয়া। ধনবান ব্যবসায়ী। বনানী তিন নম্বর রোডে অয়নদের বিশাল বাড়ি। যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময়ে দুয়েকটা উঁচু ভবন ছাড়া বনানীর সব বাড়িই ছিল একতলা বা দোতলা।
ওই সব বাড়ির সামনে ফুলের বাগান আর পেছনে ফলের বাগান। রাস্তাঘাটও থাকত ফাঁকা। এখন তো সবই উঁচু উঁচু ভবন। একতলা বা দোতলা বাড়ি চোখে পড়ে না একটাও। ঢাকা শহরে মানুষ বাড়ছে, দারিদ্র্য বাড়ছে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভবনগুলোর উচ্চতা! আবাসিক ও বাণিজ্যিক!
তার ওপর আছে দোকানপাট ও রেস্তোরাঁ। চোখের সামনে পাল্টে গেল এই শহরের চালচিত্র।
আজ অয়নের মৃত্যুর তিরিশতম দিন।
বসার ঘরে কার্পেটের ওপর চারটা সারি করে বসেছেন পনেরোজন বৌদ্ধ ভিক্ষু। ভিক্ষুদের সামনে বসে আছেন আরো পনেরো-বিশজন। এরা অয়নদের আত্মীয়স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশী। আমি নিঃশব্দে গিয়ে বসলাম সবার পেছনে। পনেরোজন ভিক্ষু সমস্বরে ত্রিপিটক পাঠ করছেন। পাঠ শেষে একজন ভিক্ষু শুদ্ধ বাংলায় বললেন:
‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।’
আমিও বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলাম, ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।’
আমার মনে পড়ল আজ থেকে বহু বছর আগের কথা। আমরা তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র। কলেজ কেন্টিনে বসে চা খেতে খেতে অয়ন বলেছিল, ‘জানিস অপু, মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে হয় বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে যাই। স্বল্প আশা, স্বল্প চাওয়া আর স্বল্প পাওয়া- এই নিয়ে ওদের জীবন। ওদের জীবনে দুঃখবোধ নেই। দুঃখকে ওরা ধারেকাছেও আসতে দেয় না’!
বুয়েটে ঢোকার আগ পর্যন্ত অয়নের এই ইচ্ছেটা খুব প্রবল ছিল। তারপর একদিন ইচ্ছেটা উবে গেল। কর্পূরের মতো। কারণটা মনে হয় নদী। নদী বড়ুয়া!
নদী নামের সেই শেফালি বালিকার গল্প না হয় আরেক দিন বলব।
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। দুপুর বারোটার আগেই ওদের খাবার শেষ করতে হবে। দুপুর বারোটা থেকে পরদিন সকাল ছয়টা পর্যন্ত ওরা পানি এবং চিনিযুক্ত পানি ছাড়া অন্য কিছুই খেতে পারেন না। সকাল ছয়টা থেকে দুপুর বারোটার মধ্যেই সারতে হবে দিন ও রাতের খাবার। ভিক্ষুদের এটাই নিয়ম। ভিক্ষুদের সাথে খাবারে শামিল হলাম আমিও।
একসময় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা চলে গেলেন, চলে গেলেন আমন্ত্রিত অতিথিরাও। অয়নের বাবা-মায়ের ঘরে আমার ডাক পড়ল। এই বাড়ির প্রতিটি কামরাই আমার চেনা। অয়ন জীবিত থাকাকালে এই বাড়িতে শামিম আর আমি অনেক রাত কাটিয়েছি। আমাদের ছিল তারা দেখার শখ। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর অয়ন, শামিম আর আমি- এই তিনজনে মিলে একটা টেলিস্কোপ কিনেছিলাম। ওই টেলিস্কোপ দিয়ে প্রায়ই আমরা রাতের আকাশ দেখতাম।
অয়নই আমাদের প্রথম দেখিয়েছিল ধ্রুবতারা, কালপুরুষ, সপ্তর্ষি। আরো কত কী!
তখন তো বুঝিনি তারা দেখতে দেখতে অয়ন নিজেই একদিন তারার দেশে চলে যাবে!
অয়নের বাবা-মা বসে আছেন সোফাতে। ঘরে ঢুকে আমি বসলাম পাশের সোফাটায়।
অয়নের মা বললেন, ‘বাবা অপু, তুমি আমাদের মাঝখানে এসে বসো।’
কোনো কথা না বলে আমি দুজনের মাঝখানে গিয়ে বসলাম।
অয়নের মা নীল রঙের একটা ডায়েরি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘বাবা, এই ডায়েরিটা আগলে রেখো। হারিয়ে ফেলো না যেন। আর মাঝে মাঝে ডায়েরিটা আমাদের একটু পড়তে দিয়ো। এই ডায়েরিটা পড়লে মনে হয় অয়ন যেন কথা বলছে আমাদের সাথে অথবা আমরা কথা বলছি অয়নের সাথে’!
কথাগুলো বলতে বলতেই অয়নের মায়ের গলা ধরে এল। কাঁদতে শুরু করলেন তিনি। আমি তাকালাম অয়নের বাবার দিকে। ওনার চোখের কোণেও জল।
স্পর্শকাতর এই সব জটিল মুহূর্তে কী বলতে হয়, কী করতে হয়, আমি তা জানি না।
তাই নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলাম মেঝের দিকে। কিন্তু আমারও যে চোখ ভরে উঠল জলে। বর্ণহীন ওই চোখের জল আর কেউই দেখেনি, দেখেছে অয়ন!
মধ্যদুপুরে অয়নের ডায়েরি হাতে নিয়ে আমি রাস্তায় নেমে এলাম। রাস্তায় কড়া রোদ, আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। আমি হাঁটছি। সাথে সাথে হাঁটছে আমার ছায়াও! নিজের ছায়াকেও মনে হলো অচেনা, অশরীরী।
মনটা উদাস হয়ে গেল!
আমার স্পষ্ট মনে পড়ল, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর বেড়াতে গেলাম কক্সবাজার। অয়ন, শামিম আর আমি। সন্ধের একটু আগে আমরা গেলাম সমুদ্রসৈকতে। সৈকতের কিনারা ধরে পা ভিজিয়ে ভিজিয়ে আমরা হাঁটছি। আমার মনে হলো, আমরা হাঁটছি অনন্তের দিকে, অনন্তকাল ধরে! আমাদের এই হাঁটা কখনোই শেষ হবে না!
হাঁটতে হাঁটতেই আমরা একটা জায়গায় এসে বসলাম। আমাদের পেছনে বিশাল ঝাউবন। সামনে আদিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র। বিশাল বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে সাগরতটে। ডানের দিগন্তরেখায় সমুদ্রের ওপারে সূর্য ডুবি-ডুবি। সমুদ্রের একটানা গর্জন ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই।
ওই গর্জন ছাপিয়ে ভরাট গলায় অয়ন আবৃত্তি করল সুনীলের কবিতা-
‘নাস্তিকেরা তোমায় মানে না, নারী
দীর্ঘ ঈ-কারের মতো তুমি চুল মেলে
বিপ্লবের শত্রু হয়ে আছ!
তোমায় আমি আদর করি,
পায়ের কাছে লুটোই
সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে আগুন নিয়ে খেলি
তবু নিজের বুক পুড়ে যায়, বুক পুড়ে যায়
বুক পুড়ে যায়
কেউ তা বোঝে না
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে’!
একসময় সূর্য ডুবে গেল। পেছনের ঝাউবনে ঝিরঝির বাতাস। ওই ঝাউবনের ভেতর দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আমিও আবৃত্তি করলাম সুনীলের কবিতা:
‘সমুদ্রের জলে আমি থুতু ফেলেছিলাম
কেউ দেখেনি, কেউ টের পায়নি
প্রবল ঢেউয়ের মাথায় ফেনার মধ্যে
মিশে গিয়েছিল আমার থুতু
তবু আমার লজ্জা হয়, এত দিন পর আমি শুনতে পাই
সমুদ্রের অভিশাপ’!
সুনীল ছিল আমাদের প্রথম যৌবনের প্রথম বোহেমিয়ান কবি। সতেরো-আঠারো বছর বয়সেই আমরা ওর প্রেমে পড়েছিলাম। সেই প্রেম, সেই ঘোর আমাদের কাটেনি আজও!
আহা, কী অদ্ভুত ছিল সেই সময়গুলো! প্রথম যৌবনের সেই সব দুরন্ত সময়!
অয়ন আবৃত্তি করেছিল, ‘ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।’
অয়ন কি তখন জানত ওর জীবনে ভালোবাসা এবং অসুখ দুটোই আসবে?
ভালোবাসার নরম হাত ধরে ও বাঁচতে চাইবে, কিন্তু পারবে না!
অসুখের কঠিন হাত ওকে জাপটে ধরে নিয়ে যাবে অন্য ভুবনে?
আচ্ছা, ওই ভুবন থেকে মানুষ কি ফিরে আসতে পারে?
মানুষের কি পুনর্জন্ম হয়?
একবার, দুবার অথবা বারবার!
কেউ যদি পুনর্জন্ম নিয়ে বারবার ফিরে আসে, সে কি তার অতীত জন্মের কথা মনে রাখতে পারবে?
অয়ন পুনর্জন্মে বিশ্বাস করত। আচ্ছা, ও কি ফিরে আসবে?
কোনো এক শরতের সকালে এই ঘাসের ওপর, এই রোদ্দুরের নিচে অথবা এই পাখিদের কাছে?
ও কি মনে রাখতে পারবে শামিম আর অপু নামে ওর দুজন বন্ধু ছিল?
যারা ওকে ভালোবাসত। ভালোবাসত জলের মতো! ভালোবাসত রোদের মতো! ভালোবাসত শিশিরের মতো!
উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা অনেকেই অনেক কিছু পাই। টাকাপয়সা, বাড়ি-গাড়ি, মান-সম্মান, রোগ-শোক, ভালোবাসা-ঘৃণা। আরো কত কী! ব্যক্তির যেমন উত্তরাধিকার আছে, উত্তরাধিকার আছে পরিবারের, সমাজের এবং দেশেরও। উত্তরাধিকার আছে বন্ধুত্বেরও!
আমার পূর্বপুরুষেরা ধনবান ছিলেন, বলবান ছিলেন, ছিলেন অমিতব্যয়ীও! পরিণামে হয়েছেন অর্থহীন এবং প্রতাপহীন। তাই পারিবারিক উত্তরাধিকারে দারিদ্র্য, শত্রæতা এবং ঋণের বোঝা ছাড়া পাইনি তেমন কিছুই। তবে বন্ধুত্বের উত্তরাধিকারে অয়নের কাছ থেকে যা পেলাম, সে যে মূল্যহীন, অমূল্য।
মূল্যবানকে পুরো মূল্য চুকিয়ে দিই সেই সামর্থ্য তো আমার নেই। তবে এই মহার্ঘ যদি আপনাদের সাথে একটু ভাগাভাগি করে নিই, তবে তার মূল্য বাড়বে বই কমবে না!
অয়নের ডায়েরিটা আমি পড়েছি বারবার। যতবারই পড়েছি, ততবারই আবেগে আপ্লæত হয়েছি।
আনন্দ পেয়েছি। দুঃখ পেয়েছি। হেসেছি। কেঁদেছি।
ফিরে গিয়েছি শৈশবে, কৈশোরে অথবা প্রথম যৌবনের সেই মাতাল দিনগুলোতে!
অয়ন ওর ডায়েরিতে জীবনের কিছু কিছু মৌলিক প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছে। কিছু কিছু প্রশ্ন করেছে।
প্রশ্ন করেছে নিজেকে। প্রশ্ন করেছে আমাদেরও। ওর বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না।
প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে আমি কখনো বিজ্ঞানের কাছে গিয়েছি। কখনো দর্শনের কাছে গিয়েছি। কখনো ইতিহাসের কাছে গিয়েছি। কখনো-বা ফিরে এসেছি ধর্মের কাছে।
বিজ্ঞান কিছু উত্তর দিয়েছে। দর্শন কিছু উত্তর দিয়েছে। ইতিহাস কিছু উত্তর দিয়েছে। ধর্মও দিয়েছে কিছু কিছু। কিন্তু পুরোটা পাইনি।
অয়ন, আমি বা আমরা উত্তর পাইনি, তাতে কী!
পাঠকের কাছে হয়তো এর উত্তর আছে।
সুধী পাঠক, মনের সেই সুপ্ত ইচ্ছে থেকেই অয়নের ডায়েরিটা আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করব!
চলবে……..
সিনহা মনসুর।
পুনশ্চ: লেখাটি ভাল লাগলে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।