সিনহা মনসুর : এক.
জন কিটসের আগে ইংরেজি সাহিত্যে আরেক জন কিটস আসেননি। আলেকজেন্ডার পুশকিনের আগে রুশ সাহিত্যে আরেকজন পুশকিন আসেননি। ফেদরিকো গার্সিয়া লোরকার আগে স্প্যানিশ সাহিত্যে আরেকজন লোরকা আসেননি!
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশের আগে আরেকজন জীবনানন্দ আসেননি। আসেননি পরেও! সেই অর্থে কিটসের মতো, পুশকিনের মতো, লোরকার মতোই জীবনানন্দ দুর্লভ ও অনন্য!
অনন্য এই কবির একটি বিষন্ন ইতিহাস ছিল, নির্জনতার ভূগোল ছিল, আর রোমান্টিকতার কাব্যতো ছিলই!
একবিংশ শতাব্দীর এই দ্বিতীয় দশকে দাঁড়িয়ে জীবনানন্দকে জানা কি আমাদের জন্যে জরুরি?
অত্যাবশ্যকীয়?
না, জরুরি নয়!
অত্যাবশ্যকীয় তো নয়ই!
তবে দায় একটা আছে।
এই দায় সত্যের প্রতি জীবনের দায়!
শিল্পের প্রতি মানুষের দায়!
শিল্পীর প্রতি শিল্পের দায়!
প্রকৃত বিবেচনায় দায় আরো আছে। জীবনানন্দ দাশ যে আমাদের মনও মানসের কবি। তিনি যে আমাদের শুদ্ধতম কবি!
নির্জনতার কবি, বিপন্ন বিস্ময়ের কবি!
আর অনতিক্রম্য দূরত্বের কবি!
তা’কে যে আমাদের না জানলেই নয়!

দুই.
নিঃসঙ্গ এই কবির ছায়াপথ যতটা কম্পাসের ভেতরে ছিল ঠিক ততটাই ছিল কম্পাসের বাইরে! তাই বিপন্ন বিস্ময়ের এই কবিকে আবিস্কার করা মানে কাব্যের সৌরলোকে নূতন এক জগতের আবিস্কার! যে জগতের অদ্ভুত কিনারায় দেশে রয়েছে আশ্চর্য সব মানুষ। যে জগতে গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর ছল ছল শব্দে জেগে ওঠেন একজন কবি। তাকিয়ে দেখেন পান্ডুর চাঁদ বৈতরণী থেকে তার অর্ধের ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে যেন কীর্তিনাশার দিকে।
সেই দিকে তাকিয়ে কবি বলেন:
‘জানো না কি চাঁদ,
নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
জানো না কি নিশীথ,
আমি অনেক দিন-
অনেক অনেক দিন
অন্ধকারের সারত্সারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে
হঠাত ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব’লে
বুঝতে পেরেছি আবার;
ভয় পেয়েছি,
পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা;
দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে
মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য
আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;
আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়- বেদনায়- আক্রোশে ভ’রে গিয়েছে;
সুর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে
উত্সব শুরু করেছে।
হায়, উত্সব!
(এ অন্ধকার, জীবনানন্দ দাশ)

তিন.
কবি ছিলেন বিমবিসার অশোকের জগতে। ধূসর সেই জগত! সেই জগতে ছিল বিদরভ নগরীও। ধূসর ওই জগত থেকে কবি শুরু করলেন সময় পরিভ্রমণ! সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর হয়ে শেষ বিকেলের নরম রোদে কবি এসে দাঁড়ালেন কার্তিকের খোলা মাঠে। এসময় রোঁদ মিলিয়ে যায়। দিগন্তজুড়ে আধেক আলোকে দেখা দেয় মরা চাঁদের মরা জোসনা! ওই রহস্যময় আলো আধারীতে হিজলের গাছে ডেকে ওঠে লক্ষীপেঁচা।
কবি তখন আধেক আলো আধেক অন্ধকারের দিকে তাঁকিয়ে বলেন:
‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’!
(বনলতা সেন, জীবনানন্দ দাশ)
কবি ক্লান্ত, কবি নিঃসঙ্গ। কবির এই ক্লান্তি জীবনেরই ক্লান্তি, যুগ-যন্ত্রণার ক্লান্তি! এই নিঃসঙ্গতা জাগতিক নয়, মহাজাগতিক! পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে এই ক্লান্তি, এই নিঃসঙ্গতা, এই শূন্যতা ধাবিত হতে চায় অসীমের দিকে।
কিন্তু পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টানে বারে বারে ফিরে এই পৃথিবীতেই! সেখানে কবির নিরবিচ্ছিন প্রতীক্ষার প্রহর। এই প্রতীক্ষা একটি প্রিয় মুখের জন্যে।
কবি ওই প্রিয় মুখের উদ্দেশ্যে বলেন:
‘মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়- প্রেম নয়- কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে :
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!
(বোধ, জীবনানন্দ দাশ)

চার.
কবির এই নারী যুগ-যুগান্তরের, চিরকালের। কবি তাকে ভালোবেসেছেন, অন্তরাত্মা দিয়ে অনুভব করেছেন, তাকে স্বপ্নের নৌকোয় করে গিয়েছেন অদ্ভুত সব জনপদে। অথচ কোনদিন থাকেননি ওই নারীর সাথে।
এযেন বাস্তব আর পরাবাস্তবের মাঝামাঝি ঝুলন্ত কোন জগত!
ওই জগতে কবি তার প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
‘সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;
তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়’!
(সুচেতনা, জীবনানন্দ দাশ)
কলকাতা কল্লোলিনী হয়নি। তিলোত্তমাও হয়নি। কিন্তু কবির হৃদয় রয়ে গেছে ওই নারীর হাতের মুঠোয়।
নারী ওই হৃদয় নিয়ে খেলেছে, ভেঙ্গেছে, আবার নিজের অজান্তেই ছুঁড়ে ফেলেছে জলের গভীরে।
ওই অতল জলের ভেতর থেকেই কবির আরতি:
‘একদিন ম্লান হেসে আমি
তোমার মতন এক মহিলার কাছে
যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে
অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে
শুনেছি কিন্নরকন্ঠ দেবদারু গাছে,
দেখেছ অমৃতসূর্য আছে।
সবচেয়ে আকাশ নক্ষত্র ঘাস চন্দ্রমল্লিকার রাত্রি ভালো;
তবুও সময় স্থির নয়,
আরেক গভীরতর শেষ রূপ চেয়ে
দেখেছে সে তোমার বলয়।
এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন
তোমার শরীর; তুমি দান করোনি তো;
সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার বলে
সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত’!
(সুদর্শনা, জীবনানন্দ দাশ)

পাঁচ.
রাজপুত্র গৌতম বুদ্ধ। ছিলেন ক্ষমতাধর, ছিলেন পরাক্রমশালী! অর্থ-বিত্ত-প্রতিপত্তি সবই ছিল তার। ছিল নারীর প্রেম, শিশুর ভালোবাসা, কীর্তি আর সম্পদ। কিন্তু কোন এক পূর্ণিমার রাতে সবার অলক্ষ্যে তিনি প্রাসাদ ছাড়লেন। নামলেন পথে!
কেন নামলেন?
কার টানে?
কিসের টানে?
কবির এর নাম দিয়েছেন ‘বিপন্ন বিস্ময়’!
কবি বলছেন:
‘জানি-তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, র্কীতি নয়, সচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত ক্লান্ত করে:
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিত হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।
(আট বছর আগে একদিন, জীবনানন্দ দাশ)
এই ‘বিপন্ন বিস্ময়’-এর উত্স সন্ধানেই কবি কাটিয়েছেন তার পুরো জীবন। কিন্তু
‘যে জীবন ফড়িংয়ের যে জীবন দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা’!
হায় জীবন!
হায় বিপন্ন বিস্ময়!
সিনহা মনসুর।