সিনহা আবুল মনসুর : পর্ব: তেরো
অয়নের ডায়েরি
শুক্রবার
২৪শে জুলাই ১৯৮৪।
আজ ছোটখালা আসছেন। আমেরিকা থেকে। দীর্ঘ দশ বছর পর। চুয়াত্তর সালে ছোট খালার বিয়ে হলো। বিয়ের পরপরই খালা চলে গেলেন উইসকনসিন। আমেরিকার ডেয়ারি ও ফার্মল্যান্ড, উইসকনসিন। এই ছোট খালার কাছেই প্রথম জেনেছিলাম যে, বিশ্বখ্যাত ‘সুইস চিজ’-এর জন্ম সুইজারল্যান্ড নয়। ওই চিজের জন্ম এই উইসকনসিনে। খালু উইসকনসিনে গিয়েছেন খালা যাওয়ার মাস তিনেক আগে। ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনে তিনি পিএইচডি করছিলেন। বিষয় অ্যাগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং।
আমার মায়েরা তিন বোন। আমার কোনো মামা নেই। মা সবার বড়। মেজো খালা থাকেন সিলেটে। খালু চা-বাগানের ম্যানেজার। উঁচু পাহাড়ের ওপর বিশাল এক বাংলো। ওই বাংলাতেই থাকেন ওরা। ওই বাংলো থেকে দূরদেশের পাহাড় দেখা যায়, পাহাড়ের ওপর জমে থাকা মেঘ দেখা যায়। বছর দুয়েক অপু আর আমি একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম ওখানে। ওই গল্প আরেক দিন করব।
আজ ছোট খালার গল্প করি।
ছোট খালার নাম ডাকনাম নূপুর। নূপুরের মতোই উচ্ছল ছিলেন। ছিলেন সুন্দরীও। অডরে হেপবার্নের মতো চেহারা। কথা বলতেন সুচিত্রা সেনের মতো নাক উঁচিয়ে আর ঘাড় বাঁকিয়ে! ওই বাঁকেই পথ হারালেন অমিত বড়ুয়া।
অমিত বড়ুয়া আমার একমাত্র কাকা। বাবার কাজিন। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন, ইংরেজি সাহিত্যে। থাকতেন জগন্নাথ হলে। প্রায়ই আসতেন আমাদের বাসায়। মাঝে মাঝে থাকতেনও। নূপুর খালা তখন হোম ইকোনমিকস কলেজে পড়াশোনা করেন। তিনি থাকতেন আমাদের সাথেই।
ছোট ছিলাম, কিন্তু এটা বেশ বুঝতাম, নূপুর খালা খুব পছন্দ করতেন আমার কাকা অমিত বড়ুয়াকে। কাকা দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন। ঠিক যেন দেবরাজ জিউস। স্বভাবে ছিলেন উদাসীন আর বেখেয়ালি। মাঝে মাঝেই হারিয়ে যেতেন।
ডুবে যেতেন!
এক মাস বা দুই মাসের জন্য!
তিন মাসের মাথায় আবার হাজির হতেন আমাদের বাসায়।
তখন তার রোদে পোড়া শরীর, উষ্কখুষ্ক চুল।
দৃষ্টিতে সে কী বিষণ্ণতা!
আমি জিজ্ঞেস করতাম, ‘অমিত কাকু, এত দিন কোথায় ছিলে?’
অমিত কাকু উদাসভাবে বলতেন, ‘বেড়াতে গিয়েছিলাম’!
আমি বলতাম, ‘কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলে?’
কাকা বলতেন, ‘জঙ্গলে’!
আমি বলতাম, ‘সেকি, কোন জঙ্গলে গিয়েছিলে?’
অমিত কাকু বলতেন, ‘কক্সবাজারের রামুতে গিয়েছিলাম’!
আমি বলতাম, ‘জঙ্গলে তোমার কী কাজ? কী করো?’
কাকু বলতেন, ‘অয়ন, রামুতে অনেকগুলো রাবার-বাগান আছে। সময় পেলেই আমি বাগানে যাই। রাবার চাষ করা দেখি। রাবারের কষ সংগ্রহ করা দেখি। রাবার-চাষিদের সাথে গল্প করি। দিন কাটাই।
অয়ন, আমার খুব ইচ্ছে, একদিন রাবার-বাগান করব, রাবার-চাষি হব’!
নূপুর খালা বলতেন, ‘অয়ন, তোমার কাকাকে একটা বিয়ে দিয়ে দাও। তাহলে আর জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরবে না’!
আমার খুব মনে আছে, একবার বৌদ্ধ পূর্ণিমার সময়ে অমিত কাকু আমাদের বাসায় ছিলেন পরপর তিন দিন। দ্বিতীয় দিন বিকেলে নূপুর খালা একটা চিঠি লিখলেন অমিত কাকুকে।
চিঠিটা আমাকে দিয়ে বললেন, ‘অয়ন, এই চিঠিটা তোমার কাকুকে দিবে। খবরদার, তুমি পড়বে না কিন্তু’!
চিঠিটা হাতে নিয়েই আমি চলে গেলাম চিলেকোঠায়। আগে নিজে পড়লাম, তারপর অমিত কাকুকে দিলাম।
ওই চিঠিতে লেখা ছিল, ‘অমিত ভাইয়া, আপনার সামনে এত সুন্দর একটা বাগান! এই বাগান কি আপনার চোখে পড়ে না? এই বাগান উপেক্ষা করে কেন শুধু শুধু ঘুরে বেড়ান বনে-জঙ্গলে’!
অমিত কাকু ওই চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন। আমার হাত দিয়েই।
যথারীতি ওই চিঠিটাও আমি পড়েছি।
চিঠিতে অমিত কাকু লিখেছিলেন:
নূপুর, যেই সুন্দর বাগানের কথা বলেছ, সেই বাগানটা বুঝি তুমি?
জানো নূপুর, আমার খুব ইচ্ছে হয়, সবকিছু ছেড়েছুড়ে তোমার বাগানের মালি হয়ে যাই।
কিন্তু মূল্যবানকে পুরো মূল্যে বরণ করে নেবার মতো অর্থ আর সামর্থ্য কোনোটাই যে আমার নেই’!
মাস খানেক পর আরেকটা চিরকুটে অমিত কাকু লিখেছিলেন:
‘সোনার নূপুর একটু সবুর
আমার স্বপ্নের বাগান
হবেই হবে’!
আমার আমেরিকা-প্রবাসী হবু খালু যখন নূপুর খালাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন, তখন অমিত কাকুর স্বপ্নের বাগান হয়নি!
হবে, সে সম্ভাবনাও তৈরি হয়নি!
তাই, সোনার নূপুর অপেক্ষা করেননি!
সোনার নূপুর, আমার খালা ধনবান খালুকে বিয়ে করে চলে গেলেন দূর পরবাসে! আমাদের সবাইকে ছেড়ে বারো হাজার মাইল দূরের নূতন স্বপ্নের ঠিকানায়!
নূপুর খালার বিয়ে হলো আমাদের বাসায়ই। বিয়ে উপলক্ষে চিটাগাং থেকে এলেন আমার দাদা-দাদি এবং নানা-নানু।
এলেন আত্মীয়স্বজন!
আরো অনেকে!
এলেন না শুধু একজন!
আমার অমিত কাকু!
একদিনের কথা আমার খুব মন আছে। সবাই মিলে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছি।তার ঠিক দুদিন পরই নূপুর খালার বিয়ে।
মা বাবাকে বললেন, ‘নূপুরের গয়না গড়াতে দিয়েছিলাম আমিন জুয়েলার্সে।হয়ে গেছে। চলো, আজ বিকেল গয়নাগুলো নিয়ে আসি।’
বাবা বললেন, ‘তা যাব খন। তবে পত্রিকায় একটা খবর দেখলাম। খুবই ইন্টারেস্টিং। অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি মিনু নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছেন। এটা ওদের দীর্ঘ প্রেমের পরিণতি। বিয়েটা হয়েছে খুবই সাধারণভাবে। একেবারে অনাড়ম্বর পরিবেশে। বর-কনে কোনো গয়নাগাটি ব্যবহার করেননি।
হুমায়ুন ফরীদি মিনুর সম্মতিতেই মিনুকে সোনার মণিহারের বদলে সদ্য প্রস্ফুটিত বেলিফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন!কি জানো, ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও। জানো, বঙ্গবন্ধু উচ্ছ¡সিত হয়ে বলেছেন:
‘কবে যে বাংলাদেশের মেয়েরা স্বর্ণালংকার বাদ দিয়ে বেলিফুলের মালা পরে বিয়ে করবে’!
বাবা ছোট খালাকে বললেন, ‘নূপুর, তুমি কী বলো, বেলিফুলের মালা দিয়ে বিয়ে করবে নাকি? তোমার হবু বর কী বলে’?
না, নূপুর খালা বেলিফুলের মালা গলায় জড়িয়ে বিয়ে করেননি।
বিয়ে করেছিলেন আমার খালুর দেওয়া জড়োয়ার গয়না পরে!
বিয়ের তিন মাস পরই খালা চলে গেলেন আমেরিকায়!
চলে গেলেন অমিত কাকুও!
কোথায় গেলেন কেউ জানে না!
একেবারেই হারিয়ে গেলেন!
ছয় মাস তার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না!
না হোস্টেলে, না দেশের বাড়িতে, না তার বন্ধুবান্ধবের কাছে।
ঠিক ছয় মাস পর কাকু চিঠি লিখলেন আমার বাবাকে। কক্সবাজারের রামু থেকে।
চিঠিতে অমিত কাকু লিখেছিলেন:
‘দাদা, সালাম নিয়ো। গত ছয় মাস খুব ঝামেলার মধ্যে ছিলাম। তাই যোগাযোগ করতে পারিনি। সেজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। ছোটবেলায় মা-বাবা দুজনকেই হারিয়েছি। সেই থেকে তোমার ছায়ায়, তোমার মায়ায় বড় হয়েছি।
তুমিই আমার বাবা!
তুমিই আমার মা!
দাদা, সবারই কিছু না কিছু স্বপ্ন থাকে। আমারও কিছু স্বপ্ন ছিল!সময়ের সাথে সাথে তা ভেঙে গেছে!তবে একটা স্বপ্ন এখনো বেঁচে আছে। সেই স্বপ্নের জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি। আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধু হঠাৎ করেই একটা রাবার-বাগান কিনেছে। আমি সেই বাগানের ম্যানেজারের দায়িত্ব নিয়েছি। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে দিয়েছি। সবাইকে দিয়ে তো আর সব কিছু হয় না!
দাদা, দোয়া কোরো এই কাজটা যাতে ঠিক ঠিক করতে পারি’!
চিঠিটা বাবা মাকে আর আমাকে পড়িয়ে শুনিয়েছিলেন।
শুনে মা কেঁদেছেন। আর বাবা ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন।
ওই দিন রাতেই আমি অমিত কাকুকে স্বপ্নে দেখলাম। স্বপ্নে আমি চলে গিয়েছি রামু।কাকুর বাংলোতে।
কাকুর সাথে অনেক কথা হলো। কিন্তু কোনো কথাই মনে রাখতে পারিনি। শুধু এইটুকুই মনে আছে, কাকুকে খুব বিষণ্ণ দেখেছি!
ঘুম থেকে উঠে সারা দিনই মনে হয়েছে কাকুর কথা।আরো মনে হয়েছে, আমাদের এই জীবনটা এমন কেন?
এক কঠিন কেন? (চলবে)