সিনহা আবুল মনসুর : পর্ব: আঠার

অয়নের ডায়েরি
বুধবার
২৯শে আগস্ট ১৯৮৪।
কেমোথেরাপির পর শেষ কবে দুঃস্বপ্নহীন রাত কাটিয়েছি আমার তা মনে নেই! গত তিন সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন সকালে আমার ঘুম ভেঙেছে কখনো ভোর চারটায়, কখনো-বা ভোর পাঁচটায়। প্রতিটি রাত ছিল দুঃস্বপ্নের রাত!
বহুদিন পর আজ খুব ভালো ঘুম হলো। সকালে অনেকক্ষণ ঘুমালাম। ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে আটটায়। গত রাতটি ছিল দুঃস্বপ্নহীন একটি রাত! আমার খাটের পাশেই পড়ার টেবিল। পড়ার টেবিলের ওপর ক্যাসেট প্লেয়ার। গান শুনতে শুনতেই গত রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
বিছানায় শুয়ে থেকেই আমি হাত বাড়িয়ে ক্যাসেট প্লেয়ারের সুইচ অন করলাম। ক্যাসেটে বেজে উঠল:
‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম
প্রেম মেলে না
শুধু সুখ চলে যায়
এমনি মায়ার ছলনা।’

সাগর সেনের ভরাট গলা বুকে গিয়ে বাঁধে! মনে মনে ভাবলাম, রবীন্দ্রনাথ কত সহজেই কত জটিল কথা বলে দিয়েছেন। এই জন্যই তিনি রবীন্দ্রনাথ! প্রেম আর সুখের কথা আসতেই মনে পড়ল নদীর কথা। মনে পড়ল আজ নদীর জন্মদিন। এর আগে তিন-তিনটা জন্মদিন নদীর সাথে কাটিয়েছি। নদীর সাথে পরিচয় হবার পর এটা হবে নদীর চতুর্থ জন্মদিন!
আমার মনে পড়ে নদীর সাথে পরিচয় হবার পর ওর প্রথম জন্মদিনটার কথা।
ওটা ছিল ছুটির দিন।
আমি ছিলাম পুরোপুরি সুস্থ।
নদী ফুল ভালোবাসে। কিন্তু ঢাকা শহরে তখন হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র ফুলের দোকান। তাই খুব ভোরে গিয়েছিলাম ফুলের সন্ধানে। সংগ্রহ করে এনেছিলাম নদীর প্রিয় রজনীগন্ধা আর সাদা গোলাপ! নদীর হাতে তুলে দিয়েছিলাম একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। এগারোটি শ্বেত গোলাপ আর একটা চিরকুট!
ওই চিরকুটে লিখেছিলাম:
‘কলি হচ্ছে সেই কথা যা বলা হয়নি।

আর ফুল হচ্ছে সেই কথা যা বলা হয়েছে। নদী, আমার বাগানে তুমি আর কলি নও, তুমি হলে ফুল’!
ওই একই চিরকুটে আমি আরো লিখেছিলাম:
‘যে সমুদ্র সবচেয়ে সুন্দর, তা আজও আমরা দেখিনি! যে শিশু সবচেয়ে সুন্দর, তা আজও ভূমিষ্ঠ হয়নি!
নদী, আমি তোমাকে সবচেয়ে সুন্দর সেই সমুদ্র আর সবচেয়ে সুন্দর সেই শিশু দুটোই দেখাব’!
সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্র আমি নদীকে দেখাতে পারিনি! সবচেয়ে সুন্দর শিশুও আমি নদীকে দেখাতে পারিনি! পারব, সেই সম্ভাবনাও নেই!
হায়!
জীবন এমন কেন!
মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক।
এর নামই বোধ হয় নিয়তি!
জীবনের যাত্রা পথে আমি কি ভুল করে ভুল ট্রেনে উঠেছিলাম?
ওই ট্রেন থেকে কি নেমে যাওয়া না!
ওই ট্রেনে কি কোন গতি রোধক লাল শিকল নেই?
আমি কি ট্রেন থেকে লাফ দেব?
না, সেটা তো হবে আত্মাহুতি!
আমি কেন আত্মহত্যা করবো?
আমি তো পরাজিত নই!

আমাকে হয়তো সৃস্টিকর্তা পছন্দ করেছেন! ও ধস ঃযব পযড়ংবহ ড়হব! ধূলো মলিন এই পংকিল ধরায় তিনি হয়তো আমাকে বেশিদিন রাখতে চান না! তাই হয়তো তিনি আমাকে এই রোগটি উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন!
আমি কি সৃস্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি?
হ্যাঁ,ঠিক তাই!
আমার মনে কেউ একজন আছেন।
সৃস্টির আদিতে! সৃস্টির শুরুতে!
এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতে!
কেউ একজন অবশ্যই আছেন!
নিরাকার! অতীত, বতর্মান আর ভবিষ্যতের নিয়ামক!
পর্দার ফাঁকফোকর দিয়ে ঘরে রোদের আলো ঢুকে পড়ছে।
ওই রোদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই আমার মনে পড়ল নদীর সাথে কাটানো দ্বিতীয় জন্মদিনটার কথা। সেদিন আমরা ঢাকায় ছিলাম না। ছিলাম পাহাড়পুর। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে। ডিপার্টমেন্ট থেকে আমরা ওখানে গিয়েছিলাম শিক্ষাসফরে।

পাহাড়পুর বিহার একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত সুপ্রাচীন বৌদ্ধ বিহার।এর আদি নাম সোমপুর বিহার।পুরো বিশ্বে এ পর্যন্ত জ্যামিতিক নকশার যেসব পুরাকীর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে, বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড়পুর তার মধ্যে অন্যতম সেরা। এই বিহারের মূল ইমারতের নির্মাণকৌশল অভিনব এক স্থাপত্যকলার নিদর্শন!
ওই স্থাপত্যকলা খুব কাছ থেকে অবলোকন করাই ছিল আমাদের সফরের মূল উদ্দেশ্য। বৌদ্ধধর্মের অনুশাসনমূলক বইতে মোট পাঁচ ধরনের আবাসনের উল্লেখ আছে।
এগুলো হচ্ছে: বিহার, আদ্যযোগ, প্রাসাদ, হাম্মীয় ও গুহা। বাংলাদেশে পাওয়া প্রত্ম-স্থাপত্যের মধ্যে বিহারই বেশি।

পাহাড়পুর হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ বিহার। আয়তনে এটি ভারতের নালন্দা মহাবিহারের প্রায় সমান। সুদীর্ঘ তিনশত বছর ধরে এই বিহার বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত একটি ধর্মচর্চা কেন্দ্র ছিল। এই বিহারে চীন, তিব্বত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন।
ইতিহাসবিদদের মতে, পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল অষ্টম শতকের শেষের দিকে এ বিহার নির্মাণ করেছিলেন। খ্রিষ্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলেন বিক্রমপুরের অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান!
কারো কারো মতে, এখানে একটি জৈনমন্দির ছিল। আর সেই মন্দিরের ওপরই গড়ে তোলা হয়েছে এ বিহার। মোট সাতাশ একর জমির ওপর এই বিহার। একসময় এই বিহারে মোট একশত সাতাত্তরটি ঘর ছিল। ঘরগুলোতে মোট আটশত জন বৌদ্ধ ভিক্ষু বাস করতেন।
ধ্যানচর্চা, জ্ঞানচর্চা আর ধর্মচর্চাই ছিল এদের ব্রত!

ইতিহাস ঘাঁটলে এটাও জানা যায় যে, একসময় এই বিহারে অবস্থান করতেন প্রাচীন চর্যাগীতিকার কাহ্নপা ও তার গুরু জলন্দরী পা ওরফে হাড়ি পা। এই বিহারেই রচিত হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ!
হাঁটতে হাঁটতেই আমরা চলে এলাম বিহারের এক প্রান্তে। ওখানে একটি বাঁধানো ঘাট। ওই ঘাটের নাম ‘সন্ধ্যাবতীর ঘাট’। কিংবদন্তি আছে যে, মৈদলন রাজার কন্যা সন্ধ্যাবতী এই ঘাটে স্নান করতেন। একদিন পানিতে ভেসে আসা একটি জবাফুলের গন্ধ নেবার পর রাজকন্যা সন্ধ্যাবতী গর্ভবতী হন।
এই গল্পটি শোনার পর নদী খুবই আপ্লæত হয়ে বলল, ‘অয়ন, এ তো রূপকথার গল্পের মতো। আহা, যদি একবার দেখা পেতাম রাজকন্যা সন্ধ্যাবতীর!’

উত্তরে আমি বললাম, ‘কি জানো নদী, জবাফুলের গন্ধ নিয়ে ওভাবে গর্ভবতী হবার পর সন্ধ্যাবতীর সাথে কেউই দেখা করতে চায়নি। কেউই তাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। স্বাগত জানায়নি। মৈদলন রাজা ছিলেন অত্যাচারী। নিজের কন্যা সন্ধ্যাবতীকে তিনি রাজপ্রাসাদ থেকে বিতাড়িত করেন। বিতাড়িত এবং কুমারী অবস্থাতেই সন্ধ্যাবতী একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। ওই সন্তানই পরে ‘সত্যপীর’ নামে পরিচিত হন! এই সত্যপীরই পরবর্তী সময়ে মৈদলন রাজাকে উৎখাত করেন! সত্য-মিথ্যা জানি না, কিংবদন্তি তা-ই বলে’!
বিহারের দক্ষিণ প্রাচীরের বাইরে প্রাচীর-সংলগ্ন একটি মন্দির। মন্দিরটি গন্ধেশ্বরী মন্দির নামে পরিচিত। ওই মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলল নদী।
আমি বললাম, ‘নদী, তুমি কার সাথে কথা বললে? কী বললে?’
নদী বলল, ‘আমি রাজকন্যা সন্ধ্যাবতীর সাথে কথা বললাম। ওর জন্য মন্দিরে প্রার্থনা করলাম’!

আমি মনে মনে ভাবি, সন্ধ্যাবতীর সাথে তো নদীর চেনা নেই। জানা নেই। নদী শুধু সন্ধ্যাবতীর গল্প শুনেছে। গল্প শুনে শুনেই সন্ধ্যাবতীর জন্য নদীর এত মায়া!
এত দরদ!
আহা!
নদী এত কোমলমতি, এত সরল!
সকালের কাঁচা রোদের দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে আরো ভাবি,
কী সব দিন ছিল সেই সব!
কী সব ক্ষণ ছিল সেই সব!
ঠিক যেন শরতের সকালে ঘাসের উপর জমে থাকা শিশিরের উপর প্রথম সূর্যের আলো।
বড়ই রহস্যময় আর ঐশ্বর্যময়! চলবে…