সিনহা আবুল মনসুর : পর্ব: বিশ
বৃহস্পতিবার
৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৪।
মাঝে মাঝেই আমি ভাবি, আমার এই ছোট্ট জীবনে কতশত ঘটনা ঘটেছে! এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা কোনটি?
আমার মনে হয়, সবচেয়ে বড় ঘটনাটি হচ্ছে আমার নিজের জন্ম! নিজের জন্মকে সবচেয়ে বড় ঘটনা বলছি এজন্য যে, আমার জন্ম না হলে তো পরের ঘটনাগুলো আমার জীবনে ঘঠতই না। সেই অর্থে আমার জন্মই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা! যেদিন মরে যাব, অর্থাৎ আমার মৃত্যুদিনটি হবে আমার জীবনের দ্বিতীয় বড় ঘটনা!
চিটাগাংয়ের পাহাড়তলীতে আমার জন্ম। শৈশবে বাবার ব্যবসা উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ চলে আসা। ওখানে অপুর সাথে পরিচয়। এই পরিচয় আমার জীবনের বিরাট এক অর্জন। দুরন্ত শৈশব আর কৈশোরে অপু আর আমি কত কিছুই না করেছি!

কৈশোরে ঢাকায় এলাম। অপু আর আমি ভর্তি হলাম মিশন স্কুলে। মিশন স্কুলে পড়াশোনার সুবাদে পরিচয় হলো দিলীপের সাথে। পরিচয় হলো কামরুলের সাথে। কামরুলের হাত ধরে আমাদের বাংলা সিনেমা দেখার সূচনা। সূচনা ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা দেখারও।
মিশন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বিজয় স্যার। বিজয় স্যার ছিলেন অপু আর আমার আসল শিক্ষাগুরু। আমাদের সাহিত্যপাঠের শুরুটা তো ওনার হাতেই। ক্লাস সেভেনের পর কামরুল চলে গেল নবাবপুর হাইস্কুলে। দিলীপ গেল সেইন্ট গ্রেগরীতে। অপু আর আমি এলাম ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে। ওখানে বন্ধুত্ব হলো শামিম আর উপলের সাথে।

তারপর ঢাকা কলেজ। হঠাৎ করেই অবারিত স্বাধীনতা। একদিকে পড়াশোনা। তার সাথে সাথে খেলাধুলা, আড্ডা আর রাজনীতি। এর বাইরেও কেউ কবিতা লিখছে, কেউ গল্প লিখছে। এই সময়ে আমাদের জীবনে এলেন আর একজন। যার কথা আলাদেভাবে না বললেই নয়! তিনি আমাদের বাংলার শিক্ষক প্রফেসর আবদুল্লা আবু সায়ীদ। তিনি যতটা না শিক্ষক তার চাইতে বেশি ছিলেন দার্শনিক!
প্রথম বর্ষে তিনি আমাদের রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ পড়াতেন! কয়েক পাতার একটি গল্প! পুরো বছরেও তিনি সেই গল্পটি শেষ করতে পারেননি! পারবেন কি করে? ওই একটি গল্প পড়াতে গিয়ে তিনি আমাদের সামনে উন্মোচন করেছেন জগত-সংসারের ইতিকথা! কি ছিল না তার ওই ইতিকথায়?
শিল্প-সাহিত্য!
ইতিহাস, বিজ্ঞান, রাজনীতি!
সব আলাপই তিনি করতেন!

আমাদের প্রথম যৌবনে তিনিই ছিলেন প্রকৃত শিক্ষক! তার হাত ধরেই জীবন ও জগত সম্পর্কে আমাদের চিন্তার শুরু! স্যারের স্বপ্ন ছিল ‘বিশব সাহিত্য কেন্দ্র’ গড়ে তোলার। প্রায়ই তিনি আমাদেরকে ওই স্বপ্নের কথা বলতেন।
স্যার বলতেন:
‘কি জানো মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’!
আমার প্রিয় শিক্ষক আবদুল্লা আবু সাইয়ীদ স্যার বলেছিলেন:
‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’!
আমি স্যারের শিষ্য,অয়ন আমি বলি:
‘মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়’!
কেননা এই মানুষই চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছে।
চাঁদ গিয়েছে!
স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছে!
কিন্তু তার স্বপ্ন থেমে থাকেনি!
চাঁদ জয় করার পরে মানুষ স্বপ্ন দেখেছে মংগলে যাওয়ার। একদিন সেখানেও যাবে!

আবার নূতন স্বপ্ন দেখবে আরেক গ্রহে যাওয়ার! মানুষ প্রতিনিয়ত নিজেই নিজেকে অতিক্রম করেছে এবং করবে!
কাজেই ‘মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়! সে থেমে থাকে না! যে রোগে আমি মারা যাচ্ছি মানুষ একদিন তাও জয় করবে! হয়তো আমি দেখে যেতে পারবে না। ভবিষ্যত প্রজন্ম দেখবে!
ঢাকা কলেজে আমার সাথে বন্ধুত্ব হলো আরো অনেকের। এর মধ্যে ফয়সাল, জালাল, অমি, হাবিবও বাদশা সবিশেষ উল্লেখ্য! ফয়সাল, জালাল আর অমি এই তিনজনের কথা আগেই বলেছি। এবার বলি হাবিব আর বাদশার কথা।
হাবিব আর বাদশা দুজনেই রাজনীতি করত। এই হাবিব হচ্ছে কামরুল-হাবিব পরিষদের হাবিব। ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে হাবিব ছিল মুজিববাদী ছাত্র লীগের জিএস পদপ্রার্থী। বাদশা হচ্ছে মোহন-বাদশা পরিষদের বাদশা। জাসদ ছাত্র লীগের জিএস পদপ্রার্থী।
নির্বাচনে জিতল কামরুল-হাবিব পরিষদ।কামরুল ভাই ভি.পি, হাবিব জি.এস! কিন্তু তাতে কী! ক্যাম্পাসে মোহন দা তখনো কাংখিক, বাদশা তখনো নেতা! মোহন দা কবিতা লিখতেন। ক্যাফেটেরিয়ার মোহন দা বসতেন। চারপাশ ঘিরে বসতাম আমরা। মোহন দা গতরাতে লেখা সদ্যজাত কবিতাটি আমাদের পড়ে শোনাতেন। কখনো কখনো টেবিলে বসেই লিখে ফেলতেন নূতন কবিতা!

রাজনীতির মঞ্চে দুজন দুই মেরুর হলেও হাবিব আর বাদশা পরস্পর পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু ছিল! আমরা এক টেবিলে বসে কত আড্ডা মেরেছি।
চায়ের কাপে কত ঝড়!
কত বৃষ্টি!
কিন্তু মারামারি বা হাতাহাতি হয়নি কখনো! রাজনীতি তখনো যে নোংরা হয়নি।! কলুষিত হয়নি!
ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ই আমার সাথে পরিচয় হলো এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর। আমার সমান বয়স ওর!
ওর সংযমী ব্যবহার, স্বল্পাহারী ও নির্লোভ জীবনযাপন পদ্ধতি আমাকে আকৃষ্ট করত। ভেতরে ভেতরে নাড়া দিত।মাঝে মাঝেই আমার মনে হতো, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে ওর মতো বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে যাই!
হয়েও যেতাম যদি না তার কিছুদিন পর নদীর সাথে আমার দেখা হতো! নদীর সাথে দেখা হতেই আমার সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। আমি ধরা পড়লাম সৌন্দর্যের কাছে!রূপের কাছে!
আর ভালোবাসার কাছে!
বৌদ্ধ ভিক্ষু হবার ধারণাটা আমার মাথা থেকে উবে গেল।
ব্যাপারটা নিয়ে আমি অপুর সাথে আলাপ করেছি।
অপুকে বলেছি, ‘অপু, আমি কি হেরে গেলাম? নিজের কাছে? আমার রিপুর কাছে?’

অপু বলেছে, ‘অয়ন, মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মানুষ তার জীবনে বারবার হারে। কখনো অর্থের কাছে!
কখনো বিবেকের কাছে!

আবার কখনো-বা সময়ের কাছে!
এর পরও মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। সময়ের স্রোতটাকে পাল্টে দিতে চায়। কিন্তু তার পরও হারে।
বন্ধুত্বের কাছে!
ভালোবাসার কাছে!’
অপু আরো বলেছে, ‘অয়ন, মানুষের সবচেয়ে বড় হার কোথায়, জানিস? এত কিছুর পরও মানুষ আবারও হারে।
মরণের কাছে!
এই হার থেকে কারোরই মুক্তি নেই’!
অপুর সেই দিনের সেই কথা যে,আমার নিজের জীবনে এসে পড়বে তা স্বপ্নেও চিন্তা করিনি! আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ বলেছেন:
‘প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়’!
বারান্দায় বসে বসে আমি যখন অর্থ, বিবেক, সময়, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা আর মরণের কাছে মানুষের হেরে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম, তখনই এল অপু আর সাঈদ।
সাঈদের হাতে একটা বই।

বইটা আমার হাতে দিয়ে ও বলল, ‘অয়ন, এই বইটা আমার মামা আমাকে পাঠিয়েছেন, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে।গত সাত দিন ধরে বইটা আমি পড়েছি। ভিন্ন রকমের একটি বই। আমার খুব ভালো লেগেছে। তুমিও পড়ো। তোমারো ভালো লাগবে’!
বইটির নাম ‘দ্য বুক অব লাইফ: কোয়েশ্চেনস ফর দ্য গেইমস অব লাইফ অ্যান্ড লাভ’। লেখক দুজন। একজনের নাম ইভলিন ম্যাকফার্লিন। অন্যজনের নাম জেমস সেওয়েল।
আমি বললাম, ‘এটা কি ফিকশন, না নন-ফিকশন?’
সাঈদ বলল, ‘মজার ব্যাপার কী জানো, বইটি ফিকশন বা নন-ফিকশন কোনোটাই নয়।বইটিতে কোনো গল্প নেই। নায়ক-নায়িকাও নেই। অন্য কোনো চরিত্রও নেই। আছে শুধু কতগুলো প্রশ্ন। কতগুলো প্রস্তাবনা। প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তরও নেই। উত্তর দেবে পাঠক’!
আমি বললাম, ‘সেটা কী রকম?’
সাঈদ বলল, ‘দাঁড়াও, বই থেকে তোমাদের তিনটি প্রশ্ন করি। তোমরা তাহলেই বুঝবে ব্যাপারটা’!

এটা বলেই সাঈদ পরপর তিনটি প্রশ্ন করল:
প্রশ্ন এক: যদি তোমাকে সুযোগ দেওয়া হয় জীবনটাকে নতুন করে শুরু করার, তাহলে কী হতে চাইবে? যা আছ তাই, না অন্য কিছু?
প্রশ্ন দুই: যদি তোমাকে সুযোগ দেওয়া হয় ইতিহাসের বিখ্যাত কারো সাথে দুই ঘণ্টা সময় কাটানোর জন্য, তাহলে তুমি কার সাথে সময় কাটাতে চাইবে?
প্রশ্ন তিন: যদি তোমাকে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে কোথায় থাকতে চাও?
তিনটি প্রশ্নই আমি মন দিয়ে শুনলাম। সাঈদকে বললাম, ‘সাঈদ, তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলি, যদি নতুনভাবে এ জীবন শুরু করার কোনো সুযোগ পাই, তাহলে আমি একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু হতে চাইব!

তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর:
পূর্ণিমার রাতে দুই ঘণ্টা সময় কাটাতে চাইব সিদ্ধ পুরুষ গৌতম বুদ্ধের সাথে। তাকে আমি জিজ্ঞেস করব, প্রভু, কিসের তাড়নায়, কিসের টানে আপনি স্ত্রী-পুত্র-পরিজন আর প্রাসাদ ছেড়ে এক বস্ত্রে পথে নেমেছিলেন?
যার তাড়নায় পথে নেমেছিলেন, তা কি আপনি পেয়েছেন?
সাঈদ, তোমার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর: এই দেশ ছেড়ে আমি আর কোথাও যাব না। এই দেশে আমার জন্ম। এই দেশেই হোক আমার মৃত্যু’! চলবে