সিনহা আবুল মনসুর : পর্ব: উনিশ
শনিবার
১লা সেপ্টেম্বর ১৯৮৪।
কেমোথেরাপির পর আমি আর ক্লাসে ফিরে যাইনি। যাওয়ার তাড়াও অনুভব করিনি। বাবা-মা দুজনেই বললেন, অয়ন, কিছুদিন বিশ্রাম নাও। আমার শিক্ষকদেরও ওই একই মত। অধিকাংশ সময়ই আমি বাসায় থাকি। গল্পের বই পড়ি। ভিডিওতে পছন্দের ছবি দেখি। বন্ধুবান্ধব আসে। ওদের সাথে গল্প করি। আর দিন শেষে রাতে ডায়েরি লিখি। এত সবের পরও মাঝে মাঝেই আমি একা হয়ে পড়ি!
খুব একা!
ওই সময়টা কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ভিডিও দেখতে ভালো লাগে না। গল্পের বইয়েও মন বসে না!
ওই সময়টাতে আমি আমার ঘরের পেছনের বারান্দায় গিয়ে বসি। বারান্দাটা পরিপাটি করে সাজানো। ওখানে সারি সারি অর্কিড ঝোলানো। বারান্দার সামনের লনে রজনীগন্ধা, হাসনাহেনা আর গোলাপের বাগান!
বারান্দায় ওই অর্কিডগুলো ঝুলিয়েছে নদী। রজনীগন্ধা, হাসনাহেনা আর গোলাপের বাগানও নদীর হাতে করা। আইডিয়া, প্ল্যানিং আর বাস্তবায়ন- সবই নদীর! আমি শুধু জোগাড়যন্ত্র করেছি। বারান্দা ও বাগান- সব জায়গাতেই আছে নদীর উপস্থিতি আর নদীর ছোঁয়া!
আর তাই পেছনের বারান্দায় এলেই আমার মনে হয়, আমি যেন নদীর কাছে এসেছি। অথবা নদী এসেছে আমার কাছে। মন খারাপ হলে মাঝে মাঝেই আমি অর্কিডগুলোর সাথে একমনে কথা বলি।
কতশত কথা!
আমার মনে হয়, আমি যেন কথা বলছি নদীর সাথে!
নদীকে দেখার ইচ্ছে হলে আমি বাগানের ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওদের রং দেখি, রূপ দেখি। আমার মনে হয়, আমি যেন দিব্যি তাকিয়ে আছি নদীর দিকে!
গতকাল বিকেলে আমার ভীষণ মন খারাপ ছিল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসেছিলাম পেছনের বারান্দায়। একমনে তাকিয়েছিলাম অর্কিডগুলোর দিকে। ওভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আমার মনে পড়ল গত বছরের একটি দিনের কথা। ওইটি ছিল ছুটির দিন। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি নদীর সাথে ছিলাম।
দুপুরে নদী আর আমি লাঞ্চ খেলাম শাহবাগের ‘মৌলি’তে। লাঞ্চ খেতে খেতেই নদীকে বললাম, ‘নদী, সত্যজিৎ রাতের ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটা দেখেছ?’
নদী বলল, ‘না, দেখিনি।’
আমি বললাম, ‘ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টারে আজ বিকেলে ছবিটা দেখাবে। চল দেখে আসি।’
নদী বলল, ‘তাই! এই ছবিটার অনেক নাম শুনেছি। এখনো দেখিনি। চলো যাই।’
খাওয়াদাওয়া শেষে কফি খেতে খেতে আমরা গল্প করলাম আরো কিছুক্ষণ। ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টারে এসে পৌঁছালাম বিকেল তিনটায়। ছবি শুরু হলো সোয়া তিনটায়।
আমরা ডুবে গেলাম অপু আর দুর্গার পাঁচালিতে। ওই পাঁচালি আমাদের হাত ধরে নিয়ে গেল শৈশব আর কৈশোরে। একটি দৃশ্যে দেখলাম অপু আর দুর্গা বৃষ্টির জলে ছুটোছুটি করছে। ওদের সে কী উচ্ছ্বাস! পরের দৃশ্যেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অপু। দূর থেকে অপুকে ভেংচি কাটছে দুর্গা!
বৃষ্টি আর বাতাসে অপুর সারা শরীর কাঁপছে। বোনের ভেংচির কোনো উত্তর দিতে পারছে না অপু। কী নিষ্পাপ ওর চাহনি! কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর ছোট্ট শরীরটা। একসময় দুর্গা এসে ওকে জড়িয়ে ধরল শাড়ির আঁচল দিয়ে। কী অপূর্ব মায়ার জাল!
আরেক দৃশ্যে কাশবনের ভেতর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে অপু আর দুর্গা। কাশবনের ওপাশে ট্রেনের হুইসেল। কাশবন পেরিয়ে ওরা জীবনে প্রথমবারের মতো ট্রেনের মুখোমুখি। ওদের চোখে-মুখে অপার বিস্ময়।
অপু, দুর্গা, সর্বজয়া আর হরিহর- এই চারটে হলো পথের পাঁচালীর মূল চরিত্র। কিন্তু মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়েছে, এই চারজনকে ছাপিয়ে গেছেন বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকরুন। মনে হয়েছে, এই চরিত্রটাই যেন পথের পাঁচালীর সবচে শক্তিশালী চরিত্র!
ইন্দির ঠাকরুনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন চুনিবালা দেবী। কিন্তু তার অভিনয়কে মোটেই অভিনয় বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছে ৮৩ বছর বয়স্ক চুনিবালা দেবীর জন্ম হয়েছে পথের পাঁচালীর ইন্দির ঠাকরুন হবার জন্যই!
ছবিতে ইন্দির ঠাকরুনের কণ্ঠে একটা গান আছে:
‘যারা পরে এল,
আগে গেল
আমি রইলাম পড়ে
ওরে দিন যে গেল,
সন্ধে হলো,
পার করো আমারে’!
এই গান শরীর ও মন দুটোই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।
ছবি শেষ হলো সন্ধের একটু আগে। নদীকে হোস্টেলে পৌঁছে দিতে হবে। গাড়ি আনিনি। তাই রিকশা নিলাম। রিকশায় উঠেই নদীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নদী, বিভূতিভুষণের উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ পড়েছ?’
নদী বলল, ‘না, তবে স্কুলে পড়ার সময় আমি ওটার কিশোর সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেপু’ পড়েছি।’
আমি বললাম, ‘স্কুলে পড়ার সময় তোমার মতো আমিও ‘আম আঁটির ভেপু! পড়েছিলাম। আমার বন্ধু অপু আমাকে বইটা দিয়েছিল। মূল উপন্যাসটা পড়েছি ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর।
উপন্যাসটা পড়ার পর আমি বেশ কয়েক দিন ঘুমুতে পারিনি।’
নদী বলল, ‘কেন? ঘুমুতে পারোনি কেন?’
আমি বললাম, ‘ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভীষণ বিমোহিত হয়েছিলাম। উপন্যাসের চরিত্র অপু, দুর্গা, ওদের মা সর্বজয়া, বাবা হরিহর আর অদ্ভুত এক চরিত্র ইন্দির ঠাকরুন, আমার মাথার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি বিমোহিত করেছিল অপু।
গাছের মতো সরল!
পানির মতো তরল!
আর আকাশের মতো উদার!
ছোট্ট ওই বালক আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল!
উপন্যাসটা পড়ার পর আমি কেবল মনে মনে ভাবতাম, মানুষ এত সুন্দর করে কিভাবে লেখে?
জানো নদী, ওই প্রথম আমার লেখক হওয়ার সাধ হয়েছিল। মনে মনে স্বপ্ন দেখেছিলাম, কোনো একদিন লেখক হব।
চারপাশের মানুষের কথা লিখব! মানুষের স্বপ্নের কথা লিখব, সংগ্রামের কথা লিখব, মানুষের বাঁচার কথা লিখব’!
নদী বলল, ‘অয়ন, তুমি কিন্তু ভাবো লেখকদের মতো, কথাও বলো লেখকদের মতো। তুমি লিখবে। অবশ্যই লিখবে’!
আমি বললাম, ‘নদী, সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না। আমার সাধ আছে, কিন্তু সাধ্যি নেই।’
নদী বলল, ‘অয়ন, আমি জানি, তোমার সাধ এবং সাধ্যি দুটোই আছে। তুমি লিখতে শুরু করো। তুমি অবশ্যই পারবে।’
ওই দিনই আমি প্রথম বুঝলাম আমার ওপর নদীর সে কী বিশ্বাস, সে কী আস্থা! মনে মনে ভাবলাম, এই বিশ্বাস আর এই আস্থার মূল্য আমি কি দিতে পারব?
ভাবতে ভাবতেই আমি আনমনা হয়ে গেলাম।নদীর প্রশ্নে আমার আনমনা ভাবনায় ছেদ পড়ল। নদী জিজ্ঞেস করল, ‘অয়ন,! পথের পাঁচালী’ ছবিটা তুমি আগে কবার দেখেছ?’
আমি বললাম, ‘ছবিটা আমি একবার-দুবার নয়, দেখেছি তিনবার। আজ দেখলাম চতুর্থবার!
নদী বলল, ‘ছবিটা তোমার এত ভালো লাগে?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ নদী, এটা আমার খুবই পছন্দের একটা ছবি। এই ছবিটা দেখে আমার মতোই বিমুগ্ধ হয়েছিলেন কলকাতার বুদ্ধিজীবী অমিতাভ ঘোষ!
অমিতাভ ঘোষ, সত্যজিৎ রায়কে একটা চিঠি লিখেছিলেন। ওই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন:
‘গুণী মানুষদের সম্মান জানানোর জন্য জাপানি একটি রীতি রয়েছে। তারা গুণী মানুষটির বাড়ির সামনে গিয়ে একা নিশ্চুপভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের বাড়ির ভেতরে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। আপনি পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি, যাকে আমি সেভাবে সম্মান জানাতে চাই।’
নদী বলল, ‘অমিতাভ ঘোষ সত্যজিৎ রায়কে ওভাবে সম্মান জানাতে পেরেছিলেন?’
আমি বললাম, ‘তা আমি জানি না। তবে আমি আমার মতো করে ওনাকে, মানে সত্যজিৎ রায়কে সম্মান দেখিয়েছি।’
নদী বলল, ‘অয়ন, তুমি কী করেছ, কিভাবে ওনাকে সম্মান দেখিয়েছ?’
আমি বললাম, ‘নদী, আমি নিজ হাতে সত্যজিৎ রায়ের একটি ভাস্কর্য বানিয়েছি। আমার বন্ধুরা সবাই জানে।ওই ভাস্কর্যটি আছে আমাদের বাড়িতে। তোমাকে দেখাব একদিন।’
আমার কথা শুনে অবাক আর অপলক দৃষ্টিতে নদী তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘অয়ন, তুমি এত অনুভূতিপ্রবণ, এত সৃষ্টিশীল একজন মানুষ! আমার ইচ্ছে হচ্ছে এখনি তোমার কপালে একটা চুমু খাই।’
কথাটা বলে আর অপেক্ষা করেনি নদী। আলতো করে চুমু খেলো আমার কপালে!
আমার মনে হলো, আহা! জীবন কত সুন্দর!
বেঁচে থাকা কত ঐশ্বর্যময়!
এই সব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে, আমি জানি না। আকাশে থালার মতো একটা চাঁদ উঠেছে।
ফিনিক ফোটা তার জোছনা!
জোছনার আলো ছড়িয়ে পড়ছে বারান্দায় ঝোলানো অর্কিডের ওপর। সামনের রজনীগন্ধা, হাসনাহেনা আর গোলাপ বাগানের ওপর।
পৃথিবীটাকে বড় রহস্যময় আর অপার্থিব মনে হয়! ওই অপার্থিব জোছনায় আমার মনে পড়ে অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা! আমি বিড বিড করে আবৃত্তি করি:
‘অতন্দ্রিলা,
ঘুমোওনি জানি
তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি, শোনো,
সৌরতারা-ছাওয়া এই বিছানায়
সূক্ষজাল রাত্রির মশারি-
কত দীর্ঘ দুজনার গেল সারা দিন,
আলাদা নিশ্বাসে-
এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই
কী আশ্চর্য দুজনে দুজনা-
অতন্দ্রিলা,
হঠাৎ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোৎস্না,
দেখি তুমি নেই’! চলবে